somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

রাজনীতিতে পানির সংকেত হল H2OP4। এখানে P4 হল- Pollution, Power, Politics & Profit। হাইড্রো-ডিপ্লোম্যাসিতে এটাই হচ্ছে পানি।

২৮ শে ডিসেম্বর, ২০২১ সকাল ৯:২৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আমরা জানি, পানির সংকেত H2O। কিন্তু রাজনীতিতে পানির সংকেত হল H2OP4। এখানে P4 হল- Pollution, Power, Politics & Profit। হাইড্রো-ডিপ্লোম্যাসিতে এটাই হচ্ছে পানি। তিস্তা নদীর পানি ভাগাভাগি নিয়ে সাধারণত সবাই মমতা বন্দোপাধ্যায় আর পশ্চিমবঙ্গকেই দোষারোপ করে থাকি। এমনকি দিল্লি ও ঢাকাও মমতা বন্দোপাধ্যায়ের উপরেই দোষ চাপিয়ে খালাস করে দিচ্ছি ব্যাপারটা। আমাদের দাবি যে প্রবাহমান পানি ফিফটি ফিফটি ভাগাভাগি করতে হবে। কিন্তু আসলে তা সম্ভব নয়। পানির মধ্যে শুধু পানিই থাকে না বরং আরো বেশ কিছু উপাদান থাকে, যেমন ফোনা, পলি। এবং সবচেয়ে বড় কথা এখানে পশ্চিমবঙ্গ আর মমতা বন্দোপাধ্যায়ের উপর দায় বসানোটাও ঠিক হালাল ব্যাপার নয়। নানান বিষয় চলে আসে যায় সামনে।

প্রথমে দেখি নদীর পানি ভাগাভাগির ব্যাপারটা। প্রফেসর ইমতিয়াজ আহমেদের মতে, নদী বলতে শুধু পানিসম্পদ নয়। আরো অনেক কিছু। উপনিষদ বলছে, এটা রক্তের ধমনি। তিনটি বিষয় থাকতে হবে। আত্মা, প্রাণ ও শক্তি (Atman, Prana & Shakti)। পানি ভাগাভাগি বা পানি নিয়ে কাজ করার সময় চারটি বিষয়ের কথা মাথায় রাখতে হবে, এগুলোকে বলে চারটি উপাদান বা ‘ওয়েবস’ (WEBs) - ওয়াটার, এনার্জি, বায়োডাইভারসিটি ও সেডিমেন্ট (Water, Energy, Bio-diversity & Sediment)। আমরা যখন পানির ন্যায্য হিস্যার কথা বলি, তখন শুধু পানির কথা বলি। সুতরাং নদী বিষয়ে সবার দৃষ্টিভঙ্গিতে আমূল পরিবর্তন আনতে হবে। অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, “পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আয়োজিত হাইড্রোডিপ্লোম্যাসির কোর্সে বলেছি, আপনারা যখন পানি আলোচনায় অংশ নেবেন, বলবেন, সেডিমেন্ট (পলি) ও জীববৈচিত্র্য কী করে ভাগ হবে। তখন তাঁরা বুঝবেন, এটা অসম্ভব। তখনই একটি বেসিন বা অববাহিকা অ্যাপ্রোচ সামনে আসবে। সেখানে ভুটান, নেপাল ও দরকারে চীনকেও আনতে হবে। ব্রহ্মপুত্রের মাত্র ১৮ শতাংশ পানি হিমালয় থেকে আসে। বাকি ৮২ শতাংশ পানিই বৃষ্টির। তবে ওই ১৮ শতাংশ অবশ্যই খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের বড় মাপের হাইড্রোলজিস্ট আছে, সেডিমেন্টলজিস্ট নেই”।

এরপরে যে বিষয়টা এসে যায় সেটা হল তিস্তা চুক্তি। যদিও ঢাকা-দিল্লিসহ সবাই মমতা বন্দোপাধ্যায়ের উপর দোষ চাপিয়ে দেই কিন্তু এখানে আরো অনেক ব্যাপার আছে, এটা একতরফা মমতা বা পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ব্যাপার না। বিজেপি আর কংগ্রেস যতই তৃণমূল কংগ্রেসকে দোষারোপ করুক না কেন তারা যদি পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতায় যায় তবু এই চুক্তির ব্যাপারে খুব বেশি কিছু হবে না। এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটা ফ্যাক্টর হল ‘সিকিম’ রাজ্য। মমতা বন্দোপাধ্যায় বলছেন যে, পানি তো নেই। আমরা নিজেরা পানি না পেলে কোথা থেকে পানি দেবো? আর ভাগাভাগির বিষয় যে আসছে সেটার কিসের উপর ফিফটি ফিফটি ভাগাভাগি হবে? আমারা যতটুকু পাচ্ছি সেটার নাকি মোট পানির? মমতা বলছেন, আমি কিসের ফিফটি ফিফটি দেব। ফুল গ্লাসের নাকি হাফ গ্লাসের নাকি জিরো গ্লাসের।

হিন্দু পুরাণ অনুসারে এটি দেবী পার্বতীর স্তন থেকে উৎপন্ন হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে নদীটির বাংলা নাম তিস্তা এসেছে ‘ত্রি-স্রেতা’ বা ‘তিন প্রবাহ’ থেকে। তিস্তা নদীর উৎস উত্তর সিকিমের হিমালয় পর্বতমালার ৫,৩৩০ মি (১৭,৪৮৭ ফু) উচ্চতায় অবস্থিত সো লামো হ্রদে। হ্রদটি শেসচেনের কাছে ডোংখা গিরিপথের উত্তরে অবস্থিত। তিস্তার পানি যেহেতু সিকিম দিয়ে আসছে, এখানে সবচেয়ে বড় সমস্যার সৃষ্টি করে সিকিম সরকার নিজেই। সিকিমে সরকার তিস্তা নদীর পানিতে অনেকগুলি বাঁধ তৈরি করেছে। ফলে পানি তারাই আটকে রেখেছে। এতে পশ্চিমবঙ্গ নিজেরাই পানি পাচ্ছে না। তিস্তার জল দিয়ে ন’লক্ষ হেক্টর জমিকে সেচসেবিত করে তুলতে চায় পশ্চিমবঙ্গ। আর বাংলাদেশ চায় সাত লক্ষ হেক্টর জমিতে সেচের জল দিক তিস্তা। নদী-বিশেষজ্ঞদের মতে, এই ১৬ লক্ষ হেক্টর জমিতে সেচের জন্য নদীর জল দিতে গেলে শুষ্ক মৌসুমে তিস্তায় প্রতি সেকেন্ডে ১৬০০ ঘন মিটার জল থাকা দরকার। অথচ এখন থাকে প্রতি সেকেন্ডে ১৫০-২০০ ঘন মিটার জল। সিকিমে তিস্তার উপরে তৈরি জলবিদ্যুৎ প্রকল্প থেকে ছাড়া জল পশ্চিমবঙ্গের তিস্তা ব্যারাজ ধরে রাখতে পারে না। অর্থাৎ সেচের জন্য তিস্তার কাছে যতটা জল প্রত্যাশা করা হচ্ছে, বাস্তব অবস্থার সঙ্গে সেই চাহিদা মোটেই সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় বলে মনে করছেন নদী-বিশেষজ্ঞেরা।

তিস্তা নদীর পানি বিষয়ে মমতা বন্দোপাধ্যা ও পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তৈরি কমিশনের দায়িত্বে ছিলেন ভারতের নদী বিশেষজ্ঞ, কল্যাণ রুদ্র। কল্যাণ রুদ্রের রিপোর্টেও সিকিমের এই বাঁধ দিয়ে পানি আটকে রাখার ব্যাপারে বলা হয়েছে এবং সেখান থেকে দেখা যাচ্ছে পশ্চিমবঙ্গ বা মমতা বন্দোপাধ্যায় নয় বরং সিকিমই হচ্ছে আসল বাঁধা এই চুক্তির ব্যাপারে। কিন্তু কল্যাণ রুদ্রের রিপোর্টটি শেষ পর্যন্ত প্রকাশ পায়নি। সিকিমের ওই বাঁধগুলো বন্ধ করা ছাড়া শুধুমাত্র পশ্চিমবঙ্গের সাথে তিস্তা নিয়ে কোন চুক্তি করাতে বাংলাদেশের কোন লাভই হবে না। আবার সিকিম বর্তমানে ভারতের অর্থনীতি, ইকোলজি ও বায়োডাইভার্সিটির জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটি রাজ্য। তাই সিকিমের সাথে দরকষাকষি একটি সহজ বিষয় নয় ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারে পক্ষে। তো এখানে পশ্চিমবঙ্গের দিকে বা মমতার দিকে আঙ্গুল তোলার আগে আমাদের আবার ভেবে দেখতে হবে। আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করতে হবে। মাথায় রাখতে হবে তিস্তা নদীর পানি বণ্টন শুধু আমাদের জন্য নয় বরণ পশ্চিমবঙ্গের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। আর স্বভাবতই মমতা বন্দোপাধ্যায় নিজের রাজ্যের স্বার্থ বাদ দিয়ে অকাতরে বাংলাদেশকে পানি বিলিয়ে দেবেন না। এমনকি সিকিমের এই বাঁধের জন্য শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয় বরং বিহারেও নানা সমস্যা হচ্ছে।

এখন এই প্রেক্ষিতে সিকিমের সাথে দরকষাকষি বা নেগোসিয়েশনের জন্য কি কি বিষয় মাথায় রাখা প্রয়োজন আর বাংলাদেশ সরকার সিকিমের সাথে দরকষাকষির ব্যাপারে কি কি উদযোগ নিচ্ছে বা আদৌ নিচ্ছে কি না সে ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এই প্রশ্নগুলো আমি ইমতিয়াজ আহমেদ স্যারকে করেছিলাম হাইড্রো-ডিপ্লোম্যাসির ক্লাসে। প্রথমত স্যার বললেন যে, সিকিমের সাথে দরকষাকষির ব্যাপারে বাংলাদেশের তেমন কিছু করার নেই। বাংলাদেশকে সিকিমের বাঁধের ইস্যুগুলোকে বিবেচনায় নিয়ে সেটাকে দিল্লীর উপর চাপ দিতে হবে। দিল্লী কোন চাপ অনুভব করছে না ফলে তারাও সিকিমের সাথে কোন দরকষাকষিতে যাচ্ছে না। ঢাকা এবং পশ্চিমবঙ্গকে সমন্বিতভাবে দিল্লীর উপর চাপ প্রয়োগ করতে হবে। সরাসরি সিকিমের সাথে বাংলাদেশ দরকষাকষি করতে পারে না।

এবং দিল্লীর উপর চাপ প্রয়োগের জন্য বাংলাদেশ কি কি করতে পারে? এ ব্যাপারে স্যার বলেন যে, প্রথমত যত লবি গ্রুপ আছে সেগুলোকে কাজে লাগাতে হবে। ভারত-বাংলাদেশ একে অপরের উপর নানা দিক থেকে নির্ভরশীল। সেক্ষেত্রে লবি গ্রুপগুলোই পারে বড় ভূমিকা রাখতে। একই সাথে নানা ধরণের কনফারেন্স-সেমিনারে আয়োজন করতে হবে। এটা শুধু বাংলাদেশেই নয় বরং একই সাথে ভারতসহ আন্তর্জাতিকভাবে এসব কনফারেন্স-সেমিনারের আয়োজন করতে হবে। এবং সিভিল সোসাইটি যত সংগঠন আছে সেগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে। ভারতের জনগণও কিছু জানছে না। তারা সরকারের কথাই শুনছে যেটা স্বাভাবিক। এজন্য ভারতের জনগণের কানেও সঠিক খবরটি পৌছানোর দায়িত্ব নিতে হবে। তাদের সামনে সঠিক ইস্যুটি তুলে ধরতে হবে। এক্ষেত্রে মিডিয়া এবং সিভিল সোসাইটি সংগঠনগুলোই পারে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখতে।

এর আগে সম্ভবত ২০১০ সালে প্রধানমন্ত্রী যখন ভারত সফর করেন তখন এই চুক্তি সাক্ষরের ব্যাপারে বেশ অগ্রগতি হয়েছিল কিন্তু পরে মমতা সেটা আর সাক্ষর করেননি। পশ্চিমবঙ্গে যতই ইলিশ পাঠাই আমরা আদৌ সেটা কোন কাজে দিবে না। বরং এই ইলিশ পাঠাতে হবে সিকিমে, তাও যদি তারা এই বাঁধগুলো বন্ধ করে। তাতে বাঁচতে পারে বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গ, ভারতের পশ্চিমবঙ্গ এবং বিহার রাজ্য।

দোহাইঃ প্রথম আলো, ডেইলি স্টার, আনন্দবাজার পত্রিকা এবং অধ্যাপক ইমতিয়াজ স্যারের লেকচার।
লেখক : আব্দুস সামী
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে ডিসেম্বর, ২০২১ সকাল ৯:২৮
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

সবুজ চোখের মানুষের ধাঁধা

লিখেছেন করুণাধারা, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:২৯



এই ধাঁধার নাম সবুজ চোখের মানুষের ধাঁধা; নিচের লিংকে এটার ভিডিও আছে।

স্বৈরশাসকের বন্দী

এই ধাঁধাটি আমার ভালো লেগেছিল, তাই অনেক আগে আমার একটা পোস্টে এই ধাঁধাটি দিয়েছিলাম। কিন্তু সেই পোস্টে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বৃদ্ধাশ্রম।

লিখেছেন নাহল তরকারি, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:১৬



আগে ভিডিওটি দেখে নিন।

মনে করেন, এক দেশে এক মহিলা ছিলো। একটি সন্তান জন্ম দেবার পর তার স্বামী মারা যায়। পরে সেই মহিলা পরের বাসায় কাজ করে সন্তান কে... ...বাকিটুকু পড়ুন

টের পেলে

লিখেছেন সাইফুলসাইফসাই, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:৫৭

টের পেলে
সাইফুল ইসলাম সাঈফ

টের পেলে গুটিয়ে যায় লজ্জাবতী/ পরিপূর্ণ যৌবনে যুবতীর নিখুঁত অনুভূতি। আমার চাওয়া, ইচ্ছে, স্বপ্ন! আমার পছন্দ বুঝদার, সুন্দর হৃদয়ের রূপ! সৌন্দর্য সুন্দর যা চিরন্তন সত্য। কিন্তু সেটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইসলামের চার খলিফার ধারাবাহিকতা কে নির্ধারণ করেছেন?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১০:৩৭




সূরাঃ ৩ আলে-ইমরান, ২৬ নং আয়াতের অনুবাদ-
২৬। বল হে সার্বভৈৗম শক্তির (রাজত্বের) মালিক আল্লাহ! তুমি যাকে ইচ্ছা ক্ষমতা (রাজত্ব) প্রদান কর এবং যার থেকে ইচ্ছা ক্ষমতা (রাজত্ব)... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রতিদিন একটি করে গল্প তৈরি হয়-৩৭

লিখেছেন মোঃ মাইদুল সরকার, ০১ লা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৫১




ছবি-মেয়ে ও পাশের জন আমার ভাই এর ছোট ছেলে। আমার মেয়ে যেখাবে যাবে যা করবে ভাইপোরও তাই করতে হবে।


এখন সবখানে শুধু গাছ নিয়ে আলোচনা। ট্রেনিং আসছি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×