somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

দুর্গাপুর অভিযাত্রার আনন্দ

২১ শে মে, ২০১৫ সন্ধ্যা ৬:৪৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



কাচারিপাড়া থেকে বাগিচাপাড়া, উকিলপাড়া থেকে হাঁটতে হাঁটতে প্রবেশ করলাম আমলাপাড়ায়।
দুর্গাপুর সাহিত্য সমাজের দ্বিতল ভবনের সামনে দাঁড়ালাম আমরা। উল্টোদিকে তাকালাম। একটি বাহুল্যবর্জিত প্রবেশ তোরণ আমাদের দৃষ্টিপ্রত্যক্ষে। ভেতরে সবুজ ঘাসে আচ্ছাদিত অতিদীর্ঘ উঠোন। উঠোনের উত্তর-পূর্বে এবং উত্তর-পশ্চিমে বেশ কয়েকটি একতলা ঘরের নান্দনিক সমাবেশ।
বহুবর্ণে সজ্জিত এই ঘরগুলো কি বিশেষ কোনো গুরুত্বের অধিকারী?
অজান্তেই প্রশ্ন তৈরি হলো আমাদের মনে। উত্তরের অনুসন্ধানে এদিক-ওদিক তাকাতেই মোক্তারপাড়া নিবাসী দীপক মজুমদার আমাদের সামনে এসে দাঁড়ালেন, পরিচয়ের পালা শেষ হবার পর তিনি জানালেন, ঘরগুলো সত্যিকার অর্থেই বিশেষ গুরুত্বের অধিকারী। কারণ, নেত্রকোনা জেলার দুর্গাপুর উপজেলার বিখ্যাত রাজবংশের মধ্যমবাড়ি এটি!
মধ্যমবাড়িতে বসবাসকারী শেষ উত্তরাধিকারী ছিলেন দেবেশ চন্দ্র সিংহ, যিনি সকলের কাছে পরিচিত ছিলেন মনি বাহাদুর নামে। ১৯৫২ সালে মণি বাহাদুর মধ্যমবাড়ি দেখাশোনার দায়িত্ব প্রদান করেন মধু দাসকে। মধু দাসের মৃত্যুর পর তাঁর উত্তরসূরিরাই বর্তমানে বসবাস করছেন মধ্যমবাড়িতে।

দীপক মজুমদারের সঙ্গে কথা বলতে বলতে মধ্যমবাড়ির আঙিনায় প্রবেশ করলাম আমরা। পরিচ্ছন্ন আঙিনার শেষ প্রান্তে দক্ষিণমুখী বসতঘর, ঠাকুরদালান ঘুরে দেখতে দেখতে অতীত স্মৃতিচারণায় মগ্ন হলাম; ভাবলাম পুরোনো দিনের কথা, ভাবলাম সুসং দুর্গাপুরের বিখ্যাত জমিদারবংশের প্রতিষ্ঠালগ্নের কথা।

১২৮০ খ্রিস্টাব্দ। গারো পাহাড়ের পাদদেশের এই দুর্গম অঞ্চল তখন শাসন করতেন বৈশা নামের একজন অত্যাচারী গারো রাজা। তাঁর অত্যাচারে অতিষ্ঠ ছিল এলাকার নিম্নবর্গীয় জনগোষ্ঠী। তারা এই দুঃশাসন থেকে পরিত্রাণের উপায় খুঁজত। উপায় খুঁজত শান্তিতে বসবাসের। এমনই এক সময় সোমেশ্বর পাঠক নামের একজন সুদর্শন ব্রাহ্মণ নীলাচল পাহাড়ের কামাখ্যা মন্দির পরিদর্শন শেষে একদল সঙ্গীসহ গারো পাহাড়ের পাদদেশে উপস্থিত হলেন। পাহাড় পাদদেশে একটি স্রোতস্বিনী নদী ছিল। সেই নদীর অপরূপ সৌন্দর্যে বিমোহিত হলেন সোমেশ্বর পাঠক। সঙ্গীদের জ্ঞাতসারেই তিনি ধ্যানমগ্ন হলেন নদীতীরে।

কিছু স্থানীয় নিম্নবর্গীয় মানুষ তখন এদিক দিয়েই যাচ্ছিলেন। সোমেশ্বর পাঠকের ধ্যানমগ্ন অবয়বে তারা নিজেদের পরিত্রাতাকে খুঁজে পেলেন। করজোড়ে সোমেশ্বর পাঠকের কাছে অত্যাচার থেকে মুক্তির প্রার্থনা করলেন তারা। নিম্নবর্গীয় মানুষের প্রার্থনায় সোমেশ্বর পাঠকের মন বিচলিত হলো। তিনি স্থানীয় অধিবাসীদের সহায়তায় অত্যাচারী গারো রাজাকে পরাস্ত করলেন এবং গারো পাহাড়ের দুই-তৃতীয়াংশ এলাকাসহ পাহাড় সমতলের এক বিরাট অংশ নিয়ে প্রতিষ্ঠা করলেন নতুন রাজ্য। সামন্ততান্ত্রিক এই নতুন রাজ্যের নাম দিলেন তিনি ‘সু-সঙ্গ’ অর্থাৎ ‘ভালো সঙ্গ’। সুসঙ্গ রাজ্য প্রতিষ্ঠায় ভীষণ আনন্দিত হলো স্থানীয় জনগণ। সোমেশ্বর পাঠকের নামানুসারে গারো পাহাড়ের পাদদেশের নদীটির নাম রাখলেন তারা ‘সোমেশ্বরী’।

সুসঙ্গ রাজ্যের গোড়াপত্তন ঘটিয়ে রাজা সোমেশ্বর পাঠক নিজস্ব বাহিনীকে শক্তিশালী করার কাজে মন দিলেন। তিনি সুদূর আসাম থেকে কামাখ্যা দেবীর অনুসারী হাজংদের নিজ রাজ্যে নিয়ে এলেন। তারপর শুরু করলেন রাজ্যবিস্তার। সোমেশ্বর পাঠকের রাজত্বকালে সুসঙ্গ রাজ্যের সীমা উত্তরে নেংজা পর্বতমালা থেকে পূর্বে মহেষখলার মহেশ্বরী নদী, পশ্চিমে নিতাই নদী থেকে দক্ষিণে বিস্তৃত সমতল ভূমি পর্যন্ত বিস্তার লাভ করে।
৭১৪ বঙ্গাব্দে সোমেশ্বর পাঠকের দেহত্যাগের পর সুসঙ্গ রাজ্যের শাসনভার গ্রহণ করেন তাঁর একমাত্র পুত্র গুণাকর। তারপর রাজ্যশাসন করেন গুণাকরের জ্যেষ্ঠ পুত্র কামাই হাজরা। এরপর সুসঙ্গ রাজ্য শাসন করেন যথাক্রমে বাসুদেব খাঁ, জগদানন্দ খাঁ এবং জানকীনাথ মল্লিক।
জানকীনাথ আততায়ীর হাতে নিহত হলে তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র রঘুনাথ গ্রহণ করেন সুসঙ্গ রাজ্যের শাসনক্ষমতা। সুসঙ্গরাজ রঘুনাথ মোগল সম্রাটের পক্ষ নিয়ে সুবাদার ঈশা খাঁর বিরুদ্ধে যুদ্ধে যোগ দেবার লক্ষ্যে এগারোসিন্দুর অভিমুখে যাত্রা করেন। কিন্তু পথে রঘুনাথের বিরুদ্ধপক্ষ তাঁকে বন্দী করলে হাজং ও গারো বাহিনীর সহায়তায় তিনি মুক্ত হন এবং এগারোসিন্দুর থেকে পালিয়ে আসার সময় একটি অষ্টধাতুর দুর্গা প্রতিমা নিয়ে আসেন।
রঘুনাথ দুর্গা প্রতিমাটি সুসঙ্গ রাজ্যে প্রতিষ্ঠিত করার পর থেকেই এলাকাটি দুর্গাপুর নামে পরিচিতি লাভ করে। পরবর্তীকালে দুর্গাপুরের অগ্রে প্রাচীন সুসঙ্গ নামটি যুক্ত হয়ে এলাকার নাম লোকমুখে প্রচলিত হয় সুসঙ্গ দুর্গাপুর।

সুসঙ্গ রাজাদের উল্লেখযোগ্য কিছু নিদর্শন আজও রয়েছে দুর্গাপুর উপজেলা সদরে। এই মধ্যমবাড়ি ছাড়াও রয়েছে বড়বাড়ি, দু-আনি বাড়ি, ছোট তরফের জমিদারবাড়ি এবং দশভুজার মন্দির। এই দশভুজার মন্দিরেই রাজা রঘু স্থাপন করেন অষ্টধাতুর দুর্গা প্রতিমা, জানালেন দীপক মজুমদার। তবে আদি দুর্গা প্রতিমাটি এখন আর নেই এখানে! ১৯৬৫ সালে চুরি হয়ে যায় অনিন্দ্যসুন্দর সেই বিগ্রহটি!
বড়বাড়ি, মধ্যমবাড়ি, দু-আনি বাড়ি এবং ছোট তরফের জমিদারবাড়ির অবস্থা বর্তমানে ভীষণ করুণ!
প্রভাবশালী বিভিন্ন ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠান দখল করেছে এইসব ঐতিহ্যবাহী স্থাপনার সিংহভাগ! রাষ্ট্রীয় আনুকূল্যে অনিয়মতান্ত্রিকভাবে পরিবর্তন করেছে সম্পত্তির মালিকানা!
এই অনিয়মতান্ত্রিক পরিবর্তন প্রক্রিয়ার শেষ কোথায়?

সদুত্তরের সম্ভাবনাহীন প্রশ্নটাকে পথেই ফেলে আসি আমরা! সঙ্গে শুধু আনি অভিযাত্রার আনন্দকে!

সর্বশেষ এডিট : ২১ শে মে, ২০১৫ সন্ধ্যা ৬:৪৮
১৬টি মন্তব্য ১৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

সবুজের মাঝে বড় হলেন, বাচ্চার জন্যে সবুজ রাখবেন না?

লিখেছেন অপলক , ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:১৮

যাদের বয়স ৩০এর বেশি, তারা যতনা সবুজ গাছপালা দেখেছে শৈশবে, তার ৫ বছরের কম বয়সী শিশুও ১০% সবুজ দেখেনা। এটা বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা।



নব্বয়ের দশকে দেশের বনভূমি ছিল ১৬... ...বাকিটুকু পড়ুন

আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে লীগ আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে জামাত

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৪৬


বাংলাদেশে রাজনৈতিক ছদ্মবেশের প্রথম কারিগর জামাত-শিবির। নিরাপত্তার অজুহাতে উনারা এটি করে থাকেন। আইনী কোন বাঁধা নেই এতে,তবে নৈতিক ব্যাপারটা তো অবশ্যই থাকে, রাজনৈতিক সংহিতার কারণেই এটি বেশি হয়ে থাকে। বাংলাদেশে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

লিখেছেন নতুন নকিব, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৪৩

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

চা বাগানের ছবি কৃতজ্ঞতা: http://www.peakpx.com এর প্রতি।

আমাদের সময় একাডেমিক পড়াশোনার একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। চয়নিকা বইয়ের গল্পগুলো বেশ আনন্দদায়ক ছিল। যেমন, চাষীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×