“মাঝে মাঝে আমি একটা স্বপ্ন দেখি। পৃথিবীটা একদল কালো পোশাক পরা মানুষ দখল করে নিয়েছে। এরা হঠাৎ কোত্থেকে এসে পৃথিবী দখল করে নিল। সব জানোয়ার শাসকগুলোকে কুচিকুচি করে কেটে ফেলল। পৃথিবীর প্রত্যেক মানুষকে নামের বদলে একটা করে নম্বর দেওয়া হল। কেউ একটা অপরাধ করলেই এরা এসে তাকে মেরে ফেলে। এই রবোট মানুষ সমাজে কোন জরা নাই, সুখ কিংবা অসুখ নাই, মোহ নাই, আকাংখা নাই, শব্দ নাই, ভালোবাসা নাই।“
গত কয়েকদিন ধরে আমি একটা গল্প লেখার চেষ্টা করছি। গল্পটা এরকম একটা ছেলে ময়মনসিংহ থেকে ঢাকা শহরে আসবে। শেষবারের মত। কারণ ওর ফ্লাইট ঠিক হয়ে আছে। সামনের শুক্রবার এয়ার এমিরেটস এর যে ফ্লাইটটা ঢাকা ছাড়বে সেটাতে করে ওর মিডেল ইস্টে চলে যাওয়ার কথা – কুয়েত, এই দেশে অনেক টাকা পয়সা। এই গল্পে প্রেম আছে, অসহায়ত্ব আছে, অসুস্থ মা আছেন আর আছে মৃত্যু। গল্পের শেষে ছেলেটা মারা যাবে। রোড অ্যাক্সীডেন্ট।
খুব করুন একটা গল্প হইতে পারত, তাই না!
আমি গল্পটা লিখতে পারি নাই। আমি করুণ গল্প লিখতে পারি না। কারণ ঐ মানুষটির স্থলে আমি নিজেকে কল্পনা করে ফেলি আর ভয়ে শিউরে উঠি। এটা করুন গল্প না। এটা একটা ভয়ংকর সত্য গল্প। এটা একটা ভয়ংকর ভয়ংকর সত্য গল্প। “সত্য” আমাদের এসি রুমে সময় কাটানো শাসকবর্গের কাছে, প্রধান মন্ত্রী এবং তার পারিষদ মন্ডলীর কাছে ছোট বড় পাতি মাঝারি উঠতি নেতাদের কাছে গল্পের মতই লাগে। তিক্ত স্বাদ যুক্ত এই গল্পটি তারা খুব দ্রুত মিথ্যার মুড়ক কাগজে লুকিয়ে ফেলেন।
--বাংলাদেশ বিশেষ করে ঢাকায় এখন অনেক উচুঁ উচুঁ দালান কোঠা, ফ্ল্যাট বাড়ী, শপিং মল, খাবারের রেস্তোরা যেখানে দেশি বিদেশি সুস্বাদু সব ডিশ মেলে, অবশ্যই উপযুক্ত মূল্যের বিনিময়ে – নাম না জানা আরো কত কি করার জায়গা। সুবেশ তরুণের দলের সাথে সুবক্ষা নারীরা আনন্দের উপকরণ সহযোগে মেতে উঠে সাময়িক বিনোদনে এই কৃত্তিম স্বর্গোদ্ব্যানে।
-- এরা বাংলাদেশ নামক তৃতীয় বিশ্বের হতদরিদ্র একটি রাষ্ট্রে যে শংকর চেহারার মানুষ গুলি বাস করে তাদের একটি অতি ক্ষুদ্র অংশ। আমার বোধ হওয়ার পর থেকে আমি নিজেকে এই কথাটা বারবার বলি। জানি না আরো কতদিন বলতে হবে। আমি তখন ক্লাস ওয়ানে পড়ি। ছোট’পা পড়ে ক্লাস ফাইভে। ও সেবার কোন এক প্রতিযোগীতায় মুহম্মদ জাফর ইকবাল স্যারের লেখা “দুষ্ট ছেলের দল” বইটা পুরস্কার পেল। আমার পড়া উনার প্রথম উপন্যাস এইটা। তখন অবশ্য ত কিছু বুঝতাম না। আমি অনেক দিন পর্যন্ত বুঝি নাই উনি কেন বলছেন যে গরিব হওয়ার মাঝে লজ্জার কিছু নি। এই পৃথিবীটা গরীব মানুষ দিয়ে ভর্তি। এই গ্রহের শতকরা ৮০ ভাগ সম্পদ মাত্র ২ পার্সেন্ট মানুষের কব্জায়।
“এই ভোগে উন্মত্ত নরনারীর দলকে দোষ দেই না। এরা নির্বোধ। সরকারকেও দোষ দেই না। জোকের কাজ শোষন করা। এটা তার জেনেটিক কোডে লেখা আছে। আমি দোষ দেই নিজেকে। সবস্ময় সব কিছু পাওয়া যায় না, কিন্তু যেটা প্রয়োজন সেটাতো পাওয়া উচিত। আমার দোষ আমার পিঠ দেয়ালে ঠেকে যাওয়ার পরেও আমি এই জোঁকটার মুখে লবণ দিতে পারি নাই।“
তাই আপনি যখন আজকে সারাদিন কাজের পর আরাম করে টিভি কিংবা কম্পিউটার সেটটার সামনে বসবেন, “ভালোবাসা পাই...” নামক কিছু অর্থহীন নাটক বা সিনেমায় বূঁদ হয়ে কিছুক্ষন পর ঘুমে তলিয়ে যাবেন আমি তখন মুখ ভর্তি বমি করব প্রক্ষালন কক্ষে গিয়ে। আমার মনে হতে থাকে যে ভয়ংকর স্বপ্নটা আমি দেখি সেটা খুব শীঘ্রই রিয়েলেটিতে পরিনত হবে। আমার পেটে ভাত নাই। শরীরে কাপড় নাই। মগজে যথেষ্ঠ শিক্ষা নাই। আমি এই দাসবৃত্তি হইতে মুক্তি চাই। আমি ঐ শব্দ-ভালোবাসাহীন পৃথিবীর রবোট নাগরিক হইতে চাই না।
----------------------------------------