ছবি- The Daily Star
বাজারে গেলেই প্রাণ হাসফাস, তবুও সহ্য করতেই হবে। কেননা বেতন তো বেড়েছে (!!)। বছর দুই আগে যখন দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি যখন শুরু তখন বন্ধুদের আড্ডায় বললাম, আমি কামলা মানুষ, আমার গার্মেন্টস এ বাণিজ্য বিভাগে চাকরির অভিজ্ঞতা হল, বাজারে দ্রব্যমূল্য আরো বারবে। বললাম- গ্রামের লোকেরা ঋণ নিয়ে ট্রেনডেসটার কিনত, সে ট্রেনডেসটারের ব্যাটির কিনত, ঘরের খাবারের টাকায়, পরে সে ট্রেনডেসটার সহ ঘরের হান্ডিপাতিল বিক্রি করে সে ঋণ শোধ করতে হত। যাদের জন্ম অনন্ত ২০০০এর পর এরা ট্রেনডেসটার শব্দের সাথে পরিচিত নয়। ট্রেনডেসটার হল রেডিও বিশেষ গান শোনার যন্ত্র।
দ্রব্যমূল্যের উদ্ধগতির জন্য রাষ্ট্রের বিলাসিতা যেমন দায়ী তেমন জনগনের বিলাসিতাও কম দায়ি না। প্রশ্ন হল জনগনের আর বিলাসিতা কই? বিশ্ব এগিয়ে যাচ্ছে আমাদেরও তো তাল মেলাতে হবে। তাদের প্রশ্নের জবাব হল, আপনার প্রতিবেশির দামি গাড়ি আছে বলেই আপনার বাড়ি বন্ধক রেখে গাড়ি কিনতে হবে সেটা কতটা যোক্তিক?
আগে আমাদের আমাদনি নির্ভর পণ্যের মূল্য পরিশোধ সম্পর্কে একটু সাধারণ ধারনা থাকা দরকার। যারা অনন্ত পূর্বেকার বিনিময় প্রথা সম্পর্কে জ্ঞান আছে তারা সহজে বুঝতে পারবে। ডলার একটি বিনিময় মাধ্যম। আমরা যখন কোন ভিন্ন দেশে থেকে কোন কিছু ক্রয় করি তখন আমাদেরও তাদের কিছু পণ্য দিতে হয় সেটা ছিল বিনিময় মাধ্যম বা এক পণ্যের বিনিময়ে অন্য পণ্য। ব্যাপারটাকে সহজ করার জন্য ইন্টারন্যাশনাল কারেন্সির উদ্বব। একটা সময় গোল্ড ছিল আন্তর্জাতিক বিনিময় মাধ্যম, পরবর্তীতে শোষণ রাষ্ট্র গোল্ডের পরিবর্তে তাদের মুদ্রাকে বিনিময় মুদ্রা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে যেমন- জিবিপি, ডলার, ইউরো। আমরা যখন রপ্তানি করি তখন তার বিনিময়ে আমরা সহজ বিনিময়যোগ্য হিসাবে খ্যাত ডলার পেয়ে থাকি, সে ডলার বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা থাকে, আবার যখন বিদেশ থেকে কোন কিছু ক্রয় করি তখন সেখান থেকে ডলারের মাধ্যমে পরিশোধ করা হয়, সহজ ভাষায় ব্যাংকগুলি ব্যাবসায়িদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ডলার কিনে সে ডলাররের মাধ্যমে পরিশোধ করে (ডলারের পাশাপাশি ইউরোতেও পরিশোধ করা হয় বিশেষ কিছু দেশের চাহিদা মোতাবেক)। এখন আমাদের ডলারের সোর্স কি? রপ্তানি বাণিজ্য ও বিদেশী রেমিটেন্স। রপ্তানি বানিজ্যের মধ্যে সর্বপ্রথম আছে- গার্মেন্টস শিল্প, তবে সে শিল্পের যে আয় তার অনন্ত ৭০% চলে যায় বিদেশী ব্যায় মেটাতে, কেননা গার্মেন্ট তৈরীতে যে মালামাল লাগে সেগুলি আমদানি করতে হয় বিদেশ থেকে, অষুধ রপ্তানি যার প্যাকিং ও লেবার কস্ট শুধু আমাদের থাকে, সমস্ত কাচামাল দেশের বাহির থেকে আমদানি। তারপর চামরা, বিগত কয়েক বছর চামরা রপ্তানিতে ধস, চিংড়ি রপ্তানি বন্ধ, সচল আছে কিছু সচজি রপ্তানি। তা হলে আমাদের আয়ের খ্যাত খুবই নগণ্য, কিন্তু ব্যায়ের খ্যাত- সমস্ত ইলেকট্রিক যন্ত্রাংশ, গাড়ি, জ্বলানি, কাপড়, প্রসাধনি, হান্ডিপাতিল, প্লাস্টিক সামগ্রী, কাগজ, ধান, চাল, গম, চিনি, গুড়া দুধ সহ প্রায় সব ধরনের পণ্যই আমরা আমাদিন নির্ভর। এবং বিগত ১০/১৫বছর যোগ হয়েছে বৈদেশিক শিক্ষা। যার ফলে আমাদের যে আয় তার থেকে ব্যায় অনেক অনেক বেশি। ফলে প্রতিবছর ঋণ করতে হচেছ। ঋণের আবার আন্তর্জাতিক ফাঁদ হল ঋণ করলে মুদ্রার মান কমে যাবে। আরো একটি মজার ফাঁদ হল, টাকা রিজার্ভ রাখা, যার যত রিজার্ভ তার মুদ্রার মান তত বেশি। সহজ কথায় বলা যায় প্রতিবেশির ব্যাংকে কোটি টাকা অলস আছে তাই তার ১টাকা সমান আমার ৫টাকা কেননা আমার ব্যাংকে টাকা তার থেকে কম।
প্রথমত আমরা আমদানি নির্ভর এবং তার উপর সরকারের অভ্যন্তরীণ অসংখ্য মেগা প্রজেক্ট, অরপ্তানি নির্ভর বৈদেশিক ব্যাবসায়ীক প্রতিষ্ঠাণ যারা এদেশ থেকে বৈদেশি মুদ্রা নিয়ে যাচ্ছে (গ্রামীন ফোন, এয়ারটেল, হালে যুক্ত হয়েছে ইউটিউব, ফেসবুক ইত্যাদি) যার মাধ্যমে বিগত কয়েক বছর ব্যাপক হারে বৈদেশি মুদ্রার উপর চাপ বেড়েছে। সাথে যোগ হয়েছে অর্থ পাচার, অর্থপাচারকারীরা এদেশে থেকে বিভিন্ন উপায়ে ডলার নিয়ে যায়, যারা বিদেশে আছেন তারা ব্যাপরটা সম্পর্কে জানেন। আর যারা হুন্ডি সম্পর্কে জানেন তারা তো এ বিষয়ে বেশ পারদর্শী। হুন্ডি হল নন ব্যাংকিং চ্যানেল। যারা ভিন দেশ থেকে এদেশে ডলার পাঠাতে চায় তাদের থেকে ডালার নিয়ে এদেশের পরিবারের কাছে টাকা দিয়ে দেয়, আবার যারা এদেশ থেকে টাকা পাঠাতে চায় তাদের থেকে টাকা নিয়ে সে দেশে ডলার দিয়ে দেয়।
সো ফলাফল আমাদের আয় থেকে ব্যায় অনেক বেশি। এর মূল কারণ আমাদের নীতি নির্ধারকেরা ও আমাদের চোর সুলভ চরিত্র। যারা পত্রিকা পড়েন বা দেশের খবর রাখেন তারা জানেন যে চিনি কল গুলি ক্রমান্বয়ে লোকসান করছিল তাই যার ফলে চিনিকল বন্ধ করে দিল কেননা আমদানি করলে চিনি অনেক কমে পাওয়া যাচ্ছিল। একাউন্টিং এর ভাষায় এটা খুব সহজ হিসাব, কিন্তু ম্যানেজমেন্ট অংকে গেলে এত সহজে চিনিকল বন্ধ হত না, কেননা আমদানি করতে আমার বৈদেশি মুদ্রা যাচ্ছে, আর লোকসান হলে আমার দেশিয় মুদ্রায় হচ্ছে। তখন চিনিকল গুলি বন্ধ না করে চিনিতে ভ্যাট বৃদ্ধি করলে যেমন রাজস্ব বাড়ত তেমনি দেশীয় চিনিকল কম লোকসান হত এবং আজ চিনির দাম ১৩০হত না, কয়েক বিলিয়ন ডলার সঞ্চয় হত চিনি আমদানি থেকে। লোকসান হচ্ছিল স্থানীয় মুদ্রায় আর এখন চলে যাচ্ছে বৈদেশি মুদ্রা।
আবার দেখেন গ্রামীণ ফোন, এদশে থেকে প্রতিবছর কত টাকা ব্যাবসা করছে? তারা কিন্তু ডলার নিয়ে যায়, আমরা টেলিটক ব্যাবহার করি না নেটওয়ার্ক সমস্যার কারণে আর ল্যান ফোন ব্যবহার করি না লাইনম্যানদের যন্ত্রণায় ও লাইন সমস্যার কারনে।
আবার এখন একটি বাসায় প্রতিটি রুমে রুমে টিভি, এ টিভি আমাদের আমদানি করতে হয় যেখানে প্রতিটি বাড়িতে ১টি টিভিই যথেষ্ঠ, টিভির দাম সস্তা না করে ভ্যাট বৃদ্ধি করলে রাজস্ব বাড়ত আমদানিও কমত। কিন্তু ব্যাবসায়ি সংগঠন তাদের লাভের জন্য নীতি নির্ধারকদের মাধ্যমে ভ্যাট কমিয়ে নেয়, মোবাইলের কথা যদি বলা হয়, এদেশে মেজরিটি পারসন মোবাইল ব্যবহার করে যাদের দরকারই নেই। ফ্রিজ, ওয়াসিং মেশিন, প্রসাধনী থেকে শুরু করে যেদিকে তাকাবেন শুধু আমাদনি আর আমাদনি।
এ গুলিতো গেল আমরা উৎপাদন করতে পারি না, কিন্তু আমরা যে জিনিস উৎপাদন করতে পারি সেগুলিও আমদানি নির্ভর হয়ে গেছি। গ্রামেগঞ্জে গেলে ইমারত আর ইমারত, দিন দিন কৃষি যেমন কমে যাচ্ছে, তেমনি করে পতিত জমিও বিদ্ধি পাচ্ছে। মানুষ দুর্নীতি করে জমি কিনে ফেলে রাখে, ফিউচার এসেট হিসেবে, গ্রামের মানুষও অটো চালাবে, রিক্সা চালাবে কলকারখানায় কাজ করবে তার থেকে কম মজুরুরিতে কিন্তু ক্ষেতে খামারে কাজ করবে না। ঘরে হাঁস মূরগী লালন পালন করত এখন সেটাও করে না, বাড়ি নোংড়া হবে বলে যার ফলে ডিমের দাম আকাশচুম্বী। আগের দিনে মানুষ বাড়ির ঢালুতে বেগুন, মচির, শাক সবজি চাষ করত যার ফলে পরিবারের সবজির যোগন হত এখন এগুলি চোখে পরে না।
যার ফলে দিন যত যাবে দাম তত বাড়বে, যতদিন না আমরা উৎপাদনমুখী হব তত দিন আমাদের নিস্তার নেই এই মূল্যবৃদ্ধি থেকে। বাজারে যখন ক্রেতা কমবে, যোগান বাড়বে তখন দাম এমনিতেই কমবে।
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা জুন, ২০২৩ সকাল ১১:০৮