ফেনীতে একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটকে মারধর করার ঘটনার সঙ্গে জড়িত ফেনী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. নাজিম উদ্দিনের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে প্রশাসনকে নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। আজ মঙ্গলবার বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার ও বিচারপতি খুরশীদ আলম সরকার স্বপ্রণোদিত হয়ে এই নির্দেশ দেন।
একই সঙ্গে হাইকোর্ট একজন ম্যাজিস্ট্রেটকে থানার ওসি কর্তৃক মারধর করা কেন আইনগত কর্তৃত্ব বহির্ভূত ঘোষণা করা হবে না তা জানাতে সরকারের প্রতি রুল জারি করেছেন আদালত। স্বরাষ্ট্রসচিব ও পুলিশের আইজির প্রতি এই রুল জারি করা হয়।
সুপ্রিম কোর্ট সূত্রে জানা গেছে, গতকাল দৈনিক কালের কণ্ঠে থানার ওসির হাতে একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট লাঞ্ছিত হওয়ার ঘটনায় জনপ্রশাসনে তোলপাড় শুরু হয়েছে। সচিবালয়ে কমর্রত বিভিন্ন ক্যাডারের শতাধিক কর্মকর্তা সরকারের নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে দেখা করে অভিযুক্ত পুলিশ কর্মকর্তার শাস্তি দাবি করেছেন। সচিবালয়ের বাইরে কমর্রত অনেক কর্মকর্তাও যোগ দেন তাঁদের সঙ্গে। এদিকে ম্যাজিস্ট্রেট লাঞ্ছনার বিচার না হওয়া পর্যন্ত মোবাইল কোর্ট পরিচালনা এবং অবৈধ দখলদার উচ্ছেদ কার্যক্রম পরিচালনা থেকে বিরত রয়েছেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা। বিষয়টি নিয়ে মাঠে নেমেছেন বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন এবং মাঠপ্রশাসনের কর্মকর্তারা।
কর্মকর্তারা বলেছেন, ফেনীর ঘটনায় জনপ্রশাসনের চেইন অব কমান্ড ভেঙে পড়েছে। প্রশাসনে অস্থিরতা সৃষ্টির মাধ্যমে সরকারকে বেকায়দায় ফেলে সরকারবিরোধী আন্দোলনকারীদের সুবিধা দেওয়ার অপচেষ্টা চলছে বলেও মনে করেন তাঁরা।
এদিকে ফেনীর ঘটনা তদন্তে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার পর প্রধানমন্ত্রীর জনপ্রশানবিষয়ক উপদেষ্টা এইচ টি ইমামের সঙ্গে দেখা করে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন কর্মকর্তারা। উপদেষ্টাকে জানানো হয়, ফেনীর ওসি জোট সরকারের আমলে ঢাকায় একটি গুরুত্বপূর্ণ থানার ওসি ছিলেন। তাঁর ছাত্রদলের সঙ্গে সম্পৃক্ততার বিষয়টিও তুলে ধরা হয়।
ফেনী পৌর এলাকায় খাসজমি অবৈধ দখলদারদের কাছ থেকে উদ্ধারের জন্য গত বৃহস্পতিবার অভিযান চালায় প্রশাসন। সদর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা শাহীন আখতারের নেতৃত্বে উচ্ছেদ অভিযানে অন্যদের মধ্যে অংশ নেন সদর উপজেলা ভূমি অফিসের সহকারী কমিশনার নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নজরুল ইসলামও। অভিযানের একপর্যায়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম ট্রাংক রোডের পাশে ফেনী থানা-সংলগ্ন খাসজমিতে গড়ে ওঠা অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের জন্য উপস্থিত হন তাঁরা। কিন্তু ফেনী সদর থানার ওসি মো. নাজিমউদ্দিন এবং এসআই সাইফুল ইসলামসহ সাদা পোশাকের পুলিশ উচ্ছেদে বাধা দেয়। একপর্যায়ে ম্যাজিস্ট্রেটকে শাটের্র কলার ধরে মারধর করা হয়।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার উপস্থিতিতে ম্যাজিস্ট্রেটকে মারধর করার ঘটনায় তোলপাড় শুরু হয় স্থানীয় প্রশাসনে। ঘটনার পর শুরু হয় তিন দিনের ছুটি। এর মধ্যেই উত্তপ্ত হয়ে ওঠে পরিস্থিতি। শুক্রবার ছুটির দিনেই বৈঠকে বসে বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন ফেনী জেলা শাখা। সভায় দায়ী পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মামলা করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ফেনী জেলা প্রশাসক (ডিসি) ও অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন ফেনী জেলা শাখার সভাপতি আবদুল কুদ্দুস খানের স্বাক্ষর করা সভার কার্যবিবরণী আজ জরুরিভিত্তিতে সংগ্রহ করেন জনপ্রশাসন ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।
পাশাপাশি ঢাকায় গত রবিবার কেন্দ্রীয়ভাবে জরুরি বৈঠক করে বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন। ঘটনার ভয়াবহতা টের পেয়ে ছুটির মধ্যেই চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনারকে তথ্য অনুসন্ধানের নির্দেশ দেন মন্ত্রিপরিষদসচিব। আজ সেই প্রতিবেদনও এসেছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে।
ঢাকায় বিভিন্ন ক্যাডারের কর্মকর্তারা গতকাল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে ফেনী থানার ওসি এবং এসআইকে বরখাস্ত ও গ্রেপ্তার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তাঁদের জানান, তদন্তে যদি দেখা যায়, ওসি দোষী- তাহলে অবশ্যই তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
পরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নির্দেশে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আইন ও পরিকল্পনা শাখার যুগ্ম সচিব শওকত মোস্তফার নেতৃত্বে কমিটির অন্য দুই সদস্য হলেন মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের উপসচিব আজাদুর রহমান মল্লিক এবং পুলিশ সদর দপ্তরের সিকিউরিটি সেলের এআইজি আলমগীর আলম। কমিটিকে তিন কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়।
গাজীপুর সদর উপজেলার সহকারী কমিশনার মোতাকাব্বীর আহমেদ বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের পক্ষে বক্তব্য তুলে ধরেন। ওই বক্তব্যের একটি কপি দেওয়া হয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে। বক্তব্যে ১০টি বিষয় তুলে ধরে বলা হয়, ফেনীর ঘটনায় সরকারের প্রশাসনিক কাঠামোর চেইন অব কমান্ড ভেঙে পড়েছে। প্রশাসনে অস্থিরতা সৃষ্টির মাধ্যমে সরকারবিরোধী আন্দোলনের আলামত রয়েছে। সরকারি আদেশ সরাসরি অমান্য করে সরকারকে বেকায়দায় ফেলার একটি পাঁয়তারা দেখা যাচ্ছে, যা সরকারের ভাবমূর্তি মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ন করছে। পুলিশ-ম্যাজিস্ট্রেসির ঐতিহাসিক সম্পর্ক এ ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এতে সরকারি সম্পত্তিতে বেসরকারি দখল উৎসাহিত হবে। দায়িত্বপালনকালে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের গায়ে পুলিশের হাত তোলা নজিরবিহীন ঘটনা বলে উল্লেখ করা হয়। বলা হয়, ওই ঘটনায় দায়ী পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেওয়া হলে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদেরকে দায়িত্ব পালনে নিরুৎসাহিত করা হবে। ফেনীর ঘটনায় পুলিশের ভাবমূর্তি চরমভাবে তিগ্রস্ত হয়েছে এবং পুলিশের ওপর জনগণের আস্থা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। এ ঘটনায় দণ্ডবিধির ৩৫৩ ধারা অনুযায়ী সরকারি কর্মচারীকে তাঁর কর্তব্য পালনে বাধা দিয়ে ফৌজদারি অপরাধ করা হয়েছে। সরকারি কর্মচারীর ওপর হামলা দণ্ডবিধির ৩২৩ ও ৩২৫ ধারার অপরাধ। সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা অনুযায়ী এটি অসদাচরণ।
বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব মন্ত্রিপরিষদসচিব, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিব, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবকে জানিয়েছেন- ওসি নাজিমউদ্দিন কেবল সুপ্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রাচারই ভঙ্গ করেননি বরং সুস্পষ্টভাবে রেগুলেশন, দণ্ডবিধি এবং সরকারি কর্মচারী শৃঙ্খলা ও আপিল বিধিমালার একাধিক ধারার অপরাধ করেছেন। একটি সুশৃঙ্খল বাহিনীর সদস্য হয়েও এরূপ আচরণ করে তিনি সরকারকে সংকটে ফেলার চেষ্টা করেছেন। এর বিচার না হলে সরকারি কর্মকর্তারা দায়িত্বপালনে দ্বিধাগ্রস্ত হবেন এবং সরকারের কার্যক্রম বাস্তবায়ন ব্যাহত হবে বলেও সতর্ক করা হয়।
এদিকে মন্ত্রিপরিষদসচিবের নির্দেশনা পেয়ে শনিবার অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার নুরুল ইসলামকে ঘটনাস্থলে পাঠান বিভাগীয় কমিশনার। অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের জবানবন্দি নেন এবং ঘটনার সত্যতা পান। তিনি প্রতিবেদনে জানান, সরকারি বিধি অনুযায়ী উচ্ছেদকাজে নিয়োজিত কর্মকর্তাদের ওপর থানার ওসির হাত তোলা ও জামাকাপড় ছেঁড়া কোনোভাবেই কাম্য নয়। অভিযুক্ত ওসির বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করেন তিনি।
বর্তমান সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর শুরুর দিকে পাবনায় এমপি ও ডিসির বিরোধে প্রশাসনে তোলপাড় হয়েছিল এবং ফেনীর ঘটনা যেন বড় আকার ধারণ করতে না পারে, এ জন্য প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তারা তৎপর হয়েছেন।
আজ কর্মকর্তারা এইচ টি ইমামের সঙ্গে দেখা করে ফেনীর ডিসির ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন। কয়েকজন কর্মকর্তা ওসির বিরুদ্ধে মামলা করার জন্য নির্দেশনা চান। এইচ টি ইমাম কর্মকর্তাদের বলেন, দেখতে হবে কেউ সরকারকে বিব্রত করার জন্য এসব করছে কি-না। পরে এইচ টি ইমাম কালের কণ্ঠকে বলেন, তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। প্রয়োজনে সাসপেন্ড করা হবে। ওই ঘটনায় পুলিশ ও প্রশাসন মুখোমুখি কি না জানতে চাইলে সরাসরি জবাব না দিয়ে তিনি বলেন, এখানে কারো ইন্ধন রয়েছে কি না, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
বিক্ষুব্ধ কর্মকর্তারা মন্ত্রিপরিষদসচিব ও সংস্থাপন সচিবের সঙ্গে দেখা করেও দোষীদের শাস্তি দাবি করেন।