মুক্তিযোদ্ধা বাবা
বাবা আমার মুক্তিযোদ্ধা ছিল, স্বার্থযোদ্ধা নয়। অন্য যেকোন স্বার্থ দূরে থাক, একটি মুক্তিযোদ্ধা সনদ পর্যন্ত বাবার কপালে জুটে নি। মুক্তিযোদ্ধা বাবা আমার এখন রিক্সাচালক। রিক্সাচালক বাবার মুখে মুক্তিযুদ্ধের অকৃত্রিম বর্ণনা শুনলে আজও বুকটা গর্বে ভরে ওঠে। তবে এখন বাবা ছাড়া গর্ব করার মত আর কিছুই নেই। সবই ছিল আমাদের- বিশাল ধানের ক্ষেত, বাড়ির উত্তর দিকে ছিল বাড়ির লম্বা, সরু দরজার রাস্তাটি, রাস্তার দুপাশে সুপারি গাছগুলো সারিবদ্ধ হয়ে এমন ভাবে দাড়িয়ে ছিল, দেখলে মনে হত সুপারি গাছগুলো এক একটি দারোয়ানের মত দাড়িয়ে রাস্তা দিয়ে হেটে যাওয়া পথিকদের বিনম্র শ্রদ্ধা জানাচ্ছে। পূর্বে কাঠাল গাছের ঘনবসতিপূর্ণ একটি বাগান।
এখন আর কিছুই নেই। ৭১- এর যুদ্ধের সময় পাক বাহিনী মা আর বড় বুবুকে তুলে নিয়ে গিয়ে আর ফিরিয়ে দেইনি, ঘর-বাড়ি পুড়িয়ে গ্রামছাড়া করেছেন। দেশ স্বাধীন হয়েছে, বাবা যুদ্ধ করেছেন,বাবাও জিতেছেন; হেরেছেন জীবনযুদ্ধে।
মুক্তিযোদ্ধা বাবা আমার স্বাধীন দেশের রিকশা চালক, রিক্সা চালিয়ে আমায় পড়াচ্ছেন। আমি বাবার ঘামঝড়া টাকা খরচ করে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএ পাশ করে এখন বেকার।
আমি আর বাবা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশেই একটি হোস্টেলের এক রুমে থাকতাম।
বাবা রিক্সা চালিয়ে রাত এগারোটার আগেই ফিরে আসত। বাবা আর আমার খুব ভাল সখ্যতা ছিল। বাবা রসিক মানুষ ছিলেন। প্রায় প্রতি রাতেই গল্প বলতেন; কখনও রুপকথার গল্প, কখনও মুক্তিযুদ্ধের গল্প। মুক্তিযুদ্ধের গল্প বলতেন আর কাঁদতেন। মা আর বুবুর কথা মনে করে বাবা কাঁদতেন, আমিও কাঁদতাম। আমায় কাদঁতে দেখলে বাবা আমায় হাসানোর জন্য অন্য কোন মজার গল্প জুড়ে দিতেন। বাবা যেমনি আমার বন্ধু, আমিও তেমনি বাবার বন্ধু। বাবার গলায় হাত দিয়ে রাত কাটিয়ে দিতাম। বাবা ঘুমানোর আগে মৃদু কন্ঠে গাইতেন মুক্তিযুদ্ধের গান, জাগরণের গান।
প্রতি রাতের মত সে রাতেও বাবা এগারোটার দিকেই এসেছিল। বাবার সেদিনের মলিন চেহারা আমি কোনদিনও ভুলতে পারবনা। বাবা আমায় বলল, জানিস খোকা, আজ এক ভদ্রলোক আমার গালে এক শক্ত চড় বসিয়েছে। আমি যেন আকাশ থেকে পড়লাম, কি বল বাবা ? মনে মনে জ্বলে ওঠা আর অপ্রকাশ্য যন্ত্রণা ভোগ করা ছাড়া আমার আর কিছুই করার ছিলনা। মুক্তিযুদ্ধের সময় এক দূর্ঘটনায় বাবার শ্রবণ শক্তির অনেকাংশে হ্রাস পেয়েছে। তাই ভদ্রলোকের কথা ঠিকমত শুনতে ও প্রতুত্ত্যর দিতে না পারায় বাবাকে এ অপমান সহ্য করতে হয়েছিল। বাবাকেই উল্টো রাগ করে বলেছিলাম এ তোমাদের কেমন স্বাধীন দেশ, যে দেশের জন্য যুদ্ধ করেছিলে, সে দেশ তোমায় কী দিয়েছে? মুক্তিযুদ্ধ করেছ, একটি সনদ পর্যন্ত সংগ্রহ করতে পারনি। একটি সনদ থাকলে মুক্তিযোদ্ধা কোঠায় এতদিনে চাকরিটা পেয়ে যেতামল। কত সহপাঠীর বাবারা যুদ্ধের একটি গল্পও শুনাতে পারেনা তাদের সন্তানেরাও এই সনদ দিয়ে চাকরি পেয়ে দিব্যি বুক ফুলিয়ে হাটছে। বাবা তার স্বভাবজাত স্বরে একই উত্তর দিত, স্বীকৃতি কখনও সংগ্রহ করা যায় না, স্বীকৃতি পেলে তা সংরক্ষণ করতে হয়। স্বীকৃতি আমার স্বাধীন দেশ, আর সনদ? সনদ আমার বাংলাদেশ।
পরদিন আমার ভাইবা পরীক্ষা ছিল। সকালে বাবাকে সালাম করে পরীক্ষা দিতে গেলাম। বাবার গায়ে প্রচন্ড জ্বর তাই বাবা আজ রিক্সা নিয়ে বের হয়নি। আমি ভাইবা শেষ করে প্রায় রাত দশটায় মিষ্টি হাতে ফিরছিলাম বাবা ঠিক যেন আমার জন্যই প্রতীক্ষা করছিলেন। আমার হাতে মিষ্টির পাত্র দেখে বাবার বুঝতে অসুবিধা হয়নি যে চাকরিটা এবার আমার ভাগ্যে জুটেছে। বাবাকে জড়িয়ে ধরে বললাম বাবা আমি চাকরি পেয়েছি, এবার তোমার কষ্ট সব কষ্টের অবসান হবে। তোমাকে আর রিক্সা চালাতে হবে না। বাবা আমার চাকরির খবরটা পেয়ে আনন্দে আত্বহারা হয়ে কাঁদতে লাগল।বাবার চোখের পানি আর চৈত্র মাসে শুকিয়ে যাওয়া মাটিতে শুষ্ক বৃক্ষের গোড়ায় পানি যেন সমান অর্থ বহন করছে। বাবা চাকরির খুটিনাটি জিজ্ঞেস করছে আর আমি উত্তর দিচ্ছে আর আমি উত্তর দিয়ে যাচ্ছি।
এরই মধ্যে হঠাৎ বাবা আমার চাকরির ফাইলটা খুলে আমার সনদপত্রগুলো গভীর মনোযোগের সাথে দেখতে শুরু করল। আমার বুকটা তখন দরদর করছিল। কেননা এতদিন চাকরির খুব কাছাকাছি গিয়েও চাকরিগুলো হাতছাড়া হওয়ায় আমি আমার এক বন্ধুর সাহায্যে একটি মুক্তিযোদ্ধা সনদ সংগ্রহ করেছিলাম। সনদটি সম্পূর্ণই ছিল নকল ও বাবার নিতীবিরুদ্ধ অনৈতিক ভাবে পাওয়া। যেই মাত্র বাবার হাতে সনদটি ধরা পড়ল অমনি বাবা পাথরের মত শক্ত হয়ে গেল। তার হাসিমাখা মুখটি রক্তিম হয়ে ওঠল। হতাশ আর প্রতিবাদী স্বরের সংমিশ্রণে বাবার মুখ থেকে শুধু একটি শব্দ বের হয়েছিল ’একি খোকা?’ কিছুক্ষণ আমি আর বাবা নিশ্চুপ হয়ে রইলাম। এরপর মৃদু গলায় আমি বললাম, বাবা এই সনদের অভাবে চাকরিতে আমি মেধাতালিকায় এগিয়ে থেকেও চাকরি পাইনি। বাবা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, খোকা, যে সনদ আমি মুক্তিযুদ্ধ করেও পাইনি, এ সনদ মুক্তিযোদ্ধাদের নয়, তাই অবৈধ উপায়ে সনদটি সংগ্রহ তোমার প্রথম অপরাধ। দ্বিতীয়ত, এ সনদ সম্মান নিশ্চিত করবে মুক্তিযোদ্ধারের, তার পরিবারের, এ সনদ নিশ্চিত করতে পারে মুক্তিযোদ্ধাদের সামাজিক মর্যাদা এমনকি আর্থিক ভাবেও সাহায্য করতে পারে কিন্তু পবিত্র এ সনদ কখনও মেধার চ্যালেঞ্জ হতে পারে না। মেধার বিচারের ক্ষেত্রে সবাই সমান। তাই সনদের নামে মানুষের অধিকার নিয়ে এ প্রতারণা তোমার মুক্তিযোদ্ধা বাবা কখনও মেনে নিতে পারেন না। বাবার হাতে থাকা ভুয়া মুক্তিযুদ্ধের সনদটি বাবা ছিড়ে ফেলে আমাকে আমার তার সাগরের সমান বুকে টেনে নিয়ে বলল, এ চাকরিটা তোমার করতে হবে না খোকা। চাকরি ছেড়ে দেয়ার ব্যথা নিয়ে নয়, বাবার মত মুক্তিযোদ্ধা বাবার সন্তান হতে পেরে গর্বিত বুক নিয়ে সেরাতে ঘুমাতে গেলাম।
ঘুম থেকে ওঠে বাবা আবার তার রিক্সাটি নিয়ে জীবনযুদ্ধে বের হলেন।
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই জানুয়ারি, ২০১৩ রাত ৯:১৭