খবর: জুন ২৩, ২০২৩
নাহেল মারজুক, ১৭ বছরের আলজেরিয় ও মরক্কান বংশোদ্ভূত এক নিরপরাধ কিশোরকে Nanterre (প্যারিসের এক শহরতলি)তে পুলিশ গুলি করে হত্যা করে। এমন হত্যা এটিই প্রথম নয়। ফলশ্রুতিতে, জনগণ যার বেশিরভাগই অভিবাসী শ্রেণীর, বিক্ষুব্ধ ও ধ্বংসাত্মক হয়ে জ্বালাও পোড়াও সহ লুটতরাজ শুরু করে।
ফ্যাশন, সাহিত্য, সংস্কৃতি, সুরভী, ও রসনা বিলাস সহ নানা বিষয়ে ফ্রান্স বিশ্বের নেতৃস্থানীয়। এদেশের আলো হাওয়ায় জন্ম হয়েছে দেকার্তে, রুশো, সার্ত্রে, ভলতেয়ারের মত দার্শনিক যাদের চিন্তাভাবনা সারা বিশ্বকে আন্দোলিত করেছে। জন্ম হয়েছে লুই পাস্তুর ও ম্যারি কুরির মতো বিজ্ঞানীর। বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীতে আমার প্রথম প্রেম জুল ভার্ন সহ অ্যালবার্ট কামু, মার্সেল প্রুস্ত, সিমোন দ্য বোভেয়ার, ও ফ্রেডেরিখ মিস্ট্রালের মতো ক্ষণজন্মা মনীষীদের বেড়ে ওঠা ও বিচরণ এই ফ্রান্সের মাটিতেই। প্লাতিনি, জিদান, বেনজেমা, এমবাপ্পের মতো ফুটবলার ও বিশ্বকাপের দেশও ফ্রান্স।
এই ফ্রান্সে দুদিন পরপর গণ-অসন্তোষ ও ধ্বংসাত্মক দাঙ্গা হাঙ্গামার কারণ কি?
জাতিবিদ্বেষ ও বর্ণ বৈষম্য
জাতিবিদ্বেষ ও বর্ণবাদের বিষয়ে ফ্রান্সের একটি জটিল ইতিহাস রয়েছে। ল্য মুন্দের (Le Monde) খবরে ২০২২ থেকে আজ পর্যন্ত পুলিশের গুলিতে ১৫ জনের নিহতের কথা উল্লেখ রয়েছে। দ্য মিররের এক প্রতিবেদনে, ২০২১-২০২২ এর মধ্যে পুলিশের গুলিতে অন্তত ১৭ জনের হত্যার খবর প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদনে, নিহতদের সবাই আফ্রিকান অথবা নর্থ আফ্রিকান দেশ যেমন, আলজেরিয়া, তিউনিসিয়া, ও মিশর প্রভৃতি দেশ থেকে আসা অভিবাসী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এ দেশগুলো একসময় আফ্রিকা, এশিয়া, ক্যারিবিয়ান, ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল নিয়ে গঠিত একটি বিশাল ফরাসি ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যের (colony) অন্তর্ভুক্ত ছিল। বর্ণবাদী মতাদর্শ দ্বারা প্রভাবিত ঔপনিবেশিক শাসনকাল স্থানীয় জনগোষ্ঠীর মূল্যবোধের নিকুচি করে পরাধীনতার শাসন এবং অমানবিকরনকে স্বীকৃতি প্রদানের মাধ্যমে পরিচালিত হতো। এর নীতি এবং অনুশীলন গুলি জোরপূর্বক শ্রম, সাংস্কৃতিক আত্তীকরণ, ও উপনিবেশিত জনগণের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণেই অভ্যস্ত ছিল।
দাস ব্যবসায়ী ফ্রান্স
অভ্যস্ততা অভ্যাসের বিষয়। আমরা অনেকেই জানি না যে ফ্রান্স ছিল মানব ইতিহাসের বৃহত্তম দাস বাণিজ্যে নিয়োজিত দেশগুলোর অন্যতম। পর্তুগাল ও গ্রেইট বৃটেনের পর ফ্রান্স বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম আন্তর্জাতিক দাস ব্যবসায়ী। Slave Voyage থেকে প্রাপ্ত ডাটাবেইজ অনুযায়ী ফ্রান্স ১৫৫১ থেকে ১৮৭৫ পর্যন্ত সময়ে আফ্রিকা থেকে জাহাজে করে প্রায় ১৪ লক্ষ মানুষকে জোরপূর্বক, শ্রম ও দাসত্বের উদ্দেশ্যে বাস্তুচ্যুত করে তার সার্ভেন্ট (servant) তথা দরিদ্র সাদা ইউরোপিয়ানদের স্থান পূরণ করে। অর্থাৎ যে দাস ব্যবস্থা ইউরোপে ছিল, তার চেয়ে 'কম দাম বেশি লাভ' ও সহজলভ্য দেখে, ধরে আনা কালো মানুষদের রক্তভেজা শ্রমের ঘামের উপর দাঁড়িয়ে গড়ে উঠতে থাকে ফ্রান্সের ছড়ানো ছিটানো ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্য। বিশেষ করে হেইতি (Haiti) ওমার্টিনিকে(Martinique) জাহাজ বোঝাই করে সহজলভ্য এই দাসদের পাঠানো হয় শ্রম, বর্বরতা এবং বর্ণবাদকে প্যাকেজ বানিয়ে।।
ফ্রান্স ক্যানাডার প্রথম ঔপনিবেশিক শাসক ছিল। 'যে যায় লংকায় সে-ই হয় রাবণ' - এই নীতি মেনে অস্ত্রের মুখে আদিবাসী (indigenous) ক্যানাডিয়ানদের দাস বানিয়ে শুরু হয় ক্যানাডাতে ফ্রান্সের জমজমাট দাস ব্যবসা যা পরবর্তীতে আফ্রিকা থেকে ধরে আনা এই কালো মানুষদের দিয়ে প্রতিস্থাপিত হয়। অনেকেই হয়তো জেনে অবাক হবেন যে ইংল্যান্ডের East India Company'র মতো ফ্রান্সেরও একটা West India Company ছিল যাদের একটি প্রধান পণ্য ছিল কালো মানুষ।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ফ্রান্স জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলে জার্মানি ফ্রান্সে অভিযান চালিয়ে বিরাট এক উত্তরাঞ্চল দখল করে নেয়। এর কিছুদিন পর পশ্চিমাঞ্চলও জার্মানির করায়ত্ত হয়। তখন মুক্ত অংশ, ভিশি ফ্রান্স(Vichy, France) এর সরকার জার্মানির সাথে একটি অস্ত্র বিরতি চুক্তি করে জার্মানিকে থামানোর জন্য। Pierre Laval, যিনি ছিলেন মুলত acting head of the government (কিন্তু তিনিই শাসন করতেন) রাজাকার হিসেবে আবির্ভূত হন এবং জার্মানিকে খুশি ও নিজের গদি ঠিক রাখতে মুরগির বদলে ইহুদি সাপ্লাই দিতে শুরু করেন। ভিশি ফ্রান্সের সরকার এ জন্য বেছে নেয় বহিরাগত ইহুদিদের। শিশু-কিশোর, যুবক, বয়োবৃদ্ধ, ফ্যামিলি সব মিলিয়ে প্রায় ৭৭ হাজার ইহুদীকে জার্মানি ও পোল্যান্ডে পাঠানো হয় রাস্তা তৈরি ও নানাবিধ কনস্ট্রাকশনের কাজে এবং অবশ্যই যাদের নিশ্চিত শেষ গন্তব্য ছিল নাৎসি কনসেনট্রেশান (concentration) ক্যাম্প এবং গ্যাস চেম্বার।
কেন ইহুদি?
খ্রিস্টান অধ্যুষিত ইয়োরোপে ইহুদিদের অবস্থা খুব খারাপ তখন। ওরা ইয়োরোপে উন্নত জীবনযাপন করতে পারতো না। পুরো ইয়োরোপেই ইহুদিরা তাড়িত হতো। খ্রিস্ট্রীয় জগতে ইহুদিদের নিচুস্তরের মানুষ হিসেবে দেখা হতো বলে তাদের কাজের সুযোগও ছিল সীমিত। ইহুদিদের সেনাবাহিনীতে নেওয়া হোত না, সামাজিক সংগঠনে জড়িত থাকতে পারতো না। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, ল-ইয়ার ইত্যাদি পেশায়ও নিয়োজিত হতে পারতো না। বাধ্য হয়ে ইহুদিরা তখন সুদে টাকা পয়সা ধারের মহাজনি/কাবুলিওয়ালা ব্যবসা শুরু করে। খ্রিস্টানরা সুদের ব্যবসাকে অধর্ম ভাবতো ও খারাপ চোখে দেখতো তাই খোলা মাঠে ইহুদি মহাজনেরা এই পেশায় বিশেষ সাফল্য লাভ করে। শেক্সপীয়ার এর The Merchant of Venice এর শাইলক (Shylock) এর চরিত্র ও দৃশ্যপটই ছিল ইহুদিদের প্রতি শত শত বছরের ইয়োরোপিয়ান দৃষ্টিভঙ্গি। শেক্সপিয়ার নাটকটি লিখেছিলেন ১৬০০ খ্রিস্টাব্দের দিকে।
ফ্রান্সে এসে আশ্রয় নেওয়া ইহুদিরা ছিল মূলত উদ্বাস্তু/রেফিউজি এবং অন্য দেশ থেকে উন্নত ও নিশ্চিত জীবনের উদ্দেশ্য নিয়ে আসা এক বিধ্বস্ত মানব গোষ্ঠী। পরিকল্পিত অভিযানের মাধ্যমে ঘেরাও করে তুলে এনে ফ্রান্স সরকার এই শ্রেণীর ইহুদিদের জার্মানির হাতে তুলে দেয়। নাৎসি জার্মানি এদের জবরদস্তি শ্রমে নিয়োজিত করে ও বিভিন্ন নির্যাতনের ক্যাম্পে পাঠিয়ে গণহত্যা করে। যদিও ভিশি ফ্রান্স(Vichy, France) সরকারের এই বন্দোবস্তে জার্মান দখল মুক্ত ফরাসি নাগরিকরা (অনেক ইহুদি সহ) সুরক্ষিত থেকে যান। এটি শুধু ফ্রান্সেরই নয় বরং মানবসভ্যতারই এক কলঙ্কজনক ইতিহাস যার প্রভাব ও অভিশাপ থেকে ফ্রান্সের শাসক শ্রেণী আজও মুক্ত হতে পারেনি।
ঔপনিবেশিক ফ্রান্স
ফ্রান্সের ইতিহাসের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হচ্ছে আলজেরিয়া দখল। ৩০০ বছরের মুসলিম অটোমান(Ottoman) সাম্রাজ্যের অবসান ঘটিয়ে ১৮৩০ সালে ফ্রান্স আলজেরিয়ার রাজধানী আলজিয়ার্স দখল করে নেয়। পরবর্তী ১৫ বছরের মধ্যে দেশটির বাকি অংশও করায়ত্ব করে বঞ্চনা, শোষণ, ও হত্যার শাসন প্রতিষ্ঠা করে। বর্ণবাদের তথাকথিত শ্রেষ্ঠত্বের ঘাড়ে চেপে ১৩০ বছর শাসনও করে। আলজেরিয়ান মুসলিমদের নিজ ভূমে পরবাসী করতে আইন করে উর্বর সব ভূমির মালিকানা দেওয়া হয় উড়ে এসে জুড়ে বসা ইয়োরোপিয়ান(মূলত সাদা) ও অন্য ধর্মের মানুষদের হাতে। এই আইনে স্থানীয় জনগণের স্বাধীনভাবে চলাচলের অধিকারও খর্ব করে দেয়া হয়। বর্ণবাদের উজ্জ্বল স্বাক্ষর রাখতে আলজেরিয়ান ইহুদিদের ফ্রান্সের নাগরিকত্ব প্রদান করে আরব মুসলিম ও বারবার(Berber)দের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসেবে চিহ্নিত করে শোষণের পথ আরো প্রশস্ত করে।
ঔপনিবেশিক লুন্ঠনের একটি চিত্র
২০২১ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারিতে আলজেরিয়ার আমির আব্দুল কাদের ইউনিভার্সিটি অব ইসলামিক সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত এক কনফারেন্সে বিভিন্ন ইতিহাসবিদ ও গবেষকরা উল্লেখ করেন যে, ১৩০ বছরের শাসনকালে আলজেরিয়া থেকে ফ্রান্সের লুট করার স্বর্নের পরিমাণ প্রায় ১১০ টন। পাচার করা অর্থের পরিমাণ ১৮০ বিলিয়ন ডলার। জানিয়ে রাখি, স্বর্ন রিজার্ভে আলজেরিয়া বিশ্বের ২৪তম দেশ, বাংলাদেশ ৬৫তম।
বর্তমানে ফ্রান্সে বসবাসরত আলজেরিয়া, মরক্কো সহ অন্যান্য আফ্রিকান ও নর্থ আফ্রিকান অভিবাসীদের জীবন ব্যবস্থা ফরাসিদের মত প্রথম শ্রেণীর নয়। এখনও ফ্রান্সে জন্ম ও বেড়ে উঠছে এমন দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্রজন্মের অভিবাসী নাগরিকদেরও প্রতিনিয়ত পুলিশি হয়রানির শিকার হতে হয় গায়ের রঙের কারণে(coloured)। অপর্যাপ্ত নাগরিক সুযোগ সুবিধার অভিযোগ ও মৌলিক অধিকার বঞ্চিত এই শ্রেণিটির জন্য এটাও একরকম দাসত্ব। ফরাসি মিডিয়া ও জনগণের একটি বড় অংশ এই শোষণে সক্রিয়ভাবে অংশ নেয় ফরাসি জাতীয়তাবাদের আভরণে। জেনোফোবিয়ায় (xenophobia) আক্রান্ত ফরাসি সমাজের এই অভিবাসী বিরোধী মনোভাব দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্রজন্মের বংশধরদের মাঝেও হতাশা ছড়ায়, তাদেরকে সামাজিক অস্থিরতার মুখোমুখি করে, ও অস্থির সময়ের দিকে ধাবিত করে। ওরা প্রতিবাদ মুখর হয়।
প্রতিবাদ তো সবসময় মৌন মিছিলে সীমাবদ্ধ থাকে না।
তাই অস্থিরতা, বৈষম্য, বঞ্চনা, ক্ষোভ, ও ক্ষোভের আগুনে আলু পোড়া দেয় ফ্রান্সের বাম রাজনৈতিক গোষ্ঠী। আগুন নাড়াচাড়া দিতে দিতে অভিবাসীরা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ভাবে, আমরা কখনো 'ওরা' হতে পারবো না। ডানপন্থীরা প্রতিবাদের এই লেলিহান শিখা ফু দিয়ে নিভিয়ে দেওয়ার আত্মবিশ্বাসে জোর প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়, ওদের কখনো 'আমরা' হতে দেবো না।
সাম্প্রতিক
পুলিশ অফিসারের গুলিতে নিহত নাহেলের পরিবারকে সাহায্যের আবেদনে গত বুধবার সকাল পর্যন্ত ৪৫০,০০০ ডলার জমা হয়েছে। দান করেছেন ২১,০০০ মানুষ। হত্যাকারী পুলিশটির জন্যও আলাদা একটি আবেদনে সাড়া দিয়েছেন ৮৫,০০০ মানুষ। উঠেছে ১.৭ মিলিয়ন ডলার। এটাই আজকের ফ্রান্স।
Coco Chanel, Louis Vuitton, Hermès, Dior ও ৭৩ জন নোবেলজয়ীর দেশই শুধু না, নেপোলিয়ন বোনাপার্তে নামের একজন বর্ণবাদী বীরেরও দেশ ফ্রান্স।
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই জুলাই, ২০২৩ সন্ধ্যা ৬:৪৫