somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

==== স্মরণীয় ঈদ====

২২ শে জুলাই, ২০১৪ সকাল ১০:২৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ছোট বেলার ঈদ বলতে গেলেই যা সবার আগে মনে পড়ে তা হল গ্রামের বাড়িতে গিয়ে ঈদ উৎযাপন করা আর ঈদের অন্য আরেকটা আনন্দ ছিল আম্মুর সাথে মার্কেট ঘুরে ঘুরে নিজের পছন্দের জামাটা কেনা।আমার মাঝে মাঝে মনে হত আমার আম্মুর ঈদ মানে সবার জন্য কেনাকাটা করা।আম্মু সবার জন্য দাদা দাদু চাচা চাচি আমার ছোট ছোট কাজিন সবার জন্য কিনতেন।পরিবারে ভাইবোন সবার মধ্যে আমার বাজেট আলাদা আমার মনে আছে ছোট বেলায় যত ঈদ পার করেছি সব ঈদে আমি আমার পছন্দের জামা পেয়েছি বাকিরা পছন্দের টা পাক আর না পাক আমি পেয়েছি। মার্কেটে গিয়ে আমার একবার যে ড্রেস পছন্দ সেটা যেমন দামের হোক আমাকে দিয়ে আর কিছুই পছন্দ করানো যেত না অগত্যা মা আমার পছন্দেরটাই কিনে দিত। আমি খুশি আমাকে খুশি দেখে আমার মাও খুশি।


তখন দাদা দাদু নানা নানু সবাই বেঁচে ছিলেন আজ তারা কেউ নেই,তাদের কথা পড়লে এখন ও চোখ ছল ছল করে বুকের মধ্যে গরম বাতাস বয়ে যায়। আমি এদের কাছে অপরিসীম আদর পেয়ে বড় হয়েছি।আমি অনেক ভাগ্যবান একটা মানুষ,চারপাশের আত্বীয় পরিজন সবার খুব আদরের ছিলাম নিজেকে সবসময় স্পেশাল ফিল হইত। এখনো মাঝে মাঝে দাদা দাদু নানা নানু স্বপ্নে আসে একেবারে জীবন্ত হয়ে ধরা দেয়। ঈদে আমরা দাদু বাড়িই যেতাম সবসময় শুধু আমি একবার নানু বাড়িতে ছিলাম বড় মামার কাধে চড়ে ঈদগা গিয়েছিলাম(স্বপ্নের মত লাগে চোখ বুজলেই মনে হয় এইত সেদিন)।গোসল করে নতুন জামা পড়ার পর মামি কি সুন্দর কাজল লাগিয়ে সাজিয়ে দিয়েছিল। যাইহোক তারপর ঈদের দুইদিন পর আমরা নানু বাড়ি আসতাম যদিও নানু বাড়ি আর দাদু বাড়ির দূরত্ব খুব বেশি নয়।ঈদের আরেক মজা ছিল আমরা রাতের ট্রেনে করে বাড়ি যেতাম খুব ভোরে স্টেশন থেকে নেমে যেহেতু স্টেশনের কাছে ই নানু বাড়ি ছিল তাই খুব ভোরে নানু বাড়ি উঠতাম। ওই সময়টা আমার কেন জানি খুব ভালো লাগত ভোর হচ্ছে একটু একটু করে আলোর দেখা মিলছে চারপাশে ভোরের পাখিরা ডাকছে।ভোরের পাখিরা কি এখন ডাকেনা ??নাকি আমিই শুনিনা, মনে হয় যেখানে যান্ত্রিকতার ছোঁয়া লাগে ভোরের পাখিরা সেখান থেকে পালিয়ে যায়। রিকশায় চড়ে যখন নানু বাড়ি উঠতাম,সবাই ঘুম থেকে উঠে ঘুম ঘুম চোখে আমাদের রিসিভ করত।তারপর একটু বিশ্রাম শেষে বিকেলে দাদু বাড়ি।দাদা দাদু অপেক্ষা করত কখন আমরা যাব। ছোট বেলা থেকে আমার সবগুলো ঈদ ই এক একটা ধামাকা কত মজা কত স্মৃতি জমা পড়ে আছে বলে শেষ করা কষ্ট সাধ্য ব্যাপা্র।দাদাজানের একটা হাসি এখনো আমার মনের ফ্রেমে এখন গেঁথে আছে। আমরা যাবো দাদাজান আমাদের জন্য বড়শি দিয়ে মাছ ধরছেন এই কাজ তিনি প্রায় ই করতেন।সিএন জি থেকে নেমে দৌড়ে দাদাজানের কাছে গেলাম পা ছুঁয়ে সালাম করলাম দাদাজান আমার দিকে তাকিয়ে একটা হাসি দিলেন দাদাজানের সামনের একটা দাত পড়ে গিয়েছিল আমি হাসতে হাসতে বললাম

-সামনের দাত কই?

পড়ে গেছে বয়স হইসেনা এই বলে দাদাজান আমার খিলখিল হাসিতে যোগ দিল।এই হাসি আমি কখন ভুলিনি।
দাদাজান দিন দিন আরও অসুস্থ হয়ে গেলেন শেষের দিকে প্যারালাইসড হয়ে পা অকেজো হল হুইল চেয়ারে করে চলতে হত। আমি যখন হুইল চেয়ারটা জোরে ধাক্কা দিতাম দাদাজানের নিশ্চয়ই পড়ে যাবার ভয় হত তাও অবিরাম খিল খিল করে হাসত।

তখন আমি কলেজে পড়ি।আগামীকাল থেকে মাহে রমজান শুরু হবে আমাদের কলেজ এখনও ছুটি শুরু হয়নি।আমি তখন কলেজে, অফিস রুম থেকে একটা খালাকে পাঠানো হয়েছে, আমাকে কল করা হল ব্যাগ নিয়ে নিচে যেতে আমাকে আম্মু নিতে এসেছে আমি একটু অবাক হলাম এই সময় আম্মু!
নিচে এসে দেখলাম আম্মুর চোখ চিক চিক করছে, মুখে অস্থিরতা আমি ভীষণ ভয় পেয়ে গেলাম।সে সময়টা আমার কেমন লাগছিল তা কেবল আমি জানি।আম্মু গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে আমার মনে হচ্ছলো কলেজের এই বারান্দাটা এত বড় কেন আমি আম্মুর কাছে যেতে আর কতক্ষন ??
আম্মুর কাছে গিয়ে আম্মুকে ধরে জিজ্ঞেস করলাম

-কি হয়েছে আম্মু??
আম্মু বলল কাঁপা কাঁপা স্বরে বলল

-তেমন কিছুই হয়নি তোর দাদা একটু অসুস্থ আমরা আজ ই বাড়ি যাবো।

গেইট দিয়ে বের হয়ে আমি আম্মু কে আবার জিজ্ঞেস করলাম,আম্মুর সেই একই উত্তর।আমি কি বুঝলাম বা আমার মন আমাকে কি জানান দিল আমি জানিনা তবে কল্পনাতেও আনিনি দাদাজান আর নেই।সারাটা পথ আমি কাঁদতে কাঁদতে বাসায় এলাম।বাচ্চা দের মত কান্না সবাই তাকিয়ে হয়ত দেখছিল বড় কলেজ পড়ুয়া একটা মেয়ে কেন কাদছে। আম্মু অনেক চেষ্টা করেও থামাতে পারেনি সেই কান্না ।সবসময়ই কান্না জিনিসটা আমার কাছে খুব লজ্জার মনে হত তাই মানুষের সামনে কাঁদতে পারতাম না।কান্না পেলেই লুকিয়ে যেতান লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে যেতাম।সেদিন কোন লজ্জা কোন অনুভুতিই কাজ করছিলনা। তবেই এটাও সত্যি আমি কল্পনাতেও ভাবিনি দাদাজান আমার প্রিয় মানুষটা আর নেই। শুধু মনে হচ্ছিল কি যেন একটা অশুভ হয়ে গেছে।আমি বড় হবার পর প্রথম আমার প্রিয় দাদাজান কে হারানোটা দেখেছি এরপর একে একে জীবন থেকে অনেক প্রিয় মানুষ হারিয়ে গেছে।সেদিন আরও একটা জিনিস আমি দেখছি যা আমি আমার জীবনে দ্বিতীয় বার দেখিনি আমার বাবার চোখের জল!!

দাফন শেষ করে তিন দিন পর আমরা ঢাকায় ফিরে আসলাম ।রোজা শুরু হয়ে গেছে।সবাই বলছিল রোজায় সকল কবর বাশি আযাব মুক্ত থাকে।তখন মনে হতো দাদাজানের কোন কষ্ট হচ্ছেনা তিনি যেখানে আছেন ভালো আছেন।

বাবার বাবা না ফেরার দেশে চলে গেল।আমার বাবা ঈদ টা বরাবর ই বাড়ি গিয়ে করতে সাচ্ছন্দ বোধ করে।বাবার মতে, বড় হতে হতে সবাই সবার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে এত ব্যাস্ত হয়ে পড়ে বন্ধন এমনি একটু ঢিলা হয়ে আসে এই দুইটা খুশির দিনে অন্তত প্রিয় মানুষ গুলা কাছাকাছি থাকা উচিত। আমরা সবার জন্য কেনাকাটা করে ঈদের দুইদিন আগে বাড়ি গেলাম।বরাবর ই ঈদে বাড়ি গিয়ে লাফালাফি করতে গিয়ে আমি কোন কিছুই খেয়াল করিনা ।আমি তখন হয়ে যায় লাগাম ছাড়া গরু।সেইবার আমি অবাক হলাম।সবকিছু আমি খেয়াল করছি আমার চোখে পড়ছে।বাড়িটা সুনশান নীরব।এই বাড়িতে সব থেকেও কিছুই নেই।সবার মুখে মলিন হাসি।আমাদের জন্য কেউ অপেক্ষা করছেনা।আমরা আসব বলে কেউ ঘাটে বসে বড়শি দিয়ে মাছ ধরছেনা। পুকুর পাড়ে বাধানো ঘাট শুন্য! শুষ্ক! বাড়িটা খাঁ খাঁ করছে,বুকটা শুন্য ,পুরো বাড়িতে একটা অজানা নীস্তদ্ধ্বতা সবাইকে জানান দিচ্ছিল এই বাড়ির বিশেষ একজন আর নেই কখনো ফিরে আসবেনা। কেমন যেন খাপছাড়া সবকিছু।আমার খুব কান্না পাচ্ছিল।দাদু কেমন ঝিমিয়ে গেছে ঘরের এক কোনে বসে আছে আব্বু গিয়ে সালাম করলো তারপর চোখ ফিরিয়ে নিল!

ঈদের দিন সকাল আমি আর সকাল সকাল উঠিনা নামায পড়ে সবাই আসে ভাইয়ারা আমাকে ডেকে তোলে।, ততদিনে আমার বদ অভ্যাস তৈরি হয়ে গেছে আমি রাত জাগা পাখি আর সকালের ঘুম প্রিয় হয়ে গেছি। এটা আমার দোষ ও বলা যায়না কারন এই দোষ আমার বংশীয় সুত্রে পাওয়া।রাত দুটায় গ্রামের সবাই যখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন আমাদের বাড়িতে আমার বাপ চাচা বসে বসে গল্প করছে মা চাচিরা আবার চাও করে দিচ্ছে। আমরা কাজিনরা সবাই জেগে সেই গল্প শুনি।আগে এমন হতো উঠানে বসে দাদাজান গল্প বলত আর আমরা সবাই তাকে ঘিরে বসতাম।।যে গল্প বলত তা আমি কোন গল্পের বইয়ে পড়িনি।

সেই ঈদের দিন আমি সকাল সকাল উঠলাম আম্মু ডেকে তুলল। আমি খুব ভালো করে খেয়াল করে দেখলাম আব্বু আর তার ভাইদের আলিঙ্গন।সবাই বেশ স্বাভাবিক থাকছে।আব্বু ভাইদের জানান দিচ্ছে আব্বা এখন আর এই ধরণীতে নেই তবে আমি আছি। তারপর একবছরের মাথায় মারা গেলেন দাদু বাড়ি যাবার টান ও দিন দিন কমে যেতে লাগলো। রোজার ঈদ গুলোতে আমরা ঢাকায় থাকা হলেও আমার আব্বু এখন পর্যন্ত কোন কোরবানী ঢাকায় করেনি আমাদের কোরবানের গরু জবাই সবসময় আমাদের গ্রামেই দাদা বাড়ি হয়।যদি কখন ও অনাকাঙ্ক্ষিত কারনবশত আমরা বাড়ি না যেতে পারি আব্বু চলে যায় বাড়িতে।ঈদের দিন অথবা ঈদের দ্বিতীয় দিন।
ঈদ মানে আনন্দ ঈদ মানে খুশি ঈদ মানে জ্যোৎস্না রাতে হাসনা হেনার সুগন্ধ আমার এ যাবত কাটিয়ে আসা ঈদ গুলোর মধ্যে দুইটা ঈদ স্মরণীয় তার মধ্যে এই ঈদটাই অন্যতম স্মরণীয় ঈদ।

দাদাজান মারা যাবার পর দাদাজানের সেই ফোকলা হাসি আর ঢাকা চলে আসার দিন বিদায় লগ্নে দাদাজানের হুইল চেয়ারে বসে থাকা আমাকে বেশি করে দাদাজানের কথা মনে করিয়ে দিত।
৪টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

দেশ এগিয়ে যাচ্ছে; ভাবতে ভালই লাগে

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০২ রা মে, ২০২৪ দুপুর ১:০৩


বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ছিল নেতিবাচক। একই বছরে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ছিল প্রায় ১ শতাংশ। ১৯৭৩ সালে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রবৃদ্ধি ছিল ৭... ...বাকিটুকু পড়ুন

যুক্তরাষ্ট্রে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ ঠেকাতে পুলিশি নির্মমতা

লিখেছেন এমজেডএফ, ০২ রা মে, ২০২৪ দুপুর ১:১১



সমগ্র যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসগুলোতে বিক্ষোভের ঝড় বইছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ কর্মসূচী অব্যাহত রয়েছে। একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বিক্ষোভ দমনের প্রচেষ্টা চালালেও তেমন সফল... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ ০১

লিখেছেন রানার ব্লগ, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ৯:৫৫



নতুন নতুন শহরে এলে মনে হয় প্রতি টি ছেলেরি এক টা প্রেম করতে ইচ্ছে হয় । এর পেছনের কারন যা আমার মনে হয় তা হলো, বাড়িতে মা, বোনের আদরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

হিটস্ট্রোক - লক্ষণ ও তাৎক্ষণিক করণীয়

লিখেছেন ঢাকার লোক, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:০৭

সাধারণত গরমে পরিশ্রম করার ফলে হিটস্ট্রোক হতে পারে। এতে দেহের তাপমাত্রা অতি দ্রুত বেড়ে ১০৪ ডিগ্রী ফারেনহাইট বা তারও বেশি হয়ে যেতে পারে।

হিটস্ট্রোক জরুরি চিকিৎসা প্রয়োজন। চিকিৎসা... ...বাকিটুকু পড়ুন

আল্লাহকে অবিশ্বাস করার সংগত কোন কারণ নাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৩



সব কিছু এমনি এমনি হতে পারলে আল্লাহ এমনি এমনি হতে সমস্যা নাই। বীগ ব্যাং এ সব কিছু হতে পারলে আল্লাহও হতে পারেন। সব কিছুর প্রথম ঈশ্বর কণা হতে পারলে আল্লাহও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×