somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

একজন মায়ের দুঃখগাঁথা

১৯ শে জুলাই, ২০১২ বিকাল ৩:৪৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

হঠাৎ রাজিয়া বেগমের ঘুম টা ভেঙে গেলো।একেবারে উঠে বসে পড়লেন।আবারো সেই ব্যাথা।নিজের ভিতর থাকা আরেকটি প্রাণের অস্তিত্ব এভাবেই দিনে রাতে বেশ কয়েকবার হাত পা ছুড়ে জানান দেয়।আজ আর ঘুম আসবে না।অসহ্য ব্যাথা নিয়ে রাজিয়া বেগম বারান্দায় পায়চারি করতে থাকেন আর ভাবতে থাকেন কেমন দেখতে হবে তার সোনা মানিক,কিভাবে হাসবে? কিভাবে শুধু একটা স্যান্ডো গেন্জি পড়ে ন্যাংটু হয়ে ঘর জুড়ে দৌড়ে বেড়াবে।ভাবতে ভাবতে নিজের অজান্তে চোখের কোন বেয়ে একফোটা অশ্রু ঝরে পড়ে।

ঘরটা খুব অন্ধকার ।চারপাশে কিছু মুখোশ পরিহিত মানুষের পায়চারি।মাথার উপরে কি যেনো জলজল করে জ্বলছে।চারপাশের ফিনাইলের গন্ধে গা গুলিঁয়ে আসছে।ধীরে ধীরে সংঙ্গা হারান রাজিয়া।

কে যেনো কাদ্ঁছে ,সেই কান্না যেনো রাজিয়াকেই ডাকঁছে।রাজিয়ার জন্যই যেনো কাদঁছে।অনেক কষ্টে চোখ খুললেন রাজিয়া।চোখ খুলে নিজেই কাদঁতে শুরু করলেন।১০ মাস পরে নিজের চোখে নিজের ভেতরের আরেকটি প্রাণ তার সামনে ।হঠাৎ মনে হলো এই বাচ্চার জন্য তিনি সব দিয়ে দিতে পারেন,সব ত্যাগ করতে পারেন।নার্স বাচ্চাটিকে রাজিয়ার কোলে দিতেই অঝোরে কাদঁতে লাগলেন ।এ কান্না খুশির কান্না ,আনন্দ মিশ্রিত কান্না।বুকের সাথে শক্ত করে চেপে ধরলেন বাচ্চাটাকে,সাথে সাথে বুকের মধ্য দিয়ে একটা হিমশিতল হাওয়া বয়ে গেলো।

আজকাল রাজিয়া আর বাইরে যান না,স্কুলের চাকরি টা ছেড়ে দিয়েছেন।স্বামী আর সন্তান কি নিয়েই তার পৃথিবী।অনেকে নিষেধ করেছিলো চাকুরিটা ছাড়তে কিন্তু শোনেন নি।বলেছেন আমার বাবার জন্য আমি চাকুরি কেনো সব ছেড়ে দিতে পারি।রফিক সাহেব তো মাঝে মাঝে দুষ্টুমি করে বলেন আমাকে ও ছাড়তে পারো?রাজিয়া মুচকি হেসে বলেন আমার বাবার জন্য আমি দুনিয়া ছেড়ে যেতে পারি ,খোদা যেনো আমার আয়ু দিয়ে ওকে পরমায়ু দেন।

রাজিয়ার আয়ু ছেলেকে বাচাঁতে পারলেও স্বামী কে বাচাঁতে পারলো না।লোকটা বাসায় বসে পেপার পড়ছিলেন হঠাৎ বললেন বুকে ব্যাথা।এক গ্লাস পানি চাইলেন।রাজিয়া ছেলেকে খাওয়াচ্ছিলেন বললেন আসছি।খানিক পরে এসে দেখেন স্বামির নিথর দেহ ।

রফিক সাহেব মারা যাওয়ার আগে তেমন কিছুই রেখে যেতে পারেন নি।তাই স্কুলের চাকুরিটা আবার নিতে হলো শুধুমাত্র ছেলের ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে।ভাগ্যিস স্কুলটা বাসার কাছেই নাহলে বাবুকে কে দেখতো ? স্কুলের টিফিনের সময় যখন সব টিচার রা লান্চ করেন বা গল্পে মাতেন রাজিয়া বেগম তখন দৌড়ে বাসায় আসেন।সবাই অবাক হয় রোদ নেই বৃষ্টি নেই এই মহিলা পাগলের মতোন হেটে বাসায় চলে আসেন।শুধুমাত্র মহিলা বলে দৌড়ে আসতে পারেন না।বিলাসিতা করার মতোন টাকাও নেই যে রিকশায় চড়ে আসবেন।একটা কাজের মেয়ে রাখা হয়েছে,কিন্তু কাজের মেয়ের কাছে বুকের ধন কে রেখে তিনি শান্তি পান না।সেবার তো বাবুর যখন ম্যালেরিয়া হলো রাজিয়া দিনরাত জেগে বাবুর পাশে বসে থাকতেন।২০ দিনে দেখা গেলো রাজিয়ার চোখে নিচে কালি পড়ে গেছে।সবাই বললো এই মহিলা নির্ঘাৎ পাগল হয়ে গেছে।নাহলে নিজের শরীরের সাথে কেউ এমন নিষ্ঠুরতা করে।কিন্তু রাজিয়া হেসে বলতেন আমার বাবা টা ভালো হলে তখন নাহয় রেস্ট নেবো।
আজ রাজিয়ার অনেক খুশির একটা দিন ছেলে আজ এইচ এস সি তে বোর্ডে স্ট্যান্ড করেছে।পত্রিকা অফিস থেকে সেই সকালবেলা থেকেই লোকজন আসছে।রাজিয়া ছুটলেন বাজারে মিষ্টি কিনতে।
মা তুমি কোথায় যাচ্ছো?
মিষ্টি আনতে হবেনা বোকা ছেলে?
আমি নিয়ে আসছি টাকা দাও।
আরে ধূর বোকা ছেলে তুই মিষ্টি আনতে গেলে লোকে বলবে কি?
স্ট্যান্ড করা ছেলেরা বাজারে যায় নাকি?
মা তুমি যে কি বলোনা? আমাকে কোনোদিন বাজার করতে দিলেনা।আর বোকা আমি যখন বুড়ো হবো তখন তো তুই ই বাজার করবি আর আমি বসে বসে খাবো,বলে আনন্দের হাসি হাসেন রাজিয়া।
বাজারে যাওয়ার পথে রাজিয়ার চোখ থেকে কান্না ঝরে।আজ রাজিয়ার চাইতে বেশি খুশি কেউ নেই পৃথিবীতে।নিজে খেয়ে না খেয়ে ,ধার কর্জ করে এই ছেলেকে মানুষ করেছেন।আজ আর কিইবা চাইবার আছে রাজিয়ার?

রাজিয়া স্কুলের হেডমাস্টারের ছেলে অ্যামেরিকা থাকে।রাজিয়ার সুপারিশে অনেক চেষ্টা চরিত্র করে বাবুর জন্য একটা স্কলারশিপ জোগাড় করে দিয়েছেন।শুধু বিমান ভাড়া আর প্রথম সেমিস্টারের টিউশন ফিস বাবৎ ৫ লক্ষ টাকা দিতে হবে।কাউকে না জানিয়ে রাজিয়া নিজের সব গয়না বিক্রি করে দেন।শেষ সম্বল গ্রামের ভিটেখানিও। নাকফুল,কানের দুল,চুড়ি সব
।বাবু হঠাৎ বলে মা তোমার নাক খালি কেনো?
কোথায় যেনো হারিয়ে ফেলেছি রে বাবা।বাবু অবিশ্বাসি চোখে তাকায়,রাজিয়া পালিয়ে বাচেঁন।

আজ বাবু চলে গেলো ,রাজিয়া সারা ঘর হাটেন আর বাবুর পুরনো কাপড় গুলো বুকে জড়িয়ে কাদেঁন।বাবুর পছন্দের কিছু রান্না করেন না।বাবুর পড়ার টেবিলে মুখ দিয়ে বসে থাকেন,টেবিলটায় বসলেই বাবুর গন্ধ পাওয়া যায়।বাবুর হাতের লেখায় হাত বুলিয়ে বাবুর হাতের পরশ নেন।

৪ বৎসর পর
বাবু ফিরে এসেছে।কমেন যেনো একটু বদলে গেছে।আগের মতোন আর বেশি কথা বলেনা।ব্যাপার না অনেকদিন পরে এসেছে একটু তো এমন হবেই।রাতে খেতে বসে বাবু জানায় তার কিছু টাকা লাগবে নতুন ব্যাবসা শুরু করবে।রাজিয়া বলেন চিন্তা করিস না আমি ব্যাবস্থা করে ফেলবো।
রাজিয়া প্রভিডেন্ড ফান্ডের সব টাকা আজ বাবুর হাতে তুলে দিলেন।বাবুর মুখে হাসি দেখে রাজিয়ার বুকটা ভরে গেলো,ছেলেটা এতো সুন্দর করে কিভাবে যে হাসে?

বাবুর আজ বিয়ে,বাবুর নিজের পছন্দের মেয়ে।বড়লোকের মেয়ে।রাজিয়ার আপত্তি নেই।ছেলে সুখি হলেই হলো।

আজ বাবুর বিয়ের ৩ মাস হতে চললো।বাবু আজকাল আর মার সাথে হাসেনা,কথায় কথায় ঝাড়ি দেয়।বাবুর বউ তো আরেক কাঠি সরেস।শাশুড়িকে দিয়ে বাসার সব কাজ করানো যাবে বলে কাজের মেয়েকে বিদায় করে দেওয়া হয়েছে।

আজ রাজিয়ার বিচার বসেছে ।দোষ? বাসায় একটা পার্টি ছিলো,রাজিয়া রান্না করতে গিয়ে মাংস পুড়ে ফেলছেন।সবাই চলে যাওয়ার পর বাবু আর বাবুর স্ত্রী এ নিয়ে রাজিয়াকে বেশ কথা শোনালো।রাজিয়া এক পর্যায়ে রাগ সামলাতে না পেরে পূত্রবধুকে কিছু কড়া কথা শুনিয়ে দিলেন।ব্যাস স্ত্রীকে খুশি করতে গিয়ে বৃদ্ধ মাকে রাতের আধারে রাস্তায় বের করে দিলো অমানুষ পুত্র।
রাজিয়ার কান্না শুনে পাশের বাড়ির হিন্দু পরিবার টি তাকে কিছুদিনের জন্য ঠাইঁ দিলো।তারা বাবুর সাথে এ ব্যাপারে আলাপ করতে চাইলেও বাবু সাফ জানিয়ে দিলো রাজিয়ার আর এ বাসায় জায়গা হবেনা।বাধ্য হয়ে হিন্দু পরিবার টি রাজিয়াকে দিয়ে এলো বৃদ্ধাশ্রমে।

সকল ভালোবাসা,ত্যাগের প্রতিদান বাবু একদিনে দিয়ে দিলো।


এটা কোনো গল্প নয়।এই ঘটনা টি বাস্তবেই ঘটেছে এবং তা ঢাকা শহরেই।শুধু নামটা পরিবর্তন করে দিলাম।আজ দা লর্ড ভাই আমাকে বলছিলেন ঘটনা টা।উনি বললেন এই ঘটনা টা বেশ কিছুদিন যাবৎ উনাকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে।একজন মানুষ কে সারাজীবন পেলে পুষে বড়ো করলো সে বিয়ের পর কিভাবে তার আপন মাকে ভুলে যায়? ছেলেরা কেনো এমন হয়।এর জবাব কি কারো কাছে আছে? ধ্বিক জানাই সেসব অমানুষদের।
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে জুলাই, ২০১২ বিকাল ৪:২৫
৩২টি মন্তব্য ৩১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বিজয়ের আগে রাজাকারের গুলিতে নিহত আফজাল

লিখেছেন প্রামানিক, ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৫:১৩


ঘটনা স্থল গাইবান্ধা জেলার ফুলছড়ি থানার উড়িয়া ইউনিয়নের গুণভরি ওয়াপদা বাঁধ।

১৯৭১সালের ১৬ই ডিসেম্বরের কয়েক দিন আগের ঘটনা। আফজাল নামের ভদ্রলোক এসেছিলেন শ্বশুর বাড়ি বেড়াতে। আমাদের পাশের গ্রামেই তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

৫৫ বছর আগে কি ঘটেছে, উহা কি ইডিয়টদের মনে থাকে?

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৫:৫৮




ব্লগের অনেক প্রশ্নফাঁস ( Gen-F ) ১ দিন আগে পড়া নিউটনের ২য় সুত্রের প্রমাণ মনে করতে পারে না বলেই ফাঁসকরা প্রশ্নপত্র কিনে, বইয়ের পাতা কেটে পরীক্ষার হলে নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

নিজামী, মুজাহিদ, বেগম জিয়াও বিজয় দিবস পালন করেছিলো!!

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৭:২০



মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বেগম জিয়ার মুরগী মগজে এই যুদ্ধ সম্পর্কে কোন ধারণা ছিলো না; বেগম জিয়া বিশ্বাস করতো না যে, বাংগালীরা পাকীদের মতো শক্তিশালী সেনাবাহিনীকে পরাজিত করতে পারে;... ...বাকিটুকু পড়ুন

১৯৭১ সালে পাক ভারত যুদ্ধে ভারত বিজয়ী!

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯


দীর্ঘ ২৫ বছরের নানা লাঞ্ছনা গঞ্জনা বঞ্চনা সহ্য করে যখন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বীর বাঙালী অস্ত্র হাতে তুলে নিয়ে বীরবিক্রমে যুদ্ধ করে দেশ প্রায় স্বাধীন করে ফেলবে এমন সময় বাংলাদেশী ভারতীয়... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইন্দিরা গান্ধীর চোখে মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক: ওরিয়ানা ফলাচির সাক্ষাৎকার থেকে

লিখেছেন শ্রাবণধারা, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১১:৫৫


১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ইতালীয় সাংবাদিক ওরিয়ানা ফলাচি ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাক্ষাৎকার নেন। এই সাক্ষাৎকারে মুক্তিযুদ্ধ, শরনার্থী সমস্যা, ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক, আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদী পররাষ্ট্রনীতি এবং পাকিস্তানে তাদের সামরিক... ...বাকিটুকু পড়ুন

×