অন্যলোক
দর্পণ কবীর
লোকটিকে দেখে ভীষণ অবাক হলো মিথিলা। শুধু অবাক বললে ভুল হবে, ও বিস্ময়ে থ’ হয়ে গেল। এমন কাকতালীয় ঘটনা ওর জীবনে কখনো ঘটেনি। এ যেন অতিপ্রাকৃত যে কোন গল্পের চেয়েও বেশি রহস্যময়। এই লোকটিকে ও জীবনে কখনো দেখেনি। দেখার কথাও নয়। অথচ লোকটিকে ও চেনে। এবং খুব ভালো করেই চেনে। লোকটির সঙ্গে ওর কখনো পরিচয় হয়নি। ও জানে না লোকটি কে, কোথায় থাকে এবং কোথা থেকে এসেছে। কিন্তু মিথিলা লোকটির নাম জানে। অবশ্য যে নামে লোকটি স্বপ্নে ওকে দেখা দেয়, বাস্তবে লোকটির তা-ই নাম কিনা-কে জানে! মিথিলার মন বলছে, লোকটির নাম অপুই হবে। আজকাল মিথিলার অদ্ভূত বোধ কাজ করে। হঠাৎ হঠাৎ ও যা ভাবে, পরে দেখা যায় তা সত্যি হয়ে যায়! এই তো সেদিন, ও ভাবছিল শামীম আজ দেরীতে বাড়ি ফিরবে। ওকে ফোন করে বলবে অফিসের কাজে ভীষণ ব্যস্ত আছে। কিন্তু শামীম ওকে মিথা কথা বলে ওর সেক্রেটারী রোমেলার সঙ্গে ডেট করতে যাবে গুলশানের একটি রেষ্ট হাউজে। সত্যি সত্যি সেদিন সন্ধ্যায় শামীম ওকে ফোন করে জানালো যে, সে অফিসের কাজে হঠাৎ ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। ইউরোপ থেকে ডেলিগেট এসেছে। তাদের সঙ্গে ডিনার করতে হবে। শামীমের ফোন পাবার পর মিথিলা সন্ধ্যায় গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেল গুলশানের দিকে। ড্রাইভারকে বললো হোয়াইট ক্যাসেল রেষ্ট হাউজে যেতে। ও এই রেষ্ট হাউজে এসে রেষ্টহাউজের কেয়ারটেকারের হাতে পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে জানতে চাইলো,
‘বলুন তো, এই মুহুর্তে আপনাদের রেষ্ট হাউজে কে আছে?’
কেয়ারটেকার সাবধানী গলায় বললো,
‘শামীম আহমেদ নামে একজন হাই অফিশিয়াল এসেছেন তার বান্ধবীকে নিয়ে। তিনি এখানে প্রায়ই আসেন, ম্যাডাম। আমি যে তথ্য দিয়ে দিলাম, তা বলবেন না, প্লিজ! তাহলে আমার চাকরিটা যাবে!’
মিথিলা কাউকে কিছু বলেনি। এমন কি, শামীমকে এ ব্যাপারে ও কিছুই জিজ্ঞেস করেনি। ওর মনে হয়েছে, এ কথা জিজ্ঞেস করে কোন লাভ হবে না। সংসারে অহেতুক একটা ঝড় বয়ে যাবে। ও শামীমের অনেক রকম কপটতা আজকাল বুঝতে পারছে। ওর লাম্পত্যের খবর টের পেয়ে যাচ্ছে। শামীম বাইরে খারাপ কাজ যাই করছে, এর আগেই ওর চিন্তার জগতে ম্যাসেজ চলে আসছে। ঐ লোকটিকে স্বপ্ন দেখার পর থেকেই ওর মধ্যে অদ্ভূত এ সব কান্ড ঘটছে। মিথিলা এ সব কথা কাউকেই বলছে না। মিথিলা বুঝতে পারছে, ওর মধ্যে এক ধরনের হেলুসিনেশন কাজ করছে। তবে লোকটিকে নিয়ে প্রায় নিয়মিত স্বপ্ন দেখার ব্যাপারটির কোন ব্যাখ্যা ও বের করতে পারছে না। গত তিন মাস যাবত ও লোকটিকে নিয়ে অদ্ভূত অদ্ভূত স্বপ্ন দেখে আসছে। কাল রাতেও লোকটিকে ও স্বপ্ন দেখেছে। ও স্বপ্নে দেখলো মিথিলা লোকটির অর্থাৎ অপুর বাম হাত জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছে প্যারিসের আইফেল টাওয়ারের নিচে। মিথিলা মুগ্ধ চোখে আইফেল টাওয়ারের দিকে তাকিয়ে বললো,
‘দেখো অপু, আইফেল টাওয়ারটার কেমন আকাশ ছোঁয়ার সাধ! ওর এই সাহসটাই কি শিল্প?’
অপু একটু হাসলো। ও বললো,
‘আমি এই আইফেল টাওয়ার দেখে হতাশ, মিথিলা। এটি নিয়ে বিশ্বব্যাপী কত তোলপাড়, গল্পকথা! আমার মনে হচ্ছে, ফ্রান্স সরকারকে ঢাকার ধোলাইখালের লৌহ ব্যবসায়ীদের কাছে এখন এটি বিক্রি করে দেয়া উচিত।’
‘কেন!’
‘বিশ্বজুড়ে এখন গগণচুম্বি অট্টালিকার সংখ্যা বেড়েই চলেছে। আকাশ ছোঁয়ার মানদন্ডে এই টাওয়ার এখন আর অপ্রতিদ্বন্দ্বি নয়। তা ছাড়া জরাজীর্ণ লোহার এই টাওয়ারে রঙের প্রলেপ দিয়ে লাবন্য আনা হয়তো যায়, কিন্ত আমি এর মধ্যে কোন শিল্প খুঁজে পাই না। তাই যার মধ্যে শিল্প নেই, তাকে নিয়ে অহংকারের মহত্ব কেন?’
এই হচ্ছে অপু। সবকিছুর মধ্যে একটা বিপরীত বক্তব্য দেবে, কিন্তু খুবই যুক্তি তুলে ধরে। ও যখন কথা বলে, তখন শুধু তন্ময় হয়ে শুনতে হয়। মিথিলা মুগ্ধতার রেশ নিয়ে ওকে আরো আঁকড়ে ধরে। অপু ওকে বুকের কাছে টেনে নিয়ে যেই ওর ঠোঁটে ঠোঁট স্পর্শ করলো, তখনি ওর ঘুম ভেঙে গেল। অপুকে নিয়ে ও প্রায় ভীষণরকম রোমান্টিক স্বপ্ন দেখছে। এর কোন অর্থ খুঁজে পাচ্ছে না মিথিলা।
লোকটি দাঁড়িয়েছিল হিথ্রো এয়ারপের্টের তিন নম্বর লাউঞ্জে। এই লাউঞ্জে এসে দাঁড়িয়ে শামীমের জন্য অপো করছিল মিথিলা। ওরা ওদের নির্ধারিত ফাইট মিস করেছে। পরবর্তী ফাইট ধরা যাবে কিনা- এর খোঁজে শামীম গেল এ্যামিরাটস এয়ারলাইনেরর কাউন্টারে। মিথিলা দাঁড়িয়ে অপো করছিল। এ সময় হঠাৎ লোকটিকে দেখতো পেল ও। লোকটিকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে ওর সর্বাঙ্গে একটা বিশেষ শিহরণ ঢেউ খেলে গেল। এমন কখনো হয়নি ওর। ও চেষ্টা করেও লোকটির দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নিতে পারলো না। ওর বুক কাঁপছে। এমন কি হয়! মিথিলা কেমন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছিলো। ঠিক এমন সময় লোকটি ওর পাশে এসে বললো,
‘কেমন আছো, মিথিলা?’
বিস্ময় থেকে আরো বেশি কিছু বিস্ময় তুমুল নাড়িয়ে দিল মিথিলাকে। ও কয়েক মুহুর্ত বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। ওর স্বাভাবিক জ্ঞান যেন লোপ পেল। লোকটি ফের বললো,
‘তুমি যে জীবন নিয়ে আছো, আসলে তুমি সে জীবনের নও। তাই হয়তো আমাকে চিনতে পারছো না। আমি অপু! চেনার চেষ্টা করো!’
কতটা প্রলয় হলে পাহাড় নদী একাকার হয়, জানে না মিথিলা। তবে এই মুহুর্তে ওর ভেতরে ভীষণ প্রলয় হচ্ছে। ও ভেসে যাচ্ছে অন্যলোকে। ও ছাড়িয়ে যাচ্ছে এক জীবন থেকে অন্য এক জীবনে। ও মূর্তমান, অথচ যেন বিমূর্ত! অপু ওর সম্বিত ফিরিয়ে আনার মত করে বললো,
‘মনে করো দেখো, তুমি জলাধার পছন্দ করতে বলে আমি তোমার জন্যই গড়েছিলাম ভেনাস নগরী! তোমাকে অমরত্ব এনে দেব বলে, আমি সূচনা করেছিলাম মমি সভ্যতার! তোমাকে ইতিহাসে ঠাঁই দেব বলে তৈরি করেছিলাম অমরকীর্তি তাজমহল! তুমি ভুলে গেছো ওসব!’
মিথিলার চোখ বিস্ফোরিত হয়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে। ওর ভেতরে কেউ যেন কথা বলতে চাইছে। ওর কণ্ঠ থেকে আর্তনাদের মতো বের হলো,
‘অপু!’
‘হ্যাঁ, মিথিলা, হ্যাঁ! চিনতে পারছো!’
‘কিন্তু তুমি তো জাগরণে আসো না! স্বপ্নে আসো। তুমি কি শুধুই স্বপ্ন?’
‘না, আমি শুধু স্বপ্ন নই! আমি তোমার আরেক জীবন!’
‘এটা কেন? কেন তুমি আরেক জীবন?’
‘প্রায়শ্চিত্ত! তোমাকে ভীষণ, ভী-ষ-ণ রকম ভালোবাসার প্রায়শ্চিত্ত! আদমের গন্ধম খাওয়ার মত প্রায়শ্চিত্ত!’
‘কেন এই প্রায়শ্চিত্ত? কতদিন এই প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে?’
‘যতদিন তোমার এই জীবনের অভিসম্পাত শেষ হবে না! যতদিন তোমার আমার অন্যজীবন এক বৃন্তে ফুল হবে না! যতদিন অন্যলোকে তোমার আমার দেখা হবে না!’
‘তাহলে! তুমি কেবল স্বপ্নেই দেখা দেবে!’
‘বাস্তবতা যেখানে সীমাহীন দেয়াল তুলে রাখে, সেখানে স্বপ্নই তো গোপন আনন্দের সোপান। স্বপ্নের মধ্যেও আমি তোমাকে নিয়ে যাবো অন্য জীবনে। যাবে?’
‘তোমাকে ফেরাবো সাধ্য আমার আছে! ছিলে স্বপ্নে, আজ এলে কাছে।’
এ কথা বলে থামলো মিথিলা। ও এক ধরনের ঘোরের মধ্যে আছে। অপু হাত বাড়িয়ে মিথিলার হাত ধরলো। এই প্রথম মিথিলা অপ্রার্থিব শিহরণে কেঁপে উঠলো। অপু মিথিলার হাতে এক টুকরো সবুজ রঙের কাগজ গুঁজে দিয়ে বললো,
‘ঢাকায় যাচ্ছো। এই কাগজে আমার বাড়ির ঠিকানাটা আছে। মা অনেক বছর ধরে আমার জন্য অপো করছেন। তাকে বলো, একদিন আমি ফিরবো।’
মিথিলা কাগজটা দু’হাতে টেনে ওর চোখের সামনে মেলে ধরে কাগজে লেখা ঠিকানাটা পড়ে নিল। এরপর তাকাতেই দেখলো ওর সামনে অপু নেই। আশেপাশে কোথাও নেই। ও কি সত্যিই এসেছিল? ও কি মুহুর্তেই মানুষের ভিড়ে হারিয়ে গেল? কেন? প্রশ্নগুলো নিয়ে মিথিলা স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। কতণ এভাবে দাঁড়িয়েছিল, ও নিজেও জানে না।
তিনমাস পেরুলো, স্বপ্নে দেখা দিল না অপু। এই স্বপ্নহীনতার কষ্ট নিয়ে মিথিলা কেমন নিজের ভেতরে নিজে মরে যেতে লাগলো। অস্বস্থি আর ছটফট বাড়তে লাগলো ওর। একদিন ও হাজির হলো অপুদের বাড়ি। ‘তিনমাস আগে হিথ্রো বিমান বন্দরে অপুর সঙ্গে ওর দেখা হয়েছিল’ এ কথা শুনে অপুর মা ভীষণ বিস্মিত হলেন। তিনি মিথিলাকে জড়িয়ে ধরে চোখের জল ফেলে বললেন,
‘মা, তোমার ভুল হয়েছে। নাইন ইলাভেনে সন্ত্রাসী হামলায় টুইন টাওয়ার ধ্বংসের সঙ্গে সঙ্গে অপুও ওখানে মারা গেছে। সে তো পাঁচ বছর হলো! ও ফিরে আসবে কীভাবে!’
অপুর মায়ের এই বিস্ময়ভরা প্রশ্নের সামনে বিপন্ন হয়ে গেল মিথিলা। ওর মনে হলো এই জীবন নয়, ওর অন্য জীবন চাই, হোক তা অন্যলোকে।