রমজান নামক পবিত্র মাসটি বছরের একটি সময়ে অনেকটা হঠাৎ করে চলে আসে। হঠাৎ করে একটি সময়ে শেষও হয়ে যায়। রমজানের ঈদ চলে যেতে না যেতেই একটি সময়ে ঢাকার মত পৃথিবীর সবচেয়ে বসবাস অযোগ্য কাঠখোট্টা শহরটিতে গ্রাম গঞ্জ থেকে গবাদি পশুগুলো ঢুকতে শুরু করে। আমরা তখন বুঝতে শুরু করি, আরেকটি ঈদের ঘ্রান বাতাসে ছড়িয়েছে.... ঈদ-উল-আযহা বা কুরবানীর ঈদ...
আমদের জীবনে অনেক সুসংবাদের আগমন ঘটে। কখনো কখনো অপ্রত্যাশিত হলেও দুঃসংবাদগুলোও সে পথ চিনে যায়। ফলে সেসকল দুঃসংবাদ কিছুটা হলেও প্রতিদিনের স্বাভাবিকতা থেকে আমাদের ছিটকে দেয়।
আমার প্রায় সময়ে মনে হয়, সুসংবাদ এবং দুঃসংবাদ মূলত আলাদাভাবে আসে না। প্রকৃতি প্রায় প্রতিটি সময়েই একইসঙ্গে একটি সুসংবাদ ও দুঃসংবাদ দিয়ে থাকে। আমরা যেকোন একটি বেছে নেই। অন্যটিকে অবচেতনমনেই নির্বাসিত করে দেই.. ।
আজকের দিনটির মত বেঁচে যাওয়াটি আমাদের জন্যে একটি বড় সুসংবাদ। আমাদের প্রতিটি দিনই তেমন একটি সুসংবাদ দিয়েই শুরু হয়। সে সুসংবাদকে মেনেই নিয়েই প্রতিটা দিন আমরা ঘর থেকে বেরিয়ে প্রবল রোদ মাথায় নিয়ে কর্মস্থলে যাই। দিনশেষে বাড়ি ফেরার সময় কোন এক এফএনএফ নম্বরে যুক্ত হয়ে ৫ মিনিটে সারাদিনের রোদবৃষ্টির ক্লান্তি ভুলতে চাই।
এই বেঁচে যাওয়াটা একদিক থেকে যেমন সুসংবাদ, তেমনি দিনের পর দিন বেঁচে যাওয়ায় আমাদের এমন কিছু বাস্তবতা দেখার সুযোগ তৈরী হয়, যা দেখে পুরো মহাবিশ্বে পাওয়া পৃথিবী নামক সবচাইতে সুন্দর গ্রহটির প্রতিও ঘৃণা জন্মে যায়...
পরিবারের কেউ চলে যাওয়ায় হয়তো সে পরিবারে একজনের খাবার আজীবনের জন্যে বেঁচে যায়। যৌক্তিক দৃষ্টিকোন থেকে সেটি হয়তো এক প্রকার সুসংবাদ। কিন্তু যে মানুষটা চলে যায় , সে মানুষটির শূণ্যস্থানটিরও অনেকগুলো ফাঁকা ছিদ্র থেকে যায়। প্রতিবার রাতে খেতে বসায় একজনের প্লেটে ভাত বাড়তে না হলেও "কেউ একজন আর ভাতের প্লেট নিয়ে বসছে না" এই ভাবনাটি পরিবারের অন্য সদস্যদের পোড়ায়। ছোটবোনটা অনেকদিন সে যন্ত্রণা থেকে ভাত ভালভাবে না খেয়েই আগে ঘুমিয়ে যায়। পরিবারের কর্তাটি এক লোকমা ভাত মুখে দিয়ে ঝিম ধরে বসে থেকে থেকে প্লেটের ভাতগুলো গলা দিয়ে কোনরকমে নামিয়ে দেয়। ছোটভাইটার উপড় এসবের প্রভাব খুব একটা প্রভাব না পড়লেও যখন দেখা যায় কোন ঈদে কেউ আর পাঞ্জাবী কেনার টাকা নিয়ে বাবার সাথে ঝগড়া করছে না, তখন সেও বুঝতে শুরু করে... কিছু একটা নেই এই পরিবারে... ।
কোন এক বড় অপরাধে, কিংবা অন্য কারো বড় অপরাধের দায় নিয়ে বছরের পর বছর যে ছেলেটা জেল খাটছে, তার প্রতিবছরের ঈদ কিভাবে কাটে আমি জানি না। কোন বাবা যখন এমন কোন ঈদে ছেলের সাথে দেখা করতে যখন জেলখানায় যায়, হয়তো সে সময়ে কে কতটা কান্না চেপে একজন অন্যজনকে মুখে প্রশস্ত এক হাসি নিয়ে ঈদ মোবারক জানাবে , তেমন একটি নিরব প্রতিযোগীতা চলে।
আমি জানিনা, সমাজের চোখে বিনা দলিলে প্রমাণিত হওয়া এরকম কোন দাগী আসামীর ছোট ভাইদের ঈদ প্রতি বছর কিভাবে কাটে। আমি জানিনা, বড় ভাই দাগী হবার অপরাধে ঈদের মত উৎসবেও অপমানিত হবার ভয়ে কোন বন্ধুর বাড়িতে পর্যন্ত যাওয়া বন্ধ হয়ে গিয়েছে কিনা। কিংবা সমাজের চোখে বিনা দলিলে প্রমাণিত কোন এক কুলাঙ্গার জন্ম দেয়ার অপরাধে কোন মা ঈদের সেমাই রান্নার সময়ে রান্নাঘরের ময়লা জানালার ভেতর দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে অন্যমনষ্ক হয়ে যায় কিনা...
প্রতি বছরই ঈদ আসে। তবে সে ঈদ যেমন এসিতে গাড়ীতে থাকা কোন এক ধনীর দুলালের জন্যে আসে, ঠিক তেমনি রাস্তার পাশে চিতই পিঠা ভেজে চলা পরিবারটার জন্যেও আসে..
প্রকৃতির সেই পুরনো নিয়মেই প্রতিটি ঈদ আনন্দের বার্তাবাহক হয়ে সুসংবাদ হিসেবে আমাদের মাঝে এলেও কারো কারো জন্যে হতাশার বার্তাও দুঃসংবাদ হিসেবে নিয়ে আসে...
যার জন্যে কোন কোন বাবা ঈদ মোবারক জানাতে ছেলের জেলখানায় গিয়ে এক কুঠুরীতে বছরের পর বছরে থেকে জং ধরে যাওয়া ছেলের চেহারার মলিন হাসিমুখ দেখতে যায়। যে মা সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত রান্নাঘরে ঈদের রান্নায় সীমাহিন ব্যস্ততায় কাটাচ্ছে, সেও কল্পনায় ভেবে নেয় যে ছেলেকে নতুন পাঞ্জাবীতে কেমন দেখাতো...
মেসের অন্য সকলে বাড়ি চলে যাবার পরেও ফাঁকা মেসে যে ছেলেটা একলা দিন কাটাচ্ছে সেও মনে মনে ভেবে নেয়, একটা পরিবার যদি তার থাকতো, তবে কার জন্যে কি নিয়ে ঢাকা থেকে বাড়ি ফিরতো....
(ঈদ মোবারক)
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে আগস্ট, ২০১৮ রাত ১০:৩৬