ছেলেটা তখন সবে ভর্তি হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ে । হলে সিট পেলো না, আর গনরুমে থাকার সাহস হলো না । বাসা যেহেতু ইউনিভার্সিটি থেকে বহু দূরে, সে কখনোই সকালে খেয়ে বের হতে পারে না । বাস ক্যাম্পাসে পৌঁছতে পৌঁছতে ক্লাস শুরু হয়ে যায় আর শেষ হতে হতে বেলা দেড়টা - দুইটা । খাওয়া - দাওয়ার পর্ব তারপর ।
সেখানেও আরেক সমস্যা । প্রায়ই তার পকেটে টাকা থাকে না । পরিচিত মানুষ কম বলে সে টিউশনি পায় না, আর বাবার আয়ে সংসার চলাই কষ্টকর । বন্ধুরা নানা রেস্টুরেন্টে দুপুরে খেতে যাওয়ার সময় তাকে টানাটানি করে, সে বিভিন্ন অজুহাতে পাশ কাটিয়ে যায় ।
একদিন সেন্ট্রাল লাইব্রেরির পাশের এক দেয়ালে সে বসে । হাত পনের টাকার ঝালমুড়ি । ঝালমুড়ি মানুষ খায় পাঁচ টাকার, প্যাকেটের সাইজ হয় ছোট । পনের টাকার ঝালমুড়ির প্যাকেট বেশ বড়সড় হয়ে গেছে, চোখে লাগে । পাশ থেকে হঠাৎ এক মেয়ে প্রশ্ন করলো - " ঝালমুড়ি পছন্দ করেন নাকি খুব? "
গোলগাল, হাসি-খুশী চেহারার অপরিচিত এক মেয়ে । ছেলেটা একটু হেসে জবাব দেয় - " উল্টোটা । মোটেও পছন্দ করি না । "
- তবে খাচ্ছেন যে?
সত্য জবাবটা দেয়ার আগে ছেলেটা কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো মেয়েটার দিকে । তারপর হালকা স্বরে বললো, - " অন্য কিছু খেয়ে পেট ভরাতে হলে টাকা বেশী খরচ হবে । টাকা নেই । "
কথাটা শুনে মেয়েটা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে । তারপর পাশে এসে বসে .... ওইদিন ছেলেটা বাড়ি ফেরে ইউনিভার্সিটির একেবারে সর্বশেষ বাসে, সন্ধ্যা মেলোবার বেশ পরে ।
মেয়েটা পড়তো ইডেন কলেজে । দুজন ইয়ার মেট । সেদিন থেকে পরের চার বছর মেয়েটা প্রায় প্রতিদিন দুপুরেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হাকিম চত্বরে এসে দাড়াতো, তার হাতে থাকতো ছোট্ট একটা টিফিন ক্যারিয়ার । তারা মাঝেমাঝে চিঠি লিখতো একজন আরেকজনকে ... কখনও পাতার পর পাতা , কখনও বা ছোট্ট চিরকুট । দুজনই যত্নে রেখে দিয়েছে সবগুলো চিঠি । এখনকার সবাই দিনে শতবার বলে ভালোবাসি, অথচ ওই শব্দটা তাদের একবারও উচ্চারণ করার প্রয়োজন পড়ে নি । তাদের প্রেম সহজাত ।
কয়েক বছর পর এক রাতে আগুনকে সাক্ষী রেখে যখন মেয়েটার বিয়ের গায়ত্রী মন্ত্র উচ্চারিত হচ্ছিলো ছেলেটা তখন এশার নামাজের মোনাজাতে । কেবল নিজেদের পরিবারের কথা ভেবেই তারা এক হয় নি । নিজের জীবনের উপর অধিকার তো শুধু নিজের একার নয় । আর ভালবাসলে যে পেতেই হবে, এমনটাও তো না । দূরে থেকেও তো ভালোবাসা যায় ।
ঐ দিনের পর থেকে ছেলেটা আর কখনো দুপুরে কিছু খায় না ।
সেলফি, কেএফসি, ভ্যালেন্টাইন'স ডে আর হ্যাং আউটে আবদ্ধ প্রেমের যুগে বসে এমন বাস্তব গল্প আমার কাছে খুব অবাস্তব লাগে । বিশ্বাস হতে চায় না । অসংখ্য ছবি দেখি প্রতিদিন, দেখি ট্যাগ করা পোস্টে লাল ঠোঁটের ছড়াছড়ি । ভালোবাসা ব্যাপারটা খুব সহজলভ্য হয়ে গেছে ইদানীং , সম্পর্কে গভীরতাটাই কেবল নেই ।
নতুন শুরু হয়েছে আরেক ট্রেন্ড - ফ্রেন্ড ( বন্ধু বা বান্ধবী নয় কিন্তু! ) ... ফ্রেন্ডলিস্টের এক মেয়ে দিনের পর দিন তিন ছেলের সাথে সমানে হাতে, পায়ে, কোমড়ে, গলায় সহ সম্ভাব্য আরও বহু জায়গায় পটকান দিয়ে তোলা সব ছবি দেখিয়ে যাচ্ছে ... একদিন কৌতূহল সামলাতে না পেরে জিজ্ঞাস করেই ফেললাম সে আসলে ভালোবাসেটা কাকে এবং জানলাম একজনকেও না । তারা " ওনলি ফ্রেন্ড " ... তার প্রেমিক অন্য একজন । ফেসবুকের এ যুগে মানুষের মনোযোগ, ভালোবাসা আর ভালো লাগা ছড়িয়ে গেছে বিক্ষিপ্তভাবে, বন্ধুত্বের সংজ্ঞাও পুরোপুরি বদলে গেছে সম্ভবত । নাহলে মানুষের এখন কে পাশে থাকার আর কাকে বুকে রাখার তা জানার কথা ।
পুরোনো চিঠি লেখার যুগের ভালোবাসা ফিরে আসুক । মানুষ গভীর ভাবে ভালোবাসতে শিখুক আবার... এমন গভীর প্রেম যাতে অবলীলায় লেখা যায় - " আমি রুগ্ন, বিষন্ন, অমিশুক, বদমেজাজি, বেখেয়ালি, আত্নকেন্দ্রিক, বিরক্তিকর একজন মানুষ, মানুষ হিসেবে যার একমাত্র যোগ্যতা সে তোমাকে ভালোবাসে " ।
... অল্প বয়সেই বুকে অনেক হাহাকার আর কষ্ট জমে ওঠা মানুষগুলো ভালোবাসতে শিখুক তাকেই যে ভালোবেসে ভালোবাসায় । তাহলেই জীবনে হাহাকারগুলো আর থাকে না, বেঁচে থাকাটা হয়ে উঠে আনন্দময় ।