পাঠক বা দর্শক কী নিয়ে ভাববে বা তাদের আলোচনার বিষয়বস্তু কী হবে মিডিয়া তা নির্ধারণ করে দেয়। একে গণমাধ্যমের আলোচ্যসূচি নির্ধারণ সংক্রান্ত তত্ত্ব বলা হয়।
বুৎপত্তিগতভাবে, গণমাধ্যমের আলোচ্যসূচি নির্ধারণ তত্ত্ব হল সাধারণ জনগণের জন্য গণমাধ্যমের সৃষ্ট একটি আলোচনার বিষয়।
তত্ত্বগতভাবে, গণমাধ্যমের আলোচ্যসূচি নির্ধারণ বলতে বোঝায় অনেক গুলি বিষয় থেকে আলোচনার নির্দিষ্ট কিছু বিষয় নির্ধারণ করা।
উদাহরণ
প্রথম আলো ‘দুই নেত্রীকে সড়াতে হবে’ যে সংস্কার আন্দোলনের ডাক দিয়েছিল তা তখন সাধারণ জনগণের প্রধান আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে দাড়িয়েছিল।
ঠিক তেমনি আজ যখন গণমাধ্যমগুলো নাফিসের বোমা হামলার পরিকল্পনা, পদ্মা সেতু বা হলমাকর্ কেলেঙ্কারী, আবুল হোসেন-সুরুঞ্জিতের পদত্যাগ, তৃতীয় শক্তির উত্থানের আশংকা ইত্যাদি বিষয়ে গুরুত্ব দিচ্ছে তখনই ইস্যুগুলো সাধারণ জনগণের আলোচনার বিষয়বস্তু হিসেবে নির্ধারিত হচ্ছে।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, ধর্মভিত্তিক রাজনীতি ইত্যাদির বিরুদ্ধে গণমাধ্যম সোচ্চার থাকায়, এ বিষয়টি নিয়ে জনগণের আলোচনার াবষয়বস্তু হয়ে দাড়িঁয়েছে।
গণমাধ্যমের আলোচ্যসূচি নির্ধারণ তত্ত্ব নিয়ে গবেষণা
গণমাধ্যমের আলোচ্যসূচি নির্ধারণ তত্ত্বের বেশ কয়েকটি তত্ত্বের মধ্যে “চ্যাপেল হিল স্টাডি” ও এর সমালোচনামূলক একটি গবেষণা “মিডিয়া এজেন্ডা ও বাস্তবতা” তুলে ধরা হল:
“চ্যাপেল হিল স্টাডি”
যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ক্যারোলিনা অঙ্গরাজ্যের ‘চ্যাপেল হিল’ নামক স্থানের সিদ্ধান্তহীন ভোটারদের নিয়ে গবেষণা করা হয়।
ক্স তারা গণমাধ্যম ব্যবহারকারী এমন ১০০ জনকে বাছাই করে নেয়।
ক্স এরপর ৫টি সংবাদপত্র, ২টি ম্যাগাজিন এবং সিবিএস ও এনবিসি টেলিভিশন চ্যানেলের সংবাদকে বেছে নেন।
ক্স ১০০ জনকে ৪টি প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল-
১. দেশের প্রধান সমস্যা কী ?
২. নির্বাচনী প্রচারণার প্রধান ইস্যু কী ?
৩. প্রার্থীদের কোন বিষয়ে গুরুত্ব দিয়ে বলা উচিত ?
৪. তাদের পছন্দের প্রার্থী কে ?
এদেরকে ১৫ টি বিষয়ে ভাগ করা হয়। পরবর্তীতে দেখা যায়, সেই ১৫টি বিষয় থেকে ৫টি বিষয় প্রধান ইস্যুতে পরিণত হয়।
ফলাফল: এ সময় তারা দেখে গণমাধ্যমে প্রচারিত ইস্যুগুলোই তাদের কাছে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে। ফলে এ গবেষণায় গণমাধ্যমের আলোচ্যসূচি নির্ধারণ তত্ত্বের পক্ষে মত দেয়া হয়।
“মিডিয়া এজেন্ডা ও বাস্তবতা”
১৯৬০ এর দশকে আমেরিকার জনগণের কাছে কোন ইস্যুটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও তা মিডিয়ার এজেন্ডা কি’না তা জানতে এ গবেষণাটি করেন।
আমেরিকার জনগণের কাছে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল-
‘আমেরিকার প্রধান সমস্যা কী? ’
১৯৬০ সালে প্রকাশিত তিনটি সাপ্তাহিক পত্রিকার আধেয় বিশ্লেষণ করেন; সেই সাথে প্রশাসনিক তথ্য সংগ্রহ করেন।
ফলাফল: এ সময় দেখা যায়, মিডিয়ার ১ম ও ২য় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় দুটি ছিল যথাক্রমে ভিয়েতনাম যুদ্ধ ও জাতিগত দ্বন্দ্ব। যা জনগণের কাছে এবং প্রশাসনিকভাবেও সমান গরুত্ব পায়। কিন্তু প্রশাসনিকভাবে ৩য় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল অপরাধ অন্যদিকে মিডিয়ার কাছে এটি ছিল ৬ষ্ঠ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, ৩য় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাস।
অর্থাৎ এ তত্ত্বে দেখা যায়, বাস্তব অবস্থার সাথে মিডিয়ার তথ্যের কিছু গরমিল থাকে। এ গবেষণা এটিই প্রমাণিত হয় যে, মিডিয়ার এজেন্ডা সর্বদা পাবলিকের এজেন্ডা নাও হতে পারে।
সমালোচনা
কোন কোন বিষয়ে মিডিয়া একাই এজেন্ডা নির্ধারণ করে দিতে পারে না, এ ক্ষেত্রে সুশীল
সমাজ, জনগণ ও সরকারেরও ভূমিকা থাকে।
কোন বিষয়ে মিডিয়ার স্বার্থ জড়িত থাকে বলে ঐ বিষয়টি মিডিয়া গুরুত্ব দিলেও জনগণ তা
আলোচনায় না নিয়েও আসতে পারে। যেমন- আমাদের দেশে ট্রান্সকম গ্রুপ ও ইস্ট-ওয়েস্ট মিডিয়া গ্রুপ যথাক্রমে প্রথম আলো ও কালের কন্ঠ পরিচালনা করে। তাই তারা তাদের মালিকানার স্বার্থে অনেক সংবাদ ভিন্ন দিকে প্রবাহিত করতে পারে। সম্প্রতি বৈশাখী টেলিভিশন ডেসটিনি ও এর পরিচালকদের বিরুদ্ধে মামলা, রিমান্ড বা শাস্তির সংবাদ তুলে না ধরে বরং এর পক্ষে সংবাদ তৈরী করছে। এ ধরণের প্রপাগান্ডা কখনই জনগণের আলোচনার বিষয়বস্তু হতে পারেনা।
তত্ত্বটির প্রবক্তা
ডনাল্ড শাও ও ম্যাক্সওয়েল ম্যাক কমস এজেন্ডা সেটিং থিওরির জন্য আন্তর্জাতিকভাবে সুপরিচিত।
ডনাল্ড শাও ও ম্যাক্সওয়েল ম্যাক কমস এ থিউরির
জন্য চ্যাপেল হিল স্টাডিসহ প্রায় ৪০০ এর উপরে গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করেছেন। দুজনই যোগাযোগ ও সাংবাদিকতার অধ্যাপক ও গবেষক হিসেবে সুপরিচিত।
তত্ত্বের প্রেক্ষাপট
১৯২২ সালে সংবাদপত্রের কলামিস্ট ওয়াল্টার লিপম্যান প্রথম গণমাধ্যমের জনমত সৃষ্টি সংক্রান্ত কথা বলেন। তিনি বলেন যেকোন বিষয় মিডিয়া জনগণের সামনে উপস্থাপন করার ক্ষমতা রাখে।
১৯৬৮, ১৯৭২ এবং ১৯৭৬ সালে অনুষ্ঠিত প্রেসিডেন্সিয়াল ক্যাম্পেইনের সময় ডনাল্ড শাও এবং ম্যাক্্র ওয়েল ম্যাক কমস এই বিষয়টি নিয়ে গবেষণা করেন।
গবেষণার ফলাফলে দেখা যায়, গণমাধ্যম ক্যাম্পেইনের সময় যে কথাগুলো প্রচার করছে, দুটি ভিন্ন কমিইনিটির লোকও প্রায় সেই কথা বলছে।
এ সময় তারা এ সিদ্ধান্তে পৌছান যে, গণমাধ্যম ভোটারদের দাবী বা আলোচনার বিষয়বস্তু হিসেবে যে ইস্যুটি বাছাই করে দেন তা জনগণ গ্রহণ করে থাকে।
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে ডিসেম্বর, ২০১২ রাত ১২:৪৪