somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

জাহাঙ্গীরনগরের খুরশিদা ম্যাডামের মৃত্যু এবং একজন বোরকা পরিহিতার ভাবনা

০৮ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ দুপুর ১২:০৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

হঠাৎ স্ট্রোক করে মারা গেলেন জাহাঙ্গীরনগর ইউনিভার্সিটির খুরশিদা ম্যাডাম। নিজে ঠিক মত বুঝেই উঠতে পারেননি, এত তাড়াতাড়ি মারা যাবেন বলে। নিধর দেহে পড়েছিলেন বিছানার মধ্যে। ছেলে-মেয়েরা সব কানছে, ডাক্তার নিয়ে এসেছে কাজের ছেলেটা। ডাক্তার নামের চ্যাংরা ছেলেটা কি বুঝলো কে জানে, পালস ধরল, বুকে স্টেথেসকোপ রাখলো, এরপর চোখ দেখে বলল: “না জীবনের কোন অস্তিত্ব নেই”। সাথে সাথে কান্নার মাত্রা কয়েকগুন বাড়িয়ে দিলে ছেলে মেয়েরা। নিধর দেহেই সবই দেখছিলেন ম্যাডাম। অবাক! চোখ বন্ধ, কিন্তু সবকিছু কি স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে!!

এই ছেলে!! বেয়াদব কোথাকার! এটা কেন করছ! আমার মাথার নিচ থেকে টান মেরে বালিশটা সরালে কেন? খুরশিদা ম্যাডাম অনেক চেষ্টা করলেন, কিন্তু শতচেষ্টা করেও মুখ দিয়ে একটা শব্দও বের করতে পারলেন না। আহারে! বেঁচে থাকতে কত দাপটের সাথেই না ক্লাস করাতাম, ছাত্র-ছাত্রীদের ধমকের উপর রাখতাম, কিন্তু আজকে আমি স্তব্ধ। আমার কোন কথাই কেউ শুনছে না। নিজের মৃত্যুর কথা চিন্তা না করে নিজের নিথরতার কথা ভেবেই কেদে উঠলেন ম্যাডাম। চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ল একটা ফোটা পানি। ডাক্তার ছেলেটার অবশ্য দৃষ্টি এড়াইনি সেটা। ডাক্তার বলল: “লাশের অবস্থা ভালো না, পচন ধরতে বেশি সময় লাগবে না মনে হচ্ছে, তাড়াতাড়ি দাফন-কাফনের ব্যবস্থা করেন”। ম্যাডাম এতক্ষণে নিশ্চিত হলেন যে, তিনি মারা গেছেন, তাই আত্মীয় স্বজনদের সার্বিক কার্যক্রম বিনা শাসনে প্রত্যক্ষ করতে লাগলেন।

ডাক্তারের শেষ বক্তব্যের পর সবাই মায়ের জন্য শোক করার চেয়ে মাকে তাড়াতাড়ি মাটির নিচে রাখার ব্যাপারেই বেশি আগ্রহী বলে মনে হলো। ছোট ছেলেটা দ্রুত বাইরে বেরিয়ে গেলো। কিছ্ক্ষুণপর কোথা থেকে যেন দুইটা বোরকা পরা মহিলা নিয়ে আসল। বোরকা পড়া মেয়ে অবশ্য জীবিত থাকতে সহ্য করতে পারতেন না ম্যাডাম। আগে দেখলে হয়ত বলতেন “বেটা! আর লোক পাওনি, দুইটা জ্যন্ত বোরকাওয়ালী জঙ্গি-মৌলবাদী ধরে নিয়ে এসেছো, আমি এমনি কোটরের মুরগী (বোরকা পরিহিতা) প্রাণীগুলোকে দু’চোক্ষে দেখতে পারি না, তাদেরকেই আমার ঘরে নিয়ে এসেছো! ছিঃ। ” কিন্তু আজকে সেরকম কোন ভাবনা উদয় হচ্ছে না ম্যাডামের মনে।

বোরকা পরিহিতা একজন বলে উঠল: “একটা হাড়িতে পানি গরম করেন তো। বেজোড় সংখ্যক বড়ই পাতা দিয়েন, আর বাড়ির নিচে লাশ নিয়ে যান, খাটিয়ার উপর সোজা করে রাখবেন।”
কথা শেষ হতেই খাটের চাদরটা চারপার্শ্বে ধরে চারজন পুরুষ ম্যাডামকে তুলে নিলো এবং সিড়ি দিয়ে নামতে থাকলো, ম্যাডাম মনে মনে ভাবতে থাকলেন, “আহারে! আর কখনো সিড়ি দিয়ে উপরে উঠতে পারব না, এই নামাই শেষ নামা”
ম্যাডামকে রাখা হলো গোছলের খাটিয়ার উপর। চারপাশ চাদর দিয়ে মোড়ানো। বোরকাপরিহিতা একজন বলে উঠল: “হ্যা এবার পর্দা হয়েছে, এবার সব পুরুষরা বের হয়ে যান।”
‘পর্দা’ শব্দটা শুনতেই ম্যাডামের পূর্বে স্মৃতি মনে পড়ে গেলো। তিনি সব সময় মেয়েদের বলতেন: “পর্দা করতে চাদর লাগবে কেন?? কাপড়ে নয়, মনের পর্দাই বড় পর্দা।”

এখন চারপাশ চাদরে ঘেরা যায়গাটুকুতে শুধু শায়িত ম্যাডাম আর চারজন মহিলা। ধিরে ধিরে ম্যাডামের শরীরে পানি ঢালা শুরু হলো। সাবান দিয়ে পরিস্কার করা হচ্ছে শরীরের বিভিন্ন স্থান। এর মধ্যে ম্যাডাম শুনতে পাচ্ছেন এক মহিলা বলছেন, “দেখছেন নাকি নাক দিয়ে কিভাবে রক্ত বের হচ্ছে, আর নিচের ময়লাও থামছে না” আরেকজন বলে উঠল: “মাথার রগ ছিড়ে মারা গেছেন কিনা, এই জন্য নাক দিয়ে রক্ত আসছে”। বয়স্ক মত একজন বলে উঠল, “তোরা এগুলো বুঝবি না, আমি অনেক মেয়েছেলেরে গোছল করাইছি, যেইগুলান মাথায় কাপড় না দিয়ে ব্যাটাগো মতো ঘুরে ওইগুলান মরার পর নিচের ময়লা থামে না, কাফনের কাপড় বাদ কইরা দেয়।”

কাফন পড়ানোর সময় আবারো পূর্বের স্মৃতিতে ডুবে গেলেন ম্যাডাম। কারণ স্মৃতি আওরানো ছাড়া অন্য কোন কাজ নেই তার। ম্যাডামের মলে হলো “ জীবিত থাকতে ডিজাইন ব্যাতিত সম্পূর্ণ সাদা কাপড়ে সংস্কৃতি খুজে পেতেন না তিনি, সাংস্কৃতির রাজধানী জাহাঙ্গীরনগরে থাকাতে এ অভ্যাসটা হয়েছিল তার।

৪টা বিশাল কাপড় নিয়ে এসেছে মহিলাগুলো। বয়স্ক মহিলাটা ছোটদের ক্লাস নেয়ার মত বুঝাচ্ছে “এইটা হইলো জামা, এইটা হইল ইযার, এইটা হইলো চাদর, এটাইটা হইলো ছেরবন্দ, এইটা হইলো সিনাবন্দ ।”
ম্যাডামও মনোযোগ সহকারে শুনছেন কথাবার্তাগুলো। মেয়েরা ক্লাসে বেশি কাপড় পড়ে আসলে বকা দিতেন সব সময়।
সেখানে আজকে ম্যাডামকেই এতকিছু পড়ানো হচ্ছে দেখে অবাক হচ্ছেন তিনি।
বিশেষ করে তসলিমা নাসরিনকে আদর্শ ভেবে কখন বুকে কাপড় দেয়াকে সমর্থন করেনি তিনি, কিন্তু আজকে বক্ষ অংশ আলাদা কাপড় দিয়ে মোড়ানো হচ্ছে, মাথায় হিজাব পড়লে মেয়েদের ক্লাস থেকে বের করেদিতেন তিনি, বলতেন “যারা হিজাব পড়ে তাদের মস্তিষ্ক অবরুদ্ধ, অন্তঃসারশূন্য”, কিন্তু আজকে তার ম্যাডামের চুল আদালা কাপড় দিয়ে মুড়ানো হচ্ছে। বোরকা পড়াকে তীব্র ঘৃণা করতেন তিনি, বলতেন: “যারা হিজাব পড়ে এসেছে তাদের ক্লাস ঢুকতে দেয়া হবে না, এটা আমার ক্লাস, এখানে শুধুই আমার কর্তৃত্ব ”। কিন্তু আজ কোন কর্তৃত্বই পাচ্ছেনা ম্যাডাম, এক হিসেবে জোর করেই সারা শরীর কাপড় দিয়ে মোড়ানো হচ্ছে তার।

এর মধ্যে কম বয়স্ক এক মহিলা বলে উঠল: “আচ্ছা কবরের ভিতর তো পোলা মানুষ যাইবো না, তাইলে এত পর্দা লাগে কেন? তখন বয়স্ক মহিলাটা উত্তর দিলো: “আরে এইটাই হইলো আল্লাহর নিয়ম। এইটাই করতে হইবো। যুবতী মাইয়াগো বুঝা উচিত, কবরে নামানোর আগে যদি এত পর্দা কত্তে হয়, তয় মাটির উপরে পুরুষ চক্ষুর সামনে কতটুকু পর্দা করতে হইবো? ”

খুরশিদা ম্যাডাম আজ অবাক!! উনার সব ছেলে আজ টুপি পড়েছে। কোথা থেকে টুপি পেলো তারা?? তিনি টুপি পড়তে বলেননি কখন ছেলেদের। সবাই কাধে করে ম্যাডামকে কোথায় যেন নিয়ে যাচ্ছে, আর একটা উচ্চস্বরে আরবী পড়ছে। আরবী শুনে ছোট বেলায় আরবী পড়ার কথা মনে গেলো ম্যাডামের। কতকিছুই না বাবা-মা কষ্ট করে শিখিয়েছিল, কিন্তু বড় হয়ে ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়ে আধুনিকতার হাওয়ায় একদম জোর করে সব ভুলে গিয়েছেন। কখন চেষ্টাও করেন নি তা শিখতে।

ম্যাডাম কে নিয়ে আসা হয়েছে জাহাঙ্গীরনগর ক্যাম্পসের কেন্দ্রীয় মসজিদে। ম্যাডাম সব স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছেন। একটা হুজুর এসেছে, সবাইকে কিভাবে জানাজা পড়তে হবে তা বলে দিচ্ছে। এরই মাঝে খুরশিদা ম্যাডামের আরেকটা স্মৃতি মনে পড়ে গেলো। মনে পড়ে গেলো, সেলিম ভাইয়ের কথা (সেলিম আল দীন)। তিনিও ধর্ম-কর্ম পছন্দ করতেন না, পছন্দ করতেন না হুজুরদেরকে। তারপরও এ হুজুরা স্যারের জন্য মোনজাত করেছিল। এটা দেখে ঐ সময় দুঃখের মধ্যেই হেসে ফেলেছিলেন তিনি।

জানাজা শেষ। সব ছাত্র-ছাত্রীরা একে একে ম্যাডামের লাশের উপর ফুল দিয়ে যাচ্ছে। এ ফুল দেয়াকে সবাই একটা বিশাল কার্য বলে মনে করলেও ম্যাডামের কাছে এগুলো নিতান্তই অপ্রয়োজনীয় এবং লোক দেখানো বলে মনে হচ্ছে। সবাই সারি ধরে ধরে আসছে। এরই মধ্যে দুটি মেয়ে আসলো। মেয়েগুলোর হাতে কোন ফুল নেই। মেয়েগুলোকে দেখেই চিনে ফেলেছেন তিনি, এই তো সে মেয়ে, যাদেরকে তিনি বোরকা পড়ার কারণে ক্লাস থেকে বের করে দিয়েছিলেন। কিন্তু একি মেয়েগুলো আমাকে দেখে হাসতে কেন?? ওরা বোরকা ভেতর হাসছে, তাচ্ছিল্যের হাসি। কেউ দেখতে পারছে না কিন্তু আমি তো দেখতে পারছি। আরে ওরা মনে মনে কি চিন্তা করছে তাও আমি বুঝতে পারছি। ওরা বলছে, “জীবিত থাকতে তো পর্দার বিরোধীতা করতেন, এখন এত পর্দা করেছেন কেন, সব খুলে ফেলুন।”

“না ! না! আমি কাফন খুলবো না! আমি কাফন খুলবো না! এ কাফন আমার দরকার!! এটাই নিয়ম!! এটাই আল্লাহ’র বিধান! এটা ছাড়া আমি থাকতে পারব না, এটা ছাড়া আমি কররে নামতে পারব না!! নামব না!! নামব না!! আমি যা করেছি ভুল করেছি!! আমি যা করেছি ভুল করেছি!! আমাকে ক্ষমা করো আল্লাহ!! আমাকে ক্ষমা করো আল্লাহ!!

কিন্তু কোন কথাই আজ বলতে পারছেন না খুরশিদা ম্যাডাম। শতে চেষ্টা করেও না। তিনি নিজেও জানেন কোন লাভ নেই এতে। তার সব কথা বলার সামর্থ শেষ, শেষ হয়ে গেছে ক্ষমা চওয়ার সামর্থও, কারণ তার মৃত্যুর সাথে সাথে সব বন্ধ হয়ে গেছে। (খবর সূত্র: Click This Link)
৬টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মামুনুলের মুক্তির খবরে কাল বৃষ্টি নেমেছিল

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ৯:৪৯


হেফাজত নেতা মামুনুল হক কারামুক্ত হওয়ায় তার অনুসারীদের মধ্যে খুশির জোয়ার বয়ে যাচ্ছে। কেউ কেউ তো বলল, তার মুক্তির খবরে কাল রাতে বৃষ্টি নেমেছিল। কিন্তু পিছিয়ে যাওয়ায় আজ গাজীপুরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

'চুরি তো চুরি, আবার সিনাজুরি'

লিখেছেন এমজেডএফ, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৮


নীলসাধুকে চকলেট বিতরণের দায়িত্ব দিয়ে প্রবাসী ব্লগার সোহানীর যে তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছিল তা বিলম্বে হলেও আমরা জেনেছি। যাদেরকে চকলেট দেওয়ার কথা ছিল তাদের একজনকেও তিনি চকলেট দেননি। এমতাবস্থায় প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বরাবর ব্লগ কর্তৃপক্ষ

লিখেছেন নীলসাধু, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১১:২২

আমি ব্লগে নিয়মিত নই।
মাঝে মাঝে আসি। নিজের লেখা পোষ্ট করি আবার চলে যাই।
মাঝেমাঝে সহ ব্লগারদের পোষ্টে মন্তব্য করি
তাদের লেখা পড়ি।
এই ব্লগের কয়েকজন ব্লগার নিজ নিক ও ফেইক... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ অপেক্ষা

লিখেছেন রানার ব্লগ, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১১:২৩



গরমের সময় ক্লাশ গুলো বেশ লম্বা মনে হয়, তার উপর সানোয়ার স্যারের ক্লাশ এমনিতেই লম্বা হয় । তার একটা মুদ্রা দোষ আছে প্যারা প্রতি একটা শব্দ তিনি করেন, ব্যাস... ...বাকিটুকু পড়ুন

মসজিদে মসজিদে মোল্লা,ও কমিটি নতুন আইনে চালাচ্ছে সমাজ.

লিখেছেন এম ডি মুসা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সকাল ১০:২৩

গত সপ্তাহে ভোলার জাহানপুর ইউনিয়নের চরফ্যাশন ওমরাবাজ গ্রামের এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। লোকটি নিয়মিত মসজিদে যেত না, মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়েনি, জানা গেল সে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসী ছিল, স্বীকারোক্তিতে সে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×