somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

এক রান-আউটেই ইতিহাস

০৫ ই জানুয়ারি, ২০১৪ সন্ধ্যা ৬:৫০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

প্রকৃতি অনেক সময়ই বড্ড খেয়ালি হয়ে উঠে কারো কারো প্রতি। কখনও নিষ্ঠুর, কখনও কৌতুকপ্রিয়। তাইতো অর্থনীতি সংস্কারক একজন সফল রাষ্ট্রনায়ক হলেও মানুষ বিল ক্লিনটনকে বরং মনে রাখে মনিকা লিইউনস্কির সাথে, জিনেদিন জিদানের কথা মনে করলে প্রথমেই মনে করে মাতেরাজ্জিকে ঢুঁস মারার কথা, ব্রাডম্যানের হাজারো প্রাপ্তির ভিড়েও শেষ ইনিংসে ৪ রানের আফসোসটিই অনেক বড় মনে হয়, হ্যান্সি ক্রনিয়ের অবদান লোকে ভুলে যায় তার প্রতারণার কথা মনে করে।

ভেঙ্গে যাবার আগে অর্ধশতাব্দীরও বেশী সময় ধরে টিকে থাকা পঙ্কজ রায় এর সাথে করা ৪১৩ রানের রেকর্ড ওপেনিং জুটি, টেস্ট ক্রিকেটে এক থেকে দশ পর্যন্ত প্রতিটি পজিশনে ব্যাট করা মাত্র ৩ জন ক্রিকেটারের একজন, একই টেস্টে শতরান এবং পাঁচ উইকেট শিকার করা প্রথম ভারতীয়, অ-ইংরেজ হিসেবে লর্ডস এর ব্যাটিং এবং বোলিং উভয় অনার্স বোর্ডে নাম ওঠা ৩ জন খেলোয়াড়ের একজন, দুই ইনিংস মিলিয়ে ১২ উইকেট নিয়ে ভারতের প্রথম টেস্ট ম্যাচ জয়ে অসামান্য অবদান, সুনিল গাভাস্কার ভেঙ্গে দেবার আগ পর্যন্ত ২৭ বছর টিকে থাকা কোন ভারতীয় ব্যাটসমানের ২৩১ রানের ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ রানের রেকর্ড--এত এত সব চমকপ্রদ অর্জন। তাও বোধহয় যথেষ্ট ছিল না। বরাবরই নতুন কিছু করার প্রবণতা থেকেই হয়তো মুলবান্ত্রাই হিম্মতলাল মানকদ ওরফে ভিনু মানকড় করলেন নতুন কিছুই। আর এই একটা ”নতুন কিছু”ই বাকি সব অর্জনকে পাশ কাটিয়ে ভিনু মানকড়কে অমর করে দিলো ক্রিকেট বিশ্বে।

ক্রিকেট খেলার কোন গুরুত্বপূর্ণ মুহুর্তে দুই ব্যাটসম্যানই যখন রানের জন্য মরিয়া, বোলার বল করার আগেই ননস্ট্রাইকার ব্যাটসম্যান পপিং ক্রিজ ছেড়ে বেশ খানিকটা এগিয়ে থাকেন দৌড়ে ক্রিজ কভার করতে একটু সুবিধা পাবার আশায়। পাড়ার ক্রিকেটে হরহামেশাই দেখা যায় এমন দৃশ্য। বোলারও ঠিক ঠিক বল না করে সরাসরি স্ট্যাম্প ভেঙ্গে দিয়ে শুরু করেন রান আউটের জন্য আম্পায়ারের সাথে যুক্তি-তর্ক। ব্যাটিং দলও মানতে নারাজ। আমাদের দুই নেত্রীর মতো কোন দলই ছাড় দিতে রাজি না হওয়ায় সেদিনের মতো খেলাটিই পন্ড হয়ে যায়।

হরহামেশাই না ঘটলেও আন্তর্জাতিক ক্রিকেটেও ঘটে এমন ঘটনা। ১৯৪৭ সালের ১৩ ডিসেম্বর অস্ট্রেলিয়া-ভারত ম্যাচে ভিনু মানকাড় অস্ট্রেলিয়ান ওপেনার বিল ব্রাউনকে ওই ”পাড়ার ক্রিকেট” স্টাইলে আউট করে ব্যাপারটাকে আন্তর্জাতিকভাবে আলোচনায় নিয়ে আসেন। বিল ব্রাউনকেই মানকাড় একই ট্যুরে একটা গা-গরম করা ম্যাচেও একই ভাবে আউট করেছিলেন। অস্ট্রেলিয়ান মিডিয়াতে মানকাড়-এর এই ”অখেলোয়াড় সুলভ” আচরণের জন্য সমালোচনার ঝড় বয়ে যায়। এবং এই ঘটনার পর থেকে এই ধরনের আউটকে রান আউটের চেয়ে বরং বলা হয় ”মানকাদ আউট”। পরবর্তিতে আইসিসি এই মানকাদ আউটের প্রবণতা কমাতে আইন কিছুটা পরিবর্তন করলেও ক্রিকেট আইনের ৪২.১৫ ধারা অনুযায়ী মানকাদিং এখনও বৈধ আউট।

অনেক ক্রিকেট বোদ্ধাই একে অখেলোয়াড়সুলভ বললেও অনেকেই আবার এর পক্ষে সাফাই গেয়ে গেছেন। এদের মধ্যে আছেন স্বয়ং স্যার ডন ব্রাডম্যানও, যিনি ১৯৪৭ এর সেই টেস্টে অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়কও ছিলেন। তার মতে, কেন ভিনু মানকাড়-এর খেলোয়াড়ি মনোভাব নিয়ে গণমাধ্যম প্রশ্ন তোলে তিনি বুঝতে পারেন না। কেননা ক্রিকেট আইন স্পষ্ট করে বলেছে কোন বোলার বল ছাড়ার আগ পর্যন্ত ব্যাটসম্যানকে অবশ্যই ক্রিজে থাকতে হবে। যদি তা নাই হবে, কেন আইনে এমন আউটের সুযোগ রাখা হয়েছে? ক্রিজ থেকে বের হয়ে আগেই এগিয়ে থেকে ব্যাটসম্যান স্পষ্টতই একটা অন্যায্য সুবিধা নিচ্ছে।

ব্র্যাডম্যানের কথাতে উদ্বুদ্ধ হয়েই কিনা কে জানে, এর পরেও টেস্ট এবং সীমিত ওভারের খেলা মিলে মোট ৭ বার ঘটেছে এই মানকাদ আউট। এবং এই বিতর্কিত সুবিধা নিয়েছেন কপিল দেব, গ্রেগ চ্যাপেলের মতো খেলোয়াড়রা। তবে এর ব্যাতিক্রমও আছেন। ১৯৮৭র বিশ্বকাপে গ্রুপ পর্বের একটা গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে জয়ের জন্য পাকিস্তানের শেষ বলে এক রান প্রয়োজন ছিল। হাতেও ছিল ১টা মাত্র উইকেট। কোর্টনি ওয়ালস তার শেষ বলটি করতে এসে দেখেন ননস্ট্রাইকার ব্যাটসম্যান সেলিম জাফর ক্রিজ ছেড়ে অনেকটা দূর এগিয়ে গিয়েছেন। ওয়ালস জাফরকে আউট না করে বরং সাবধান করে দেন। পাকিস্তানও পররর্তিতে ১ রান নিয়ে জিতে যায় ম্যাচটা। শেষ পর্যন্ত এই জয়েই সেমিফাইনাল খেলে পাকিস্তান, আর দেশের প্লেন ধরে ওয়েস্ট ইন্ডিজ।

পাকিস্তানের ভাগ্যটাই বোধহয় এমন। ২০০৩ সালের মুলতান টেস্টে জয়ের একেবারে বন্দরে ভিরেও শেষ পর্যন্ত পরাজয় বরণ করতে বাংলাদেশকে। বিতর্কিত সেই টেস্টে ইনজামামের অসাধারণ পারফরম্যান্স, রশিদ লতিফ বা অশোকা ডি সিলভাদের ”পারফরম্যান্স”-এর পরও হয়তো জিতে যেতে পারতো বাংলাদেশ। মোহাম্মাদ রফিক সুযোগ পেয়েও উমর গুলকে মানকাদ না করে শুধু সাবধান করে দেন। শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ ম্যাচটি হেরে যায় ১ উইকেটে।

২০১২র কমনওয়েলথ ব্যাংক সিরিজে রবিচন্দ্রন আশ্বিন লাহিরু থিরিমান্নেকে মানকাদ আউট করেন। পরবর্তিতে শচিন টেন্ডুলকার এবং ভারপ্রাপ্ত অধিনায়ক বীরেন্দ্র সেহওয়াগ আলোচনা করে সেই আউট প্রত্যাহার করে নেন। ভারত ম্যচটি ৫১ রানে হেরে যায়।

এমন উদারতায় একটা ক্রিকেট টিম পরাজিত হলেও জয়ী হয় সামগ্রিক ক্রিকেট, জয়ী হন সংশ্লিষ্ট ক্রিকেটার, জয় হয় তার দেশ, দেশের মানুষ।
১২টি মন্তব্য ১২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

নিউ ইয়র্কের পথে.... ২

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০২


Almost at half distance, on flight CX830.

পূর্বের পর্ব এখানেঃ নিউ ইয়র্কের পথে.... ১

হংকং আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে প্লেন থেকে বোর্ডিং ব্রীজে নেমেই কানেক্টিং ফ্লাইট ধরার জন্য যাত্রীদের মাঝে নাভিশ্বাস উঠে গেল।... ...বাকিটুকু পড়ুন

সামুতে আপনার হিট কত?

লিখেছেন অপু তানভীর, ১৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০৩



প্রথমে মনে হল বর্তমান ব্লগাদের হিটের সংখ্যা নিয়ে একটা পোস্ট করা যাক । তারপর মনে পড়ল আমাদের ব্লগের পরিসংখ্যানবিদ ব্লগার আমি তুমি আমরা এমন পোস্ট আগেই দিয়ে দিয়েছেন ।... ...বাকিটুকু পড়ুন

ডেল্টা ফ্লাইট - নিউ ইয়র্ক টু ডেট্রয়ট

লিখেছেন ঢাকার লোক, ১৬ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:২৬

আজই শ্রদ্ধেয় খাইরুল আহসান ভাইয়ের "নিউ ইয়র্কের পথে" পড়তে পড়তে তেমনি এক বিমান যাত্রার কথা মনে পড়লো। সে প্রায় বছর দশ বার আগের ঘটনা। নিউ ইয়র্ক থেকে ডেট্রিয়ট যাবো,... ...বাকিটুকু পড়ুন

ল অব অ্যাট্রাকশন

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৬ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:৪৫

জ্যাক ক্যান ফিল্ডের ঘটনা দিয়ে লেখাটা শুরু করছি। জ্যাক ক্যানফিল্ড একজন আমেরিকান লেখক ও মোটিভেশনাল স্পিকার। জীবনের প্রথম দিকে তিনি হতাশ হয়ে পড়েছিলেন। আয় রোজগার ছিলনা। ব্যাংক অ্যাকাউন্টে অর্থ ছিলনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

নতুন গঙ্গা পানি চুক্তি- কখন হবে, গ্যারান্টি ক্লজহীন চুক্তি নবায়ন হবে কিংবা তিস্তার মোট ঝুলে যাবে?

লিখেছেন এক নিরুদ্দেশ পথিক, ১৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:২৬


১৬ মে ঐতিহাসিক ফারাক্কা দিবস। ফারাক্কা বাঁধ শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশে খরা ও মরুকরণ তীব্র করে, বর্ষায় হঠাৎ বন্যা তৈরি করে কৃষক ও পরিবেশের মরণফাঁদ হয়ে উঠেছে। পানি বঞ্চনা এবং... ...বাকিটুকু পড়ুন

×