"স্যার, ভাইরাস কাকে বলে?", অনলাইন ক্লাস চলাকালীন প্রশ্ন করে রাতুল।
"ভাইরাস হচ্ছে এক প্রকার অণুজীব। যারা একই সাথে জীব এবং জড় উভয়ের বৈশিষ্ট্য ধারণ করে। যতক্ষণ পর্যন্ত এরা পোষক দেহে প্রবেশ করে না, ততক্ষণ জড় পদার্থের মত থাকে। পোষক দেহে প্রবেশের পরই এরা জীবের বৈশিষ্ট্য প্রকাশ করে।", দীর্ঘদিন পড়ানোর সুবাদে মুখস্থ হয়ে যাওয়া উত্তরটা দ্রুততার সাথে বলে যান আবেদ আলী।
"পোষক দেহ কী স্যার?", আবারো প্রশ্ন করে রাতুল।
"পোষক দেহ হচ্ছে এমন একটা স্থান যেখানে অণুজীব তার জীবনের বৈশিষ্ট্য প্রকাশ করতে পারে। বংশবৃদ্ধি করতে পারে। যেমন: আমাদের শরীরে যে ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়াগুলো বাস করে আমরা হচ্ছি সেগুলোর পোষক দেহ।", উত্তর শেষ করে এক গ্লাস পানি খেয়ে নিলেন আবেদ আলী।
"করোনা ভাইরাস কি সব ভাইরাসের মধ্যে শক্তিশালী? এইটা কি বস টাইপের কিছু নাকি, স্যার?", এবারে প্রশ্ন করে মারুফ।
"বস বা শক্তিশালী এরকম কিছুই না। বলতে পারো এটা একটু ভিন্নরকম। এই ভাইরাসটা প্রতি মুহুর্তে নিজেকে বদলে ফেলে, অনেকটা গিরগিটির মত। ধরো এখন তুমি একে দেখলে লাল রঙের, খানিক বাদেই দেখবে এটা হলুদ! আর সেজন্যই এর প্রতিষেধক তৈরিতে এত জটিলতা।"
খানিক বাদে অনলাইন ক্লাস শেষ হয়। আজকের পড়ানো বিষয়গুলো নিয়ে ভাবতে থাকেন আবেদ আলী। তিঁনি করমচাঁদপুর হাইস্কুলে দীর্ঘদিন ধরে বিজ্ঞান পড়ান। এর আগেও বহুবার ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া নিয়ে আলোচনা করেছেন, বিভিন্ন উদাহরণ দিয়ে শিক্ষার্থীদের বুঝিয়েছেন। তবে আজকের আলোচনাটা তার মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকে। একই সাথে জীব ও জড় এই বিষয়টা মাথার ভেতরে সংরক্ষিত অন্য এক তথ্যের সাথে একীভূত হয়ে যাচ্ছে। আচ্ছা, এমন কি সম্ভব যে একজন ব্যক্তি একই সাথে মানুষ এবং অমানুষ? অদ্ভুত প্রশ্ন, নিজের ভাবনায় নিজেই অবাক হয়ে যান তিনি! তবে কিছুক্ষণ পর জুতসই কিছু উদাহরণ ও খুঁজে পান।
গত নির্বাচনের সময় তার এলাকার এম্পি প্রার্থী হোসেন শাহ জনগনের সেবায় নিজেকে একদম বিলিয়ে দিয়েছিলেন। দিনরাত এই এলাকায় রাস্তা মেরামত তো ওই এলাকায় নলকূপ বসানো এরকম নানা কাজে ব্যস্ত ছিলেন। বিভিন্ন সভা সমাবেশ এ নানা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। এমনকি করমচাঁদপুর স্কুলের একটা ভবন নির্মাণের প্রতিশ্রুতিও দিয়ে যান। কিন্তু নির্বাচনের পর তিঁনি যেন আমূল বদলে গেলেন! আবেদ আলী গিয়েছিলেন তাঁর কাছে, স্কুলের বেতন-ভাতা সংক্রান্ত একটা ঝামেলা নিরোধের জন্য। অনেকক্ষণ ইনিয়ে বিনিয়ে বলার পর শেষমেশ খোলাখুলি ভাবেই তাঁর কাছে ঘুষ চেয়ে বসেন হোসেন শাহ। বিষ্ময়ে হতবাক হয়ে যান তিঁনি। নির্বাচনের আগে তাঁর যে দাতাকর্ণ রূপ দেখেছিলেন তা কোথায় গেল? হাতেম তাই হবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে শেষে কিনা নির্লজ্জের মত ঘুষ চেয়ে বসলেন!
এলাকার চেয়ারম্যান-মেম্বারের কথাও মাথায় আসে তাঁর। এলাকার মেম্বার রসু খা। নির্বাচনের আগে তাঁর বাড়িতে এসে পা ধরে সালাম করে বলেছিলো,"চাচা আপনাগো খেদমতের জন্যই নির্বাচন করতাছি। মেম্বার হওয়ার কোন লোভ আমার নাই। আপনাগোর জন্য কিছু করতে পারলেই আমি স্বার্থক।" তার কথা শুনে চোখে পানি এসেছিলো আবেদ আলীর। মনে হয়েছিলো তাঁর চোখের সামনে দাঁড়ানো এই লোকটি মানুষের রূপে যেন এক ফেরেশতা। কিন্তু কদিন আগে করোনার জন্য সরকারের তরফ থেকে আসা ত্রাণ আনতে গিয়ে তাঁর ভুল ভাঙে। ইউনিয়ন পরিষদের সামনে জমা হয়ে ছিলো কয়েক শত মানুষ, অধিকাংশই কর্মহীন, ক্ষুধায় জর্জরিত। তাদের হাতে ৫ কেজি চালের একটা ব্যাগ তুলে দিচ্ছিলো রসু খা'র কর্মীরা। এ অবধি ঠিকই ছিলো। কিন্তু ঘন্টাদুয়েক পর তিঁনি দেখলেন, ৫০ কেজির ১০টা চালের বস্তা একটা যন্ত্রচালিত ভ্যানে উঠিয়ে বাড়ির পথে রওনা দিয়েছে রসু খা। আবেদ আলী অবাক চোখে দেখেন, খেদমত করার এক বিরল দৃশ্য!
চেয়ারম্যান সাহেব তো নির্বাচনের আগে তাঁকে বাবা বলেই সম্বোধন করেছিলেন! "আমার বাবা নাই। মাস্টার সাব, আপনেই আমার বাবা। হ, শিক্ষক তো বাবার মতই। পোলার জন্য দোয়া কইরেন, নির্বাচনে যেন জিততে পারি। নিজের জন্য আমি ভাবিনা, আল্লাহয় আমারে অনেক দিছে। এইবার আপনাগোর সব চাহিদা পূরণ করমু ইনশাল্লাহ।" দোয়া তিঁনি করেছিলেন, আরশাদ ব্যাপারী চেয়ারম্যান ও হয়েছেন, শুধু চাহিদাগুলোই অপূর্ণ রয়ে গেছে। ত্রাণ নিয়ে জালিয়াতি কান্ডের কথা চেয়ারম্যানকে জানাতে গিয়েছিলেন তিঁনি। সব শুনে চেয়ারম্যান বললেন,"চাচা, আপনার ঘরে চাউল আছে না? না থাকলে আমারে কন, আপনার নাম কয়েকটা লিস্টে ঢুকাইয়া দিমু। কিন্তু কে কয় বস্তা চাউল ঘরে নেয় হেইডা দিয়া আপনার কাম কী? আদার ব্যাপারী হইয়া জাহাজের খবর লইতে যাইয়েন না। বুড়া বয়সে ফাও একটা বিপদে পড়বেন।" উত্তর শুনে তাঁর বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, তলে তলে মেম্বার-চেয়ারম্যান সব এক নায়েরই মাঝি।
আবেদ আলী ভাবেন, এদের সাথে ভাইরাসের একটা সাদৃশ্য আছে। ভাইরাস যেমন একই সাথে জড় এবং জীব, এরাও তেমনি একই সাথে মানুষ এবং অমানুষ। যতদিন অবধি এরা ক্ষমতার বাইরে থাকে ততদিন মানুষের বৈশিষ্ট্য প্রকাশ করে, ক্ষমতা হাতে পেলেই হয়ে যায় অমানুষ। করোনা ভাইরাস এদের অনেকের চেহারা লোকচক্ষুর সম্মুখে উন্মোচিত করেছে। করোনা নিজেও জানে তার সাথে এদের এক দারুণ মিল রয়েছে। সে যেমন মুহূর্তে রঙ বদলায়, এই মেম্বার-চেয়ারম্যান, এম্পি-মন্ত্রীরাও তেমনি ক্ষণে ক্ষণে রঙ বদলায়।
ভাঙাচোরা ল্যাপটপের সামনে বসে পড়েন আবেদ আলী। মানুষরূপী ভাইরাসের গল্প লিখতে থাকেন কাঁপা হাতে। এরপর থেকে ক্লাসে যখন ভাইরাসের চ্যাপ্টার পড়াবেন, এই উদাহরণগুলো দিয়ে বুঝাবেন সবাইকে।
বিনিয়ামীন পিয়াস
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই আগস্ট, ২০২০ রাত ৮:৪১