আমাদের পাশের গ্রামের এক হিন্দু ছেলে কলিকাতায় চাকুরি করার সময়, এক স্নিগ্ধ সুন্দরী অবাংগালী মেয়েকে বিয়ে করে গ্রামে নিয়ে আসে; বিয়ের ২ বছরের মাঝে ছেলেটির মৃত্যু হয়; বিধবার পাশে কেহ ছিলো না, অপরিচিত এই যায়গায় বেঁচে থাকার চেষ্টা করেছিলো সে; কিন্তু সমাজের মানুষের বিবেকহীন আচরণের কারণে সে অবশেষে নিরুদ্দেশ হয়ে যায়, এটি সেই কাহিনী।
গ্রামের কেহ কুকিনীর মা-বাবা, আত্মীয়স্বজন, জন্মস্হান সম্পর্কে কিছুই জানতো না; কিন্তু বেশীর ভাগই ধরে নিয়েছে যে, কুকিনীর মা নিশ্চয় পতিতা ছিলো, না'হয় কুকিনীএত সম্পত্তি কিভাবে কিনলো! কুকিনী কোন ব্যাপারে মুখ খুলেনি, সে বাড়িতে নিজকে নিয়ে কিছুদিন ব্যস্ত রলো; ইহাতে গ্রামবাসী দম বন্ধ হওয়ার উপক্রম, তারা কিছু একটা শুনতে চায়। কুকিনী ২/১ সপ্তাহ পর পর স্হানীয় পোষ্ট অফিসে যেতো, কলকাতায় চিঠি পাঠাতো ও তার সেভিংস একাউন্ট থেকে টাকা তুলে আনতো। গ্রামের কিছু পরিচিত মুখ পোষ্টমাষ্টারের কাছে কুকিনীর জমানো টাকার পরিমাণ জানতে চেয়েছিলো; কিন্তু তা সম্ভব হয়নি।
আমি এক সন্ধ্যায় স্কুল থেকে ফিরছি, সামান্য ফিনফিনে বৃষ্টি ছিলো, সাথে ছাতা ছিলো না; আমার বেশ সামনে ধীর গতিতে কুকিনী তার বাড়ীর দিকে যাচ্ছিলেন ; আমি তাঁর পাশ দিয়ে দ্রুত গতিতে যাবার সময়, তিনি আমাকে ডাকলেন,
-আস, আমার ছাতার নীচে আস।
-না, লাগবে না, আমি দ্রুত চলে যেতে পারবো।
-লজ্জা করিও না, বইগুলো ভিজে যাবে।
বেশ কিছু পথ বিনা আলাপে গেলাম; এক সময় কুকিনী বললেন,
-মানুষজন আমার মা'কে নিয়ে কথা বলছে, শুনেছ?
-শুনেছি, আমি এসবে কান দিই না।
-কেন কান দাও না?
-আপনি তো আপনার পরিবার সম্পর্কে কোন কিছু বলেননি ।
-কেহই কিছু জানে না; এলাহী আমাদের নামে মিথ্যা কথা বলেছে।
মাস'খানেক পরে, এক সকালে পুরো গ্রামে রটনা হয়ে গেলো যে, কুকিনীর শ্বশুর মাঝরাতে আজিজকে কুকিনীর ঘর থেকে বের হওয়ার পর ধরে ফেলেছিলো; পরে তাকে আজিজের বাবার কাছে নিয়ে গেছে। বিকেলের মাঝে সংবাদ সামান্য বদলালো, তাকে কুকিনীর ঘরের সামনে নয়, বাড়ীর সামনে পুকুরের পাড়ে ধরেছিলো। পরেরদিন এর থেকেও বড় সংবাদ বের হলো, আজিজ বাড়ী থেকে পালিয়ে গেছে। কুকিনীর ব্যক্তিত্ব ও সৌন্দয্য মিলে এমন একটা গাম্ভীর্য ছিল সব সময়, কুকিনীকে কেহ কিছু প্রশ্ন করার সাহস করতো না, এবং কুকিনী কোন ব্যাপারে নিজের থেকে কিছু বলতো না।
লোকমুখে ঘটনার নতুন নতুন ডালপালা গজাতে লাগলো প্রতিদিন; অবশেষে, ফকির মিয়া (আজিজের বাবা ) কুকিনীর বিপক্ষে সালিশ ডাকলো; ফকির মিয়ার ধারণা, কুকিনী জানে আজিজ কোথায়! এক শুক্রবার, নামাজের পর, ২ গ্রামের হিন্দু মুসলমান সবাই মসজিদের সামনে বসলো, কুকিনীকে ডাকা হয়েছে, সে এসে দুর্বা ঘাসের উপর চুপচাপ বসে সব শুনলো। অবশেষ তাকে কথা বলার সুযোগ দেয়া হলে, সে জানালো যে, আজিজ মাঝে মাঝে তাদের বাড়ীতে তৈরি-করা পিঠা ইত্যাদি নিয়ে আসতো, সে মানা করেছিলো কয়েকবার। আজিজ কোথায় ইত্যাদি তার জানা নেই। সালিশ শেষ হলো, কোন রায় দেয়া সম্ভব হয়নি; আজিজের সাথে কুকিনীর কোন সম্পর্ক আছে কিনা, উহা বের করা সম্ভব হয়নি।
আজিজের বাবা কুকিনীর জমিজমা আর চাষ করবে না ঘোষণা দিলো; কুকিনী সালিশের প্রশ্নের উত্তরগুলো এমন সংক্ষিপ্ত আকারে দিয়েছিলো যে, পুরো গ্রামবাসী ভয়ংকরভাবে হতাশ হয়ে গেছে। গ্রামের অনেকই এখন বলাবলি করছে, যেমন মা, তেমনি মেয়ে। কুকিনীকে সাহায্য করার কেহ রহিলো না।
( বাকীটুকু পরে )
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে নভেম্বর, ২০২১ রাত ১২:৪১