somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আলঝেইমারঃ Eraser in my head

২৩ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৩ রাত ১২:০৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

সকাল গড়িয়ে দুপুর হবো হবো করছে। আঁচল কলেজ থেকে ফিরে দেখলো তার দাদাজান বেজার মুখে ইজি চেয়ারে বসে আছে।

- দাদাজান, মুখটা এরকম বাংলার পাঁচ বানিয়ে রেখেছ কেন?
- তোর দাদীজানের কান্ডটা দেখেছিস? সকাল থেকে আমাকে না খাইয়ে রেখেছে। কোন খেয়াল নাই আমার দিকে...
-ওমা! সকালে কলেজ যাওয়ার সময় না দেখলাম তুমি খাচ্ছো?

আঁচলের দাদী পাশের ঘর থেকে আসে।
-আর বলিস না, বুবু। ইদানীং কি যে শুরু করছে তোর দাদাজান! এখনি খেয়ে কিছুক্ষণ পরে বলবে 'খেতে দিলে না যে'। আর মেজাজটাও যা খিটখিটে হয়ে গেছে...

মানুষ বৃদ্ধ হলে স্মরণ শক্তি কমে যায় (dementia) এটা আমাদের মাঝে খুবই প্রচলিত একটি ধারণা। ধারনাটা যে খুব একটা ভুল তাও কিন্তু নয়। ৪৫ বৎসর বয়সের পর বিশাল অংশের একদল লোকের স্মরণ শক্তি কমে যেতে শুরু করে এবং বয়স বাড়ার সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে সব কিছু ভুলে যাবার প্রবণতাও। এই ধরণের বুদ্ধিবৈকল্য বা স্মৃতি শক্তি কমে যাওয়ার কারণ যে সকল রোগ তার প্রধান রোগটির নাম আলঝেইমার’স ডিজিজ। ১৯০৬ সালে জার্মান মনোচিকিৎসক Alois Alzheimer সর্বপ্রথম এ রোগটির বর্ণনা দেন, আর তার নাম অনুসারেই এ রোগের এমন নাম রাখা হয়।

সম্প্রতি এক গবেষনায় দেখা গেছে বিশ্বের প্রায় ২৬.৬ মিলিওন
মানুষ এই রোগে ভুগছে, এবং বিজ্ঞানীদের ধারনা আগামী ২০৫০ সালের মধ্যে প্রতি ৮৫ জনে একজন এই রোগে ভুগবে। আলঝেইমার ডিজিজ পড়ন্ত বয়সে দেখা গেলেও ইদানিং ৩০ বা তার আশেপাশেও এ রোগ দেখা যাচ্ছে। যার কারনে নার্ভাস সিস্টেমের এই অসুখ নিয়ে চিকিৎসকরা নতুন করে ভাবতে শুরু করেছেন।

গত ২১ সেপ্টেম্বর বিশ্বব্যাপী দ্বিতীয়বারের মত পালিত হল বিশ্ব আলঝেইমার দিবস। এবারের প্রতিপাদ্য ছিল Dementia: A journey of caring

লক্ষণঃ
এ রোগের সঠিক কারণ কি তা কিন্তু এখনও জানা যায়নি। তবে সাম্প্রতিক গবেষণা গুলো দাবী করছে; যে সকল উপাদান বা নিউরোট্রান্সমিটার (neurotransmiter) এর আদান প্রদান এর মাধ্যমে মস্তিস্ক তাদের কার্য সম্পাদন করে তাদের সমস্যার কারণেই এই রোগটি হয়ে থাকে। পরিসংখান অনুযায়ী শতকরা ১৫ ভাগ রোগীই এ রোগে আক্রান্ত হন পারিবারিক উত্তরাধিকার সূত্রে (familial inheritance), আর শতকরা ১ থেকে ৫ শতাংশ রোগের কারন হলো জেনেটিক (genetic)।

এই রোগের অনেকগুলো উপসর্গের মধ্যে দশটি উপসর্গ বেশী গুরুত্বপুর্ন, যা কোন ব্যাক্তির মধ্যে দেখা দিলে তৎক্ষণাত একজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ নেয়া উচিত।
লক্ষনগুলো নিম্নরুপ-

১)আলঝেইমারে আক্রান্ত ব্যাক্তিরা কোন জিনিসকে তার সঠিক স্থানে রাখতে পারেনা। যেমন ধরুন বই টেবিলে না রেখে ফ্রিজে রেখে দেয়া এবং পরবর্তীতে ঐ জিনিসটি কোথায় রেখেছে তা মনে করতে না পারা।
২) চিন্তা শক্তি ও বড় কোন সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলা। নিজের পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা, খাওয়া দাওয়া, টাকা-পয়সা বা ব্যাক্তিগত জীবনের কথা ভুলে অচেনা এক ভুবনে হারিয়ে যাওয়া।
৩)নিজেকে সামাজিক, পারিবারিক কিংবা অন্যান্য শৌখিন কাজকর্ম থেকে সরিয়ে ফেলা, যা সে আগে করতে পছন্দ করতো, যেমন খেলাধুলা, ঘুরে বেড়ানো, আড্ডা দেয়া ইত্যাদি।
৪)মুড বা মানসিক অবস্থার আমূল পরিবর্তন হওয়া, যেমন সর্বদা কনফিউসড, বিষাদগ্রস্থ, আতংকিত, সন্দেহপ্রবন বা দুশ্চিন্তাগ্রস্থ থাকা।
৫)অন্য কোন ব্যাক্তির সাথে স্বাভাবিক কথোপকথন চালিয়ে যেতে না পারা। যেমন মাঝখানে কথা বন্ধ করে দেয়া কিংবা একই কথা বারবার বলা।
৬)লিখতে সমস্যা বা উচ্চারনগত সমস্যা। কোন কিছু বলার সময় সঠিক শব্দ চয়ন করতে না পারা, যেমন ঘড়ি কে watch না বলে hand clock বলা।
৭) সময় ও জায়গা নিয়ে কনফিউসনে ভোগা। গুরুত্বপুর্ন তারিখ, ফোন নম্বর, নিজের বাড়ীর ঠিকানা, পরিবার পরিজনদের নাম মনে না রাখতে পারা।
৮)দৈনন্দিন সাধারন কাজকর্ম করতে না পারা, একই জিনিস বারবার মনে করিয়ে দেয়া সত্বেও ভুলে যাওয়া।
৯)নিচের দিকে ঝুঁকে ঝুঁকে হাটা।
১০)কোন কিছুর রঙ নির্ধারন ও দুরত্ব পরিমাপ করতে ব্যর্থ হওয়া। কোন কোন ক্ষেত্রে আয়নায় নিজের চেহারা দেখেও বুঝতে না পারা যে আয়নার ঐ ব্যাক্তিটি সে নিজেই।

আগেই বলেছি আলঝেইমার’স রোগ হলে রোগীর স্মৃতি শক্তি কমে যেতে শুরু করে। রোগী সাম্প্রতিক (short term) এবং অতীত (long term) দুই ধরণের স্মৃতিই বিস্মৃত হয়ে যান, যদিও সাম্প্রতিক ঘটনা গুলো ভুলে যাবার হারটাই অধিক। এছাড়া এ সকল রোগীর মাঝে দ্বিধা (confusion), খিটখিটে স্বভাব (irritation), উদ্ধ্যত ভাব (aggression), বিষন্নতা-অবসাদ, বাকশক্তিহীনতা বা অন্যের কথা বোঝার ক্ষমতা লোপ পাওয়া (aphasia) সহ নানাবিধ সমস্যা দেখা দেয়। দুর্ভাগ্যজনক ভাবে তিনি তার এই সমস্যা গুলো বুঝতে পারেন না এমন কি তার মনে এ বিশ্বাস জন্মায় যে তার এ ধরনের কোন সমস্যাই নেই। এর ফলে অনেক সময়ই ব্যক্তিটি পারিবারিক ভুলবোঝাবুঝির শিকার হন এবং পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সাথে তার একটি বৈরি সম্পর্ক তৈরী হয়; ফলস্বরূপ তিনি চরম একাকীত্বে ভুগতে থাকেন।
এমন রোগ হলে পরিবারের প্রবীণ সদস্যটিকে একজন নিউরোবিশেষজ্ঞের নিকট নিয়ে যাওয়া উচিত। সাধারণত চিকিৎসক সাহেব রোগীর ইতিহাস জেনে এবং তার আত্মীয়দের সাথে কথা বলেই রোগটি নিশ্চিত করতে পারেন। তবে আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থায় সিটি স্ক্যান (CT scan), এম-আর-আই (MRI), স্পেক্ট (SPECT-single photon emission computed tomography), পেট স্ক্যান (PET-positron emission tomography) এসব পরীক্ষা করে অনেক সময় নিশ্চিত হতে হয় রোগীর এর সাথে মস্তিস্কের অন্য কোন রোগ আছে কিনা।

দুর্ভাগ্যজনক হলো আলঝেইমার রোগের এখনো সঠিক কোন চিকিৎসা আবিষ্কার করা সম্ভব হয়ে উঠেনি। তবে পরিবারের আপনজনেরা সহানুভুতিশীল হলে এবং সহমর্মিতা সহ ব্যক্তিটিকে একটি সঠিক স্নেহময় পরিবেশ তৈরী করে দিলে তার জন্য একটি অর্থবহ জীবন যাপন সম্ভবপর হয়ে উঠতে পারে।

বিভিন্ন সমীক্ষায় দেখা যায় যে, যেসকল ব্যক্তি মধ্যবয়সে বিভিন্ন বুদ্ধিভিত্তিক কাজ (যেমন লেখালেখি, বইপড়া, যন্ত্রসংগীত বাজানো), বিভিন্ন সামাজিক গঠন/সেবামূলক কাজ, Board game খেলা (দাবা, cross word puzzle) ইত্যাদি কাজে ব্যস্ত থাকেন এবং স্বাস্থ্যকর খাবার খান তাদের মাঝে এ রোগ হবার প্রবণতা কম। অন্যদিকে যারা অনিয়ন্ত্রিত কোলেস্টেরল, ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ রোগে ভোগেন বা ধুমপায়ী তাদের মধ্যে এ রোগ হবার প্রবণতা অপেক্ষাকৃত ভাবে বেশী।

উৎসাহের কথা হলো অতিসম্প্রতি আলঝেইমার রোগের উপশমে DONEPEZIL, GALANTAMINE, MEMANTINE, RIVASTIGMINE নামক কিছু অসুধ আবিস্কৃত হয়েছে। এদের কার্যকারীতা শতভাগ না হলেও অনেক ক্ষেত্রেই এরা রোগ উপশমে আশানুরূপ প্রমাণ রেখেছে।

পোস্ট শেষ করবো। মীরাক্কেল ইশটাইলে বলি, 'খতম করার আগে' নিচের মুভি লিস্টটা দেখে বলেন তো কয়টা কমন পড়লো। কোনটা সবচে' ভাল লাগছে? আর আলঝেইমার'স এর সাথে আমার পরিচয় কিন্তু একটা মুভির মাধ্যমেই। আ মোমেন্ট টু রিমেমবার...

আলঝেইমার নিয়ে নির্মিত কিছু মুভির লিস্টঃ
১। The Notebook



২। A Moment To Remember



৩। Away From Her



৪। Iris: A Memoir of Iris Murdoch



৫। A Song for Martin
৬। U Me Aur Hum
৮। Firefly Dreams
৯। The Savages



১০। Aurora Borealis
১১। Age Old Friends
১২। Lovely, Still
১৩। The Family That Preys

লিস্টে এড করার জন্য আপনার কাছে কোন মুভি থাকলে, জানিয়ে ধইন্যা পাতা বুঝিয়া লন :)

সবাই অনেক ভাল থাকুন।

তথ্যসূত্রঃ
১।সুস্বাস্থ্য.কম
২।সাইকোথেরাপী অনলাইন। মতিভ্রম বা আলঝেইমার
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৩ দুপুর ১২:০৪
১২টি মন্তব্য ১০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে...

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:০৯

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে,
পড়তো তারা প্লে গ্রুপে এক প্রিপারেটরি স্কুলে।
রোজ সকালে মা তাদের বিছানা থেকে তুলে,
টেনে টুনে রেডি করাতেন মহা হুলস্থূলে।

মেয়ের মুখে থাকতো হাসি, ছেলের চোখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অহমিকা পাগলা

লিখেছেন আলমগীর সরকার লিটন, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১৪


এক আবেগ অনুভূতি আর
উপলব্ধির গন্ধ নিলো না
কি পাষাণ ধর্মলয় মানুষ;
আশপাশ কবর দেখে না
কি মাটির প্রণয় ভাবে না-
এই হলো বাস্তবতা আর
আবেগ, তাই না শুধু বাতাস
গায়ে লাগে না, মন জুড়ায় না;
বলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

হার জিত চ্যাপ্টার ৩০

লিখেছেন স্প্যানকড, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩




তোমার হুটহাট
চলে আসার অপেক্ষায় থাকি
কি যে এক ছটফটানি
তোমার ফিরে আসা
যেন প্রিয় কারো সনে
কোথাও ঘুরতে যাবার মতো আনন্দ
বারবার ঘড়ি দেখা
বারবার অস্থির হতে হতে
ঘুম ছুটে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবনাস্ত

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৪৪



ভোরবেলা তুমি নিশ্চুপ হয়ে গেলে একদম,
তোমার বাম হাত আমার গলায় পেঁচিয়ে নেই,
ভাবলাম,তুমি অতিনিদ্রায় আচ্ছন্ন ,
কিন্তু এমন তো কখনো হয়নি
তুমি বরফ জমা নিথর হয়ে আছ ,
আমি... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে দেশে সকাল শুরু হয় দুর্ঘটনার খবর দেখে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:১১

প্রতি মিনিটে দুর্ঘটনার খবর দেখে অভ্যস্ত। প্রতিনিয়ত বন্যা জলোচ্ছ্বাস আসে না, প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার খবর আসে। আগে খুব ভোরে হকার এসে বাসায় পত্রিকা দিয়ে যেত। বর্তমানেও প্রচলিত আছে তবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×