যারা এই ভদ্রলোকেদের নাম কোনদিন শুনেন নাই - আশির দশকের মাঝামাঝির দিকে মুলত তিন কুতুব বিএনপির ছাত্রসংগঠন ছাত্রদল নিয়ন্ত্রন করত। মাহবুবুল হক বাবলু, সানাউল হক নীরু এবং গোলাম ফারুক অভি। এর মধ্যে নীরু, বাবলু ছিল আপন দুই ভাই এবং ছাত্রদলের দুই মাথা। অভি ঠিক তাদের পিছনে।
'৮৭ এর ব্যর্থ এরশাদবিরোধী আন্দোলনের কিছু আগে বা পড়ে বাবলু মহসিন হলে (এই হলকে এরশাদ আমলে সেকেন্ড ক্যান্টনমেন্ট বলা হত অস্ত্র-বোমার বিশাল মজুদের কারনে) নিজেদের বানানো বোমাবিষ্ফোরনে মারা যান। সেই সময় শোনা গল্পটা ছিল এইরকম, রুমের দরজার পিছনে বোমা রাখা ছিল, বাবলু এসে জোরে দরজা খুললে দরজা বোমায় লেগে বোমা ফেটে উনি মারা যান।
বাবলু মারা যাওয়ার পরে নীরু ছাত্রদলের একমাত্র শীর্ষ রাজনৈতিক নেতা হন। অভি ছিল মুলত ক্যাডার নেতা। '৯০ এর এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের কয়েক মাস আগে দুইজনই গ্রেফতার হন এবং নভেম্বর মাসে প্রায় একই সময় দুইজন মুক্তিও পান। ছাত্রদলের বাকি নেতাকর্মীরা তাদের মিষ্টি-মালা দিয়ে বরন করেন, পত্রিকায় বিশাল ছবি ছাপা হয়। ছাত্রদলে তাদের অবস্থান আগের মত থাকলেও জেলে থাকার কারনে আন্দোলনের জন্য গঠিত সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যে তাদের পজিশন খুব ভাল ছিল না। ছাত্র ঐক্যের নেতৃত্ব চলে যায় ছাত্রদলের বেশ পিছন দিকের নেতা আমান, খোকনদের কাছে যেহেতু তারা তখন ডাকসুর ভিপি-জিএস ছিলেন।
নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে এরশাদবিরোধী আন্দোলন তুঙ্গে উঠে। ২৩ অথবা ২৪ তারিখ টিএসসি এলাকা রণক্ষেত্রে পরিনত হয়। পুলিশ বা এরশাদের ছাত্র ক্যাডারদের গুলিতে ডাক্তার মিলন নিহত হন। দেশের পরিস্থিতি এতই খারাপ হয় যে এরশাদ ২৮শে নভেম্বর জরুরী অবস্থা ঘোষনা এবং কারফিউ জারী করেন। এই অবস্থা চলে ৪ঠা ডিসেম্বর মধ্যরাতে এরশাদের পদত্যাগের ঘোষনা দেয়া পর্যন্ত।
টিএসসির ওই গ্যাঞ্জামের সময় যেটা সবাই খুব অবাক বিষ্ময়ে লক্ষ্য করে যে নীরু এবং অভি দুইজনই উপরে উপরে ছাত্রদলের সাথে থাকলেও আসলে জেলে থাকা অবস্থায় এরশাদের হাত মিলিয়েছে এবং ছাত্র আন্দোলন ভন্ডুল করার জন্যই তাদেরকে জেল থেকে মুক্তি দেয়া হয়েছে। কারো মতে তারা প্রত্যেকে ৫০ লাখ, কারো মতে এক কোটি টাকা করে পেয়েছেন এই বিশ্বাসঘাতকতার জন্য। আমি অবশ্য মনে করি, টাকার এই পরিমানগুলি নিতান্তই গুজব। আসল অংকটা কারো পক্ষে জানা অসম্ভব। পল্টি খাওয়া বাংলাদেশের রাজনীতিতে খুব সাধারন ঘটনা হলেও এক দলের সাথে থেকে আরেক দলের হয়ে কাজ করার উদাহরন সম্ভবত এটাই একমাত্র। আর সেই সময়টাও ছিল এমন যে সবাই তখন দেশপ্রেমিক হয়ে উঠেছিল। নীরু, অভিকে হাতের কাছে পেলে মনে হয় টুকরা টুকরা করে বুড়িগঙ্গায় ভাসানো হত। জনরোষ এবং গ্রেফতার এড়ানোর জন্য দুইজনই পালিয়ে যান।
নব্বই দশকের মাঝামাঝি যখন মানুষের মধ্যে এরশাদবিরোধী জোশ এবং দেশপ্রেম বেশ ফ্যাকাসে হয়ে গেছে, অভি আবার আলোচনায় ফিরে আসে এবং অফিসিয়ালি জাতীয় পার্টিতে যোগ দিয়ে '৯৬ এর নির্বাচনে বরিশাল থেকে মনোনয়ন পায় এবং জয়ী হয়। এর কয়েক বছর পরে মডেল তিন্নি হত্যা মামলায় ফেঁসে আবার ফেরার হন। এই সময়ই এমপি হোস্টেলে এক এয়ারহোস্টেসের সাথে তার একটা হিডেনক্যাম ভিডিও বেশ আলোড়ন তুলে। এর পর তার আর কোন খবর পাওয়া যায় নাই। ক্যানাডার বাঙ্গালি সমাজে প্রচলিত ধারনা যে অভি অনেক বছর ধরে টরেন্টোতে আছে। দশ বছর থাকার পরেও তাকে দেখা তো দুরের কথা, আমি এখনো কাউকে পাই নাই যে অভিকে দেখেছে। কিন্তু লোকে বিশ্বাস করে যে সে এই শহরে আছে কোথাও।
এরশাদের পতনের সাথে সাথে নীরু সেই যে দৃশ্যপট থেকে উধাও হয়, আমি অন্তত ২০০৬ পর্যন্ত তার সম্পর্কে একটা কথাও শুনি নাই, তার কোন সাক্ষাতকার কোথাও দেখি নাই, সে রাজনীতিতে ফিরে আসার চেষ্টা করছে এরকম কোন খবরও কানে আসে নাই। যেন একটা জ্বলজ্যান্ত অতি বিখ্যাত (বা কুখ্যাত, যাই বলেন) ব্যক্তি হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে গেল। ছাত্রদলের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা নীরুর অনেক জুনিয়র নেতা আমানুল্লাহ আমান এমপি, মন্ত্রী, কোটিপতি দুর্নীতি মামলার আসামী সবকিছু হয়ে গেল। এই বেচারার ফেরার হয়েই থাকতে হল অনেক বছর।
২০০৬ সালে বদরুদ্দোজা বিকল্পধারা নামে যে সাইনবোর্ডসর্বস্ব এবং এক ব্যক্তি এক নেতাটাইপ দল গঠন করে, তাতে নীরুও যোগদান করে। কিন্তু অনেক বছর রাজনীতিতে না থাকার কারনে তার পলিটিক্যাল ভ্যালু বলতে কিছুই তখন ছিল না। অন্য অনেকের সাথে ছোট করে পত্রিকায় তার নাম ছাপা হয়। অল্প কিছুদিনের মধ্যে এই দলেরও সলিল সমাধি ঘটে এবং সাথে নীরুর আবার রাজনীতিতে ফিরে আসার সুযোগও। এর পরে এখন পর্যন্ত আর তার সম্পর্কে কিছু শুনি নাই।
বিঃদ্রঃ আমার জন্ম্ ১৯৮০ সালে। বুঝতেই পারছেন, উপরের ঘটনাগুলির সময় আমার বয়স কত ছিল! পুরা পোস্টটাই সম্পূর্নভাবে সেই সময়কার স্মৃতি থেকে লিখা। তাই এর মধ্যে কিছু তথ্যবিভ্রাট, তারিখের গন্ডগোল থাকবেই। তবে মুল ঘটনা মোটামুটি এইরকমই। ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখে কারেকশন করে দিলে বাধিত থাকব। ধন্যবাদ।
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে জুন, ২০১০ সকাল ১০:১৮