কারো কারো ফেরার মন থাকে কিন্তু মানুষ থাকে না
কারো কারো ফেরার মানুষ থাকে কিন্তু মন থাকে না।
বাবা বলেছিল বামফ্রন্ট জিতবে। তা অনেক বছর হয়ে গেলো বাবা আর রাজনীতি বোঝে না। বাবা মারা গেছেন বছর সাতেক হল। দেওয়ালে দেওয়ালে অদ্ভুত সিংহেরা মুছে গেছে। জীবনটা সাদাকালো টিভি থেকে হয়ে গেছে কালার। বামফ্রন্টের সময় আই পি এল ছিল। এখনো আছে। ডার্বি আছে, ই.পি.এল আছে। তবে অনেক মানুষ নেই। অনেক সহজ মানুষ নেই। তার বদলে অনেক ভিড় আছে।উঁচু উঁচু আলো আছে। মাঝবয়সী ল্যাম্প-পোস্ট ছাড়িয়ে সব জোয়ান ছোকরা সব আলো। শুনেছি এখনকার বাচ্চারা নাকি উচ্চতা-তে বেশি হয়। বামপন্থী বাবা এর একটা সম্ভাব্য কারণ হিসেবে মুরগিকে ইনজেকশন বলেছে।
এখন আমাদের বাড়িতে কোনও পোষা বিড়াল নেই।এখন আমাদের বাড়ি সন্ধ্যে হলে লোকে টিভি দেখতে আসে না। এখন ‘জন্মভূমি’ মেগা সিরিয়াল নেই,থাকলে ভালো হত হয়ত, অনেকে আসতো বাড়িতে।এখন কেউ আসে না।বাবার সঙ্গে কথা বলা হয় না। সন্ধেবেলা পুরনো মুখদের আর দেখতে পাই না।পুরনো মধ্যবিত্ত সস্তা মুখদের।বরং খুব দামী কিছু লোক আশেপাশে ঘুরে বেড়ায়। তাদের আমি চিনতে পারি না।অস্বস্তি হয়।দিকে দিকে অসম্ভব আলো।রাস্তার পর রাস্তা সিমেন্ট হয়ে যাচ্ছে।একটা সবুজের কণাও দেখতে পাই না। মানুষের মনেও।সিনেমা দেখতে গেলে অনেক টাকার ধাক্কা,কিছু সুস্থ খেতে গেলে আরও কিছু…প্রেমিকা ছাড়া ফুচকা আজকাল ধাতে সয়ে নিয়েছি।ফুচকার পেছনের দেওয়ালে সিংহটাও অদ্ভুত ভাবে পালিয়ে গেছে।এখন ফুল।ফুলের রাজ্য আমাদের।মা একটা ছোট্ট জীবনে কেমন সেঁধিয়ে গেছে শেখার চেষ্টা করি।লোকজন জিজ্ঞেস করলে বলি বাবার টাকা আছে, কিছু একটা চেষ্টা করছি। ভালো কিছু। মানে অর্থকরী কিছু নয়, শান্তি-দায়ক কিছু। কিন্তু সামসাং ইতিমধ্যে নতুন মডেল বার করে ফেলেছে।জীবন যদি কোনোদিন নতুন মডেল বার করে ফেলে আমাকে আবার আপডেট করতে যেতে হবে।দামী দামী জীবনের মাঝে আমার মাথায় হটাত বাঁশির শব্দ ভেসে আসে।হানি শিঙের মাঝে হটাত শুনে ফেলি-‘আমি যে নিজেই মত্ত, জানি না তোমার শর্ত’।ক্যাটরিনা,করিনাদের মধ্যে আগলে রাখি আমার প্রথম প্রেম ‘কেয়াকে’। ইটগুলো আর বেরিয়ে থাকে না, চমৎকার প্লাস্টার হয়ে যায়।ক্ষতগুলোও।সিংহেরা আজ দেওয়ালে দেওয়ালে থাকে না,হেলমেট-হীন প্রেমিক প্রেমিকারা হটাত ধরা পড়ে যায়,কারো কারো বাড়িতে এখন আর লোড-শেডিং হয় না, বেশিক্ষণ সাইকেল চালালে আজকাল কোমরে খুব ব্যথা করে।মাঝে মাঝে স্বপ্নের মধ্যে, বাথরুমের মধ্যে দিয়ে মন চলে যায় বোলপুর।তারপর বাড়ির জন্য মন খারাপ লাগে। বাড়ির ফুলগাছটার জন্য।এখন আর আলিফ ল্যায়লা হয় না আমার জীবনে,এখন আর শক্তিমান আসে না।ছোট কোনও পা ফেলতে গেলে ভাবতে হয় এক পৃথিবী। কোনও ভুলের ভয় বাঁচতে শুরু করি পঁচিশ পয়সার।কুড়ি পয়সা এখন আর পাওয়া যায় না শুধু রেলগাড়ি বয়ে যায়।ঝন ঝন করে কাঁপিয়ে যায়আশপাশকে।যেন বদ্ধ কোনও পশু এদিক ওদিক তাকায় না, শুধু সরলরেখা বরাবর উন্মত্তের মতো ছোটে। আমাদের ছাদের কোনও অ্যান্টেনা নেই। তাতে কাক বসে না।
আমাদের ছাদে কোনও ফুলদানি নেই। ফুল ফুটে থাকে দেওয়ালে দেওয়ালে। সবুজ ফুল, পদ্ম ফুল। আর হটাত কোনও ঝিরি ঝিরি ঝাল সন্ধেবেলা এক হাড়গিলে প্রেমিক কিশোর আচমকা বলে ওঠে-ঝিণ্টি তুই বৃষ্টি হতে পারতিস। ঝিণ্টির বৃষ্টি হওয়া হয়েছে কিনা জানি না,তবে সবকিছু হটাত জটিল হয়ে গেছে আচমকা।সবকিছু কেমন থার্ড পার্টি অ্যাপ্লিকেশন হয়ে গেছে।দুনিয়া এখন হাতের মুঠোয়, রহস্য আর নেই। প্রেম থেকে পেচ্ছাপ সব এখন খুললাম খুল্লা।সেলাই দিদিমণির জীবনও এখন মাল্টিপ্লেক্স। এসবের মাঝে একটা চুন করা দেওয়ালে একটা বিচিত্র সিংহ খুঁজছি। খুঁজছি সেই দেওয়ালের পাশের গলিতে সন্ধ্যে ছটা থেকে আধঘণ্টা দাঁড়িয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করে থাকা ‘কেয়াকে’-জীবনকে।
মনকেমনের দিনে
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা জুন, ২০১৮ রাত ১:১১