somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

দ্যা ওয়াল - শিক্ষা ও জীবনবোধের দ্বন্দ

০৭ ই জানুয়ারি, ২০২৪ রাত ১০:৩৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


ব্যান্ডটির পুরাতন নাম বললে অনেকেই চিনবেন না, "টি সেট"। ৬০ এর দশকে সাইকাডেলিক ও ৭০ এর দশকে প্রগ্রেসিভ রক গাইতো। এক কনসার্টে গিয়ে ব্যান্ডের সদস্যরা শুনতে পান পাশের আরেকটি কনসার্টে একই নামে আরেকটি ব্যান্ড গাইছে। সাথে সাথে নাম পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।

প্রতিষ্ঠাতা সদস্য সিড ব্যারেটের সংগ্রহে ছিলো দুজন ব্লুজ মিউজিশিয়ানের রেকর্ড, একজনের নাম পিংক এন্ডারসন ও আরেকজনের নাম ফ্লয়েড কাউন্সিল। এইদুজনের নামের সমন্বয়ে ব্যান্ডটির নামকরন করা হয় "পিংক ফ্লয়েড"। ইতিহাসের সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যান্ডগুলির একটি।

১৯৭৯ সালে ইংল্যান্ডের এই ব্যান্ডটি "দ্যা ওয়াল" নামে একটি এলবাম বের করে। হয় এক ইতিহাসের সূচনা। রক অপেরা ধাঁচের এই এলবামটি যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, পশ্চিম জার্মানি সহ বিশ্বের বহুদেশে বহুদিন বিক্রিত একনম্বর এলবাম হয়ে ছিলো। সর্বকালের সর্বাধিক বিক্রিত গানের এলবামগুলির একটি এই "দ্যা ওয়াল"।

ব্যান্ডের বেজিস্ট রজার ওয়াটার্স এর লেখা 'স্মৃতিচারণ', 'শিক্ষা' ও 'মাদক' ছিলো একই কমন লিরিক সেটের উপর করা তিনটা থিমের গান। এর মধ্যে দ্বিতীয়টা ছিলো প্রচলিত শিক্ষা ব্যাবস্থার প্রতি এক প্রতিবাদ।

ততকালীন ইংল্যান্ডের বোর্ডিং স্কুলে শিক্ষা ব্যাবস্থার প্রতি এক প্রচন্ড প্রতিবাদ হিসেবে গানটির জন্ম। রজার্স ব্যক্তিগত জীবনে এই শিক্ষাব্যাবস্থায় নির্যাতিত হওয়ার কারনে গানে উঠে আসে এক বিদ্রোহের প্রতিরূপ। ছাত্রের প্রতি শিক্ষকের বিদ্বেষমূলক আচরন ও অহেতুক কড়াকড়ি এবং পুরো শিক্ষা ব্যাবস্থার প্রতি ক্রোধ স্বরুপ ছাত্ররা নিজেদের চারপাশে এক দেয়াল গড়ে তোলে। এবং প্রতিটি মানুষ আসলে এই দেয়ালেরই অংশ মাত্র, এ ধরনের একটি সমাজকে তীব্র ধাক্কা দেয়া গানের কারনে রাতারাতি ছড়িয়ে পড়ে প্রায় পুরো পৃথিবীজুড়ে গানটি।

We don't need no education.
We don't need no thought control.
No dark sarcasm in the classroom.
Teacher, leave those kids alone.
Hey, Teacher, leave those kids alone!
All in all it's just another brick in the wall.
All in all you're just another brick in the wall.

গানটির আবেদন এতোটাই তীব্র ছিলো, দক্ষিন আফ্রিকায় বর্ণবাদবিরোধী ও সরকারী নীতির বিরুদ্ধে 'কালো' ছাত্রদের দেশব্যাপী আন্দোলনে গানটি মন্ত্রের মতো কাজ করছিলো। স্কুল বর্জন করছিলো ছাত্ররা, শিক্ষা ব্যাবস্থা ভেঙ্গে পড়ছিলো। ২ মে, ১৯৮০ সালে দক্ষিন আফ্রিকা সরকার সে দেশে গানটি নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।

আমার ব্যক্তিগত জীবনে সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলে রেখে গেছে এই গানটি। আমার আব্বু আম্মু দুজনেই কলেজ শিক্ষক। ১৯৯০ সাল থেকে আব্বু বাড়ির বাইরে চাকরীসূত্রে। আম্মু আমাকে কঠিন শাসনে রাখতো। সান্ধ্য আইন জারী ছিলো আমার স্কুলজীবনটা। আইন ছিলো মাগরিবের আজান শেষ হবার আগে বাসায় ফিরতে হবে। কতবার যে এই আইনের ভয়ে দৌড়ে বাসায় ফিরতে গিয়ে রাস্তায় আছাড় খেয়ে হাত পা ছিলেছে, ছিঁড়েছে তার ইয়ত্তা নেই। বাসায় কোন বন্ধু আসতো না ভয়ে, আসলে জেরার মুখে পড়তে হতো। আর আম্মুকে কোন রাস্তা দিয়ে যেতে দেখলে রাস্তায় আমার কোন বন্ধুবান্ধব থাকলে ভয়ে পালিয়ে যেত।

ক্লাস নাইনে ওঠার পর আমি সিদ্ধান্ত নিলাম আমি আর্টসে পড়বো। আব্বু-আম্মুর যেন ইজ্জত চলে যায়! আমাকে আম্মুর এক কলিগের বাসায় রিমান্ডে নেয়া হলো। সেখানে বিজ্ঞানের মহত্ব ও ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ারদের আয় ইনকামের ফিরিস্তি শুনিয়ে আমার সিদ্ধান্ত চেঞ্জ করানো হলো। যদিও পরে সে কথা আম্মু স্বীকার করেনি কখনো।

কলেজে এসে আব্বুর সিদ্ধান্তে কারিগরি বোর্ডের আন্ডারে ব্যাবসায় ব্যাবস্থাপনাতে ভর্তি হলাম। কিছুটা শান্তিতে ছিলাম, তবু অংক পছন্দ হয়নি কোনভাবেই। হিসাব বিজ্ঞান পাস করেছি ঘর টেনে। ততদিনে অবশ্য আমার মাথায় ঘুরছে, "We don't need no education!"

ইচ্ছে ছিলো ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে ইংরেজীতে পড়বো। পরীক্ষা দিয়েই বুঝে গেলাম ইংরেজী পাবো না। হল থেকে বেরিয়ে প্রবেশপত্র টেনে ছিঁড়ে ফেললাম। যাতে অন্য সাবজেক্টে চান্স পেলেও ভর্তি করতে না পারে। আব্বুর জোরাজুরিতে ইস্ট ওয়েস্টে ভর্তি হলাম। বললাম পরের বছর আবার পরীক্ষা দেবো। দিতে দেয়া হলোনা। পড়াশুনা থেকে মন উঠে গেছে। মাথার ভেতর ঘুরছে, "We don't need no thought control!"

কেন আমাকে এই সব থিওরী পড়তে হবে? চাকরী করবার জন্য? জীবনের অর্থ কি? একটা চাকরী, সুন্দরী একটা বৌ, একটা বাড়ি আর একটা গাড়ি? সমাজের দেয়ালে আরেকটি ইট হয়ে বেঁচে থাকা? আমি কেন এসেছি এই পৃথিবীতে, কেন এই বেঁচে থাকা? কার জন্য ব্যাংকে থরে থরে টাকা জমানো? সাফল্যের সঙ্গা কি?

ভার্সিটির পেছনে বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ বস্তি। সেই বস্তিতে এক বাউল থাকেন। মাঝে মাঝে ক্যাম্পাসে এসে গান করেন। আমি তাঁর সাথে তার ঘরে চলে যাই। সারারাত গান শুনি।

"মানুষ ছাড়া ক্ষ্যাপা রে তুই মূল হারাবি...
মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি..."

আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকি বাউলের দিকে। আমার শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ক্লাসে ইন্ট্রিগেশন বোঝায়, ক্যাশ কাউ বোঝায়, থ্রি ডাব্লিউ বোঝায়, মাসলোস থিওরী অফ হায়ারার্কি বোঝায়, মানুষ তো বোঝায় না!

পাশের সীটের দিকে তাকিয়ে দেখি উদ্ভিন্ন যৌবন, মাজদা বিএমডব্লিউ এর স্পেসিফিকেশন শুনি, শুন্য থেকে কত সেকেন্ডে গাড়ির গতি একশ কিলোমিটার হয় তার উপর ভাব নেয়া দেখি। চারপাশে তাকিয়ে আমি সারি সারি সুগন্ধী ইট দেখি। সমাজের উঁচু দেয়ালে এরা উপরের সারিতে খাপ খেয়ে বসে যাবে। আর নিচের সারিতে রয়ে যাবে গরীব, পাশের জানালা দিয়ে দূরে দেখা বস্তিটার মানুষগুলি।

সমাজের দেয়ালে সবার স্থান আছে, আমি আমার নিজেকে খুঁজে পাইনা। আমি কি এই ইট হবার জন্য জন্ম নিয়েছি? সুন্দরমতো ফিটফাট পোষাক পরে এক দেয়ালে এসে বসে যাবো, এই কি আমার নিয়তি?

আমি কি পড়ছি, কেন পড়ছি? এই পড়াশোনা কিভাবে আমার সমাজের উপকার করবে? উপকার করবে না অপকার করবে? সেটা নির্ধারন যারা করে তাদের নির্ধারনের যোগ্যতা কি? সমাজের উপকার না কি নিজের ব্যাংক ব্যালান্সের উদরপূর্তি? যে সমাজ আমাকে এই পড়াশুনা করাচ্ছে সে কি আমাকে বিক্রি করবার জন্যই ভ্যালু এড করছে না? আমাকে কেন বার বার শেখানো হচ্ছে সমাজে নিজেকে বিক্রি করতে হলে, দেয়ালের একটু উপরের ইট হতে হলে আমাকে অন্যদের ঘাড়ে পা দিয়ে টপকাতে হবে?

এই শিক্ষার অর্থ কি? এই শিক্ষার আদর্শ কি?

নেই, কোন আদর্শ নেই, কোন অর্থ নেই, কোন ভবিষ্যত নেই। একটাই লক্ষ্য, নিজেকে বাজারে বিক্রির উপযুক্ত করে তোল। তুমি কয়টা থিওরি জানো, কতটুকু মুখস্ত করে কতক ছাগলের সামনে গিয়ে উগরে দিতে পারো তাতে তোমার মূল্য নির্ধারন হবে। সেটাতো গরু ছাগলেরাও পারে। ঘাস পাতা খেয়ে মোটা তাজা হয়ে নিজের দাম বাড়ানো।

মহাকালের এই দেয়ালে আমি, আমার সত্ত্বার তাহলে মূল্য কি? শুধুই কি একটা ইট? না দেয়াল ভাঙ্গার জন্য আমার জন্ম?

মাথার ভেতর ঘোরে-
All in all it's just another brick in the wall.
All in all you're just another brick in the wall!
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই জানুয়ারি, ২০২৪ দুপুর ২:৩২
১১টি মন্তব্য ১২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ভণ্ড মুসলমান

লিখেছেন এম ডি মুসা, ২০ শে মে, ২০২৪ দুপুর ১:২৬

ওরে মুসলিম ধর্ম তোমার টুপি পাঞ্জাবী মাথার মুকুট,
মনের ভেতর শয়তানি এক নিজের স্বার্থে চলে খুটখাট।
সবই যখন খোদার হুকুম শয়তানি করে কে?
খোদার উপর চাপিয়ে দিতেই খোদা কি-বলছে?

মানুষ ঠকিয়ে খোদার হুকুম শয়তানি... ...বাকিটুকু পড়ুন

আসবে তুমি কবে ?

লিখেছেন সেলিম আনোয়ার, ২০ শে মে, ২০২৪ দুপুর ১:৪২



আজি আমার আঙিনায়
তোমার দেখা নাই,
কোথায় তোমায় পাই?
বিশ্ব বিবেকের কাছে
প্রশ্ন রেখে যাই।
তুমি থাকো যে দূরে
আমার স্পর্শের বাহিরে,
আমি থাকিগো অপেক্ষায়।
আসবে যে তুমি কবে ?
কবে হবেগো ঠাঁই আমার ?
... ...বাকিটুকু পড়ুন

(রম্য রচনা -৩০কিলো/ঘন্টা মোটরসাইকেলের গতি )

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২০ শে মে, ২০২৪ দুপুর ২:৫০



একজন খুব পরিশ্রম করে খাঁটি শুকনো সবজি( দুষ্টু লোকে যাকে গাঁ*জা বলে ডাকে) খেয়ে পড়াশোনা করে হঠাৎ করে বিসিএস হয়ে গেলো। যথারীতি কষ্ট করে সফলতার গল্প হলো। সবাই খুশি। ক্যাডারের... ...বাকিটুকু পড়ুন

কোথাও ছিলো না কেউ ....

লিখেছেন আহমেদ জী এস, ২০ শে মে, ২০২৪ রাত ১০:১৯




কখনো কোথাও ছিলো না কেউ
না ছিলো উত্তরে, না দক্ষিনে
শুধু তুমি নক্ষত্র হয়ে ছিলে উর্দ্ধাকাশে।

আকাশে আর কোন নক্ষত্র ছিলো না
খাল-বিল-পুকুরে আকাশের ছবি ছিলো না
বাতাসে কারো গন্ধ ছিলোনা
ছিলোনা... ...বাকিটুকু পড়ুন

#প্রিয়তম কী লিখি তোমায়

লিখেছেন নীল মনি, ২১ শে মে, ২০২৪ সকাল ৭:৫১


আমাদের শহর ছিল।
সে শহর ঘিরে গড়ে উঠেছিল অলৌকিক সংসার।
তুমি রোজ তাঁকে যে গল্প শোনাতে সেখানে ভিড় জমাতো বেলা বোস, বনলতা কিংবা রোদ্দুর নামের সেই মেয়েটি!
সে কেবল অভিমানে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×