somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

দেড় ব্যাটারি’র বিশ্বকাপ

১৪ ই জুন, ২০১৪ সকাল ১১:৩৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

সমুদ্র শহর কক্সবাজারের বার্মিজ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ক্লাস ফাইভের ছেলেদের মনে আজকে মহা আনন্দ। আজকে অংক স্যারের বাবা মারা গেছেন! শহরে মাইকিং করে বলা হয়েছে- একটি শোক সংবাদ। অদ্য সকাল দশ ঘটিকার সময়, বার্মিজ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সুজা মাষ্টারের পিতা, জনাব রায়হান আলী মিয়া ইন্তেকাল ফরমাইয়াছেন। ইন্না লিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজেওন।

সুজা স্যার অন্তত চারদিন স্কুলে আসবেন না। বার্মিজ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ক্লাস ফাইভের ছেলেদের জীবনে এর চেয়ে বেশি আনন্দের ঘটনা ঘটা সম্ভব না।অঙ্ক পিরিয়ডে ক্লাস রুমের দরজা বন্ধ করে দিয়ে সেই আনন্দ তারা এখন উপভোগ করছে।

ফরহাদ কে এই মুহুর্তে দেখা যাচ্ছে ব্ল্যাক বোর্ডের সামনে গোল কিপারের ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। ক্লাসের সবচেয়ে পুংটা হানিফ ক্লাসের ‘দেড় ব্যাটারি’ মিন্টো কে ফুটবল বানিয়ে 'ফ্লান্টিক' নিচ্ছে! ক্লাসে সবচে ছোটখাট মিন্টো পাওয়ার চশমা পরে বলে ওকে সবাই দেড় ব্যাটারি ডাকে! আর ফ্লান্টিক মানে হল পেনাল্টি কিক। মিন্টো উবু হয়ে বসে হাঁটুর মধ্যে মাথা ঢুকিয়ে শরীর টাকে প্রায় ফুটবল শেপে নিয়ে এসেছে। স্লো মোশান দৌড়ের ভঙ্গিতে হানিফ ছুটে আসছে ‘ফ্লান্টিক’ নেবার জন্য। হানিফ নাকি আজকে মেরাডোনা’র মত ফ্লান্টিক মারবে। মেরাডোনা একদিকে ফ্লান্টিক মারলে গোলি(গোল কিপার) নাকি অন্য দিকে লাফ দেয়!

মেরাডোনা নামটাই শরীরে একটা শিহরন বইয়ে দেয় মিন্টো’র। মিন্টো আগে পেলে’র নাম শুনেছে।পেলে নাকি মাঠের মাঝখান থেকে বল নিয়ে কিক মারলে সেই বল গোলি’র মাথার উপর দিয়ে উড়ে গিয়ে গোলে পড়ত !! এখন আবার মেরাডোনার নাম শুনতেছে। মেরাডোনা কে নাকি কেউ ল্যাং মেরে ফেলতে পারে না। পাঁচ ছ’জন বেগি(ডিফেন্ডার) কে কাটিয়ে একা একাই নাকি গোল দিয়ে দেয়!

মেরাডোনার ছবি মিন্টো স্কুলের খাতায় দেখেছে। বিশ্বকাপ খেলা আসছে দেখে আজটেকা স্টেডিয়াম আর মেরাডোনার ছবি ওয়ালা খাতা বাজারে বেরিয়ে গেছে। আল আমিন লাইব্রেরি’তে সেই খাতা পাওয়া যায়। মেরাডোনা’র ছবি দেখে মিণ্টো কল্পনা করার চেষ্টা করেছে পাঁচ ছজন বেগি কে কাটিয়ে মেরাডোনা কেমনে গোল দেয়! কল্পনা করা ছাড়া অবশ্য মিন্টোর অন্য উপায় নাই। কারন মিন্টোদের বাসায় টিভিই নাই!

পাছায় প্রচণ্ড লাথি খেয়ে সংবিৎ ফেরে মিন্টোর! সে প্রায় শূন্যে উড়ে যায় এবং ফরহাদ তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে!

ফরহাদ মিন্টো কে জাপটে ধরেছে আর হানিফের দিকে তাকিয়ে ক্লাসের বাকী সবাই খেঁক খেঁক করে হাসছে- শালা বালের মেরাডোনা আইছছ! ফ্লান্টিক মেরেও গোল করতে পারছ না!’

স্কুল ছুটি হবার পর বাসার দিকে হাঁটতে হাঁটতে গায়ে একটা কাঁপুনি অনুভব করে মিন্টো। আজকেও নাকি মেরাডোনার খেলা আছে! কাতুকুতো মনির( ক্লাসের ছেলেদের মধ্যে মনিরের কাতুকুতু সবচেয়ে বেশি!) বলেছে- মেরাডোনা আজকেও নাকি পাঁচ ছ’জন বেগি কে কাটিয়ে একাই গোল দেবে! হাঁটতে হাঁটতেই আসে পাশের জগত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় মিন্টো। সে কল্পনায় স্পষ্ট দেখতে পায়- আজটেকা স্টেডিয়ামে নিজের দলের গোলি’র থেকে মেরাডোনা বল নিল। তারপর অন্য দলের গোলি’র দিকে খিঁচে দৌড়! অন্য দলের বেগি’ রা একে একে মেরাডোনার দিকে দৌড়ে আসছে। মেরাডোনার থেকে বল কেড়ে নিতে চাচ্ছে। কিন্তু মেরাডোনা একজন কে দক্ষিণ দিকে কাটিয়ে দেয় ত আরেকজন কে উত্তর দিকে কাটিয়ে দেয়! সবগুলো বেগিকে কাটিয়ে মেরাডোনা গোলির সামনে চলে এসেছে। চান্দিছোলা গোলি টা( মিন্টো তার কল্পনায় স্পষ্টতই কাল্পনিক গোল কিপারের টাক দেখতে পাচ্ছে!) ভয়ে ভয়ে সামনের দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। মেরাডোনা চান্দিছোলার মাথার উপর দিয়ে প্রচণ্ড কিক মারল! গোওওওল!!

মেরাডোনার কিক খেয়ে ফুটবল নেটে আছড়ে পড়ল। আর পেছন থেকে প্রচণ্ড গতিতে ছুটে আসা রিকশার ধাক্কা খেয়ে ছোটখাট মিন্টো বই খাতা সহ পড়ে গেল রাস্তার পাশের নালার মধ্যে! নালা থেকে হাঁচোড় পাচোড় করে যখন মিন্টো উঠল তখন দেখা গেল মিন্টোর কপালের বাম পাশটায় আলু উঠে গেছে! আছাড় খাবার সময় কপালের বাম পাশ টা নালার পাকা দেয়ালের সাথে প্রচণ্ড বাড়ি খেয়েছে। আর টিটনি কলমের নিবের খোঁচায় ডান হাত কেটে রক্ত বেরিয়েছে। টিটনি কলম ভেসে গেছে ড্রেনের মধ্যে! মিন্টোর বুক হু হু করে কেঁপে উঠল। বাসায় আরেকটা টিটনি কলম কিনে দেবার কথা এখন সে কিভাবে বলবে!

সন্ধ্যার দিকে মিন্টোর গায়ে প্রচণ্ড জ্বর আসল। মিন্টো কাউকে কিছু না বলে একা একা চলে গেল বাসার দেয়ালের পিছন দিকে।মিন্টোদের একতলা বাড়ির এদিকটা নির্জন। এদিকটায় বাড়ির দেয়াল জুড়ে প্রকাণ্ড মাধবী লতার ঝাড়। মাধবী ফুলের মাতাল করা গন্ধে চারদিক ম ম করছে। মাধবী লতার ঝাড় যেখানে ঘন সেখানকার দেয়াল ফুঁড়ে লাল লাল ইটের টুকরা বেরিয়ে আছে। ছাদে উঠতে হলে এই অর্ধেক বেরিয়ে থাকা আধলা ইট বেয়েই উঠতে হবে।

মিন্টোদের একতলা বাড়িতে ছাদে যাবার কোন সিঁড়ি নাই। ছাদে যাবার জন্য দেয়াল ফুঁড়ে বেরিয়ে থাকা এই আধলা ইট ই ভরসা। আধলা ইট বেয়ে ছাদে উঠার কথা মিন্টো আগেও ভেবেছে। কিন্তু সাহসে কুলায় নাই।আজকে মাধবী ফুলের পাগল করা গন্ধ এবং জ্বরের প্রবল ঘোর মিন্টো’র ভয়ের অনুভূতি গুলোকে কেমন যেন অবশ করে দিয়েছে ।ভয়ের অবশ অনুভূতি’র জায়গা দখল করে নিয়েছে কল্পনার প্রখর অনুভূতি!তার মনে হচ্ছে তাদের একতলা বাড়ির ছাদটা আজটেকা স্টেডিয়াম(!) এবং আজটেকা স্টেডিয়ামে’র উপরে উঠলেই মেরাডোনার সাথে দেখা হবে!
লাল আধলা ইটের ছোট ছোট ধাপের একটা খপ করে দু’হাত দিয়ে ধরে ফেলে মিন্টো! ইটের ধাপ প্রচণ্ড ঠাণ্ডা এবং পিচ্ছিল! পায়ের স্পঞ্জের স্যান্ডেল ‘ফ্লান্টিক’ মারার ভঙ্গিতে দুইটা দুই দিকে ছুড়ে দেয় মিন্টো। তারপর পা বাঁকিয়ে খুব সাবধানে স্থাপন করে লাল ইটের শ্যাওলা জমা পিচ্ছিল ধাপের উপর!কাঁপা কাঁপা কাঁপা দুহাতের এক হাত প্রথমে আরো উপরের ধাপে যায়। তারপর আরেক হাত। একই ভাবে কাঁপা কাঁপা দু’পায়ের এক পা প্রথমে উপরের ধাপে যায়। তারপর আরেক পা। প্রত্যেক ধাপ অতিক্রমের সাথে মেরুদণ্ড দিয়ে বয়ে চলে শীতল বাতাস!

মিন্টো যখন ছাদের উপরে পৌঁছল তখন সন্ধ্যা ঘনিয়েছে। অস্তগামী সুর্য আকাশজুড়ে লাল রঙ ছড়িয়ে দিয়েছে এবং নিকটস্থ বাজারের মসজিদের হুজুর মাগরিবের আজান দেবার জন্য মসজিদের পুকুরে ওজু করতে বসেছেন। মিন্টো পরিষ্কার অনুভব করে সে এখন বাড়ির ছাদে নয়, আজটেকা স্টেডিয়ামে আছে! আজকে এখানে দুই দলের মধ্যে খেলা হবে। একদলের ‘কেপ্টিন’ মেরাডোনা। আরেক দলের ‘কেপ্টিন’ মিন্টো!!

আবছা অন্ধকারে ছাদের উপর একটা ছোট্ট ইটের টুকরা খুঁজে পাওয়া গেল। সেই ইটের টুকরা(ফুটবল!) টা ছাদের মাঝখানে(মাঝ মাঠে!) এনে বসাল মিন্টো। ঠিক সেই সময় আজান দেবার জন্য বাজারের মসজিদের হুজুর মাইকে ফুঁ দিলেন! সেটাই রেফারি’র খেলা শুরুর বাঁশি হয়ে কানে বাজল মিন্টোর। বাঁশি বাজার সাথে সাথে মিন্টো বল নিয়ে ছোটা শুরু করল! মিন্টোর সামনে মেরাডোনার দলের তিন চার জন বেগি। বেগি গুলার পিছনে মেরাডোনা! বেগি গুলোকে কাটিয়ে দিয়ে মেরাডোনার অন্যপাশ দিয়ে ছুটতে চাইল মিন্টো। কিন্তু কিসের কি! মেরাডোনা লাফ দিয়ে মিন্টোর সামনে পড়ল! ধুম করে বল কেড়ে নিল মিন্টোর থেকে। তারপর বল নিয়েই ছুটতে লাগল গোলের দিকে!

মিন্টোদের দলের গোলি গোলের সামনে দাঁড়িয়ে খামাকাই এদিক ওদিক পাছা নাড়াচ্ছে। মিন্টো বিদ্যুৎ বেগে ছুটে গেল সেদিকে। মেরাডোনা কিক মেরে দিয়েছে প্রায়! কিন্তু বিদ্যুৎ গতিতে মেরাডোনার সামনে পৌঁছে গেছে মিন্টো! মেরাডোনার কিক মারা বল মিন্টোর মাথায় লেগে চলে গেছে মিন্টোর দলের প্লেয়ার বেলালের(!)র পায়ে। বেলাল বল নিয়ে ছুটছে! মেরাডোনা কে পিছনে রেখে মিন্টো সামনের দিকে খিঁচে দৌড় দিল।
খেলায় মিন্টোর দল তিন দুই গোলে জিতল! মেরাডোনার দলে দুইটা গোল ই করেছে মেরাডোনা। আর মিন্টুর দলে মিন্টু দুইটা, বেলাল একটা!
সেদিন আকাশে চাঁদ ছিলনা। তারাগুলোর বেশির ভাগ ও ঢেকে গিয়েছিল অনাহুত মেঘে! কাজেই মিন্টো যখন বাস্তবে ফিরল তখন অন্ধকার ছমছম করছে কক্সবাজার শহরের একটি নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের একতলা বাড়ির অসম্ভব নির্জন ছাদে ।

প্রবল জ্বরে মিন্টোর গা কাঁপছে। সে জানে ছাদের কিনারার কোন না কোন অংশে আধলা ইটের সিঁড়ি টা ঠিক ই আছে।হাতড়ে হাতড়ে সেটা হয়ত খুঁজে বের ও করা যাবে। কিন্তু এই অন্ধকারে সেটা দিয়ে কিভাবে নিচে নামবে সেই ব্যাপারে মিন্টোর কোন ধারনা নাই!

০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

৫০১–এর মুক্তিতে অনেকেই আলহামদুলিল্লাহ বলছে…

লিখেছেন বিচার মানি তালগাছ আমার, ০৩ রা মে, ২০২৪ বিকাল ৩:০০



১. মামুনুল হক কোন সময় ৫০১-এ ধরা পড়েছিলেন? যে সময় অনেক মাদ্রাসা ছাত্র রাজনৈতিক হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছিল। দেশ তখন উত্তাল। ঐ সময় তার মত পরিচিত একজন লোকের কীভাবে মাথায় আসলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঝিনুক ফোটা সাগর বেলায় কারো হাত না ধরে (ছবি ব্লগ)

লিখেছেন জুন, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ৮:০৯

ঐ নীল নীলান্তে দূর দুরান্তে কিছু জানতে না জানতে শান্ত শান্ত মন অশান্ত হয়ে যায়। ১৯২৯ সালে রবার্ট মোস নামে এক ব্যাক্তি লং আইল্যান্ড এর বিস্তীর্ণ সমুদ্র... ...বাকিটুকু পড়ুন

মেহেদীর পরিবার সংক্রান্ত আপডেট

লিখেছেন ইফতেখার ভূইয়া, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ৮:৪৯


মার্চ মাস থেকেই বিষয়টি নিয়ে ভাবছিলাম। ক'দিন আগেও খুলনায় যাওয়ার ইচ্ছের কথা জানিয়েও আমার বিগত লিখায় কিছু তথ্য চেয়েছিলাম। অনেক ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও মেহেদীর পরিবারকে দেখতে আমার খুলনা যাওয়া হয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

'চুরি তো চুরি, আবার সিনাজুরি'

লিখেছেন এমজেডএফ, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৮


নীলসাধুকে চকলেট বিতরণের দায়িত্ব দিয়ে প্রবাসী ব্লগার সোহানীর যে তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছিল তা বিলম্বে হলেও আমরা জেনেছি। যাদেরকে চকলেট দেওয়ার কথা ছিল তাদের একজনকেও তিনি চকলেট দেননি। এমতাবস্থায় প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বরাবর ব্লগ কর্তৃপক্ষ

লিখেছেন নীলসাধু, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১১:২২

আমি ব্লগে নিয়মিত নই।
মাঝে মাঝে আসি। নিজের লেখা পোষ্ট করি আবার চলে যাই।
মাঝেমাঝে সহ ব্লগারদের পোষ্টে মন্তব্য করি
তাদের লেখা পড়ি।
এই ব্লগের কয়েকজন ব্লগার নিজ নিক ও ফেইক... ...বাকিটুকু পড়ুন

×