বিষকাঁটা
দর্পণ কবীর
একটা স্বপ্ন পূরণ হবার পর আরেকটি স্বপ্ন এসে হাজির হয়। স্বপ্ন পূরণের আগে মনে হয়, এটিই জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্বপ্ন। কোনভাবে স্বপ্নটি পূরণ হলে মনে হয় অসম্ভব একটি প্রাপ্তি যোগ হলো জীবনে। কিন্তু এরপর যখন আরেকটি স্বপ্ন এসে কড়া নাড়ে, তখন নতুন স্বপ্নটিই সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ বলে বিবেচিত হয়। সেটি পূরণ হলেও একই পুনারাবৃত্তি! জীবন ও স্বপ্নের সাথে যেন এক লুকোচুরি খেলা। হার্ডসন নদীর পাড়ে বসে এ কথাই ভাবছিলো রিমন। ওর মন ভালো নেই। মন খারাপ করে ও অনেক কিছু ভাবছিলো কিংবা বলা যায় একটি বিষয় নিয়েই ও ভাবছিলো। ওর জীবন, বর্তমান সময় এবং আগামী দিনে ও কী করবে-এটাই ওর ভাবনার বিষয়। দুশ্চিন্তার বিষয়। এই দুশ্চিন্তা মাথায় চেপে ও বসে আছে হার্ডসন নদীর পাড়ে। শান্ত নদী, কিন্তু এ নদীর বয়ে চলায় এক ধরনের গাম্ভীর্যতা রয়েছে। এই নদী যে কাউকেই কাছে টানে। কোন চঞ্চলতা নেই, কিন্তু সৌন্দর্যের রহস্যজাল রয়েছে নদীর বুক জুড়ে। রাতের ম্যানহাটান বরাবরই আলোকিত। রাতে আলোর দ্যুতিতে ম্যানহাটানের অসম্ভব সৌন্দর্য ঠিকরে বেরোয়। রাতের অপরূপ ম্যানহাটান সবাইকে টানে। হয়তো এ কারণেই এ শহর কখনো ঘুমাতে পারে না। এ জন্য শহরটা কী তৃপ্ত? নাকি ওর মতো ম্যানহাটানও নিদ্রাহীনতার কষ্টে ছটফট করে? প্রশ্ন রিমন ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। দীর্ঘশ্বাসটি যেন স্বপ্ন ভাঙ্গা বেদনার জলপ্রপাত হয়ে নেমে যায় হার্ডসন রিভারের শান্ত জলে। কিংবা রিমনের গোপন কান্না গলে গলে পড়ে।
এক অসম্ভব স্বপ্ন পূরণের ল্য নিয়েই রিমন স্বপ্নের দেশ আমেরিকায় এসেছিল। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে পাড়ি দিয়েছিল আটলান্টিক মহাসাগর। আমেরিকায় এসে দেখে ওর স্বপ্নের অপমৃত্যু ঘটে গেছে। এখানে এসে দেখে ওর স্বপ্নের রাজকুমারী আর ওর নেই! যার জন্য আটলান্টিক পাড়ি দিল, সে বিয়ে থা করে দিব্যি সংসার করছে। এ যেন জয়ের মালা গলায় পড়ার সময় পরাজয়ের চরম বিষাদ। স্বপ্ন ভাঙ্গা বেদনায় স্তব্ধ হয়ে যায় রিমন। কৈশোরের প্রেম বুকের ভেতর এক পশলা আগুন হয়ে থাকে। প্রায় ৭ বছর পর ম্যারিল্যান্ডে তিথির সাথে দেখা হয়েছিলো রিমনের। তিথি অন্যের সংসারে নতুন স্বপ্নে আলোকিত করে আছে রাতের ম্যানহাটানের মতোই। রিমনের সাথে দেখা হতেই তিথি ‘হঠাৎ দেখা পরিচিত কেউ’ এমন ভাব প্রকাশ বলেছিলো,
‘আপনি কীভাবে এলেন আমেরিকায়! কবে এলেন?’
রিমন তখন নিজের ভেতরে ভেঙ্গে যাওয়া বিধ্বস্ত এক মানুষ। নিজেকে সামলে নিয়ে ও বলেছিলো,
‘সংসার নিয়ে তো বেশ ভালোই আছো!’
তিথির দু’ চোখ যেন জ্বলে উঠেছিলো এক ধরনের অহংকারে। সেদিনই রিমনের জীবনের সবচেয়ে অসম্ভব গুরুত্বপূর্ণ স্বপ্নটির অপমৃত্যু ঘটে। রিমন ধীরে ধীরে সামলে নেয় নিজেকে। স্বপ্নকে ছাইচাপা দিয়ে ও দাঁড়িয়ে থাকে স্বপ্নহীন মানুষের মতো। গতিময় শহর ওকেও টেনে নিয়ে যায়। রিমন চলতে থাকে।
জীবন থেকে একটি অধ্যায়ের ইতি টেনে ও মানিয়ে নিয়েছিলো নিজেকে। ডলারের পেছনেই ও ছুটছিলো। রাতের ম্যানহাটানে ও ছুটে বেড়াতো ক্যাব নিয়ে। দিনে ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে যাওয়া। কিন্তু আবারো স্বপ্নের সম্মোহন নিয়ে রিমনকে নাড়িয়ে দেয় তিথি। যে ‘প্রেম’ অপ্রাপ্তির দহনে পুড়ে ছারখার তারই পুনুরুত্থান কেন? কান্নার অথৈ জল আর গ্লানির লাভা সরিয়ে তিথি একদিন রিমনের কাছে এসে বললো,
‘আমি শুধু তোমার। অন্য পুরুষকে বিয়ে করে ভুল করেছিলাম। এবার তোমার ভালোবাসার মূল্য দিতে চাই।’
তিথির চোখের জলের সামনে রিমনের সব কিছু এলোমেলো হয়ে গেল। একটা অস্বস্থির জানান দিয়ে রিমন বললো,
‘তোমার জন্য কত কষ্ট করে আমি এ দেশে এলাম। আর এসে দেখি, তুমি সংসার করছো। আমাকে বিয়ের খবরটা জানাতে পারতে!’
‘আসলে একটা ট্রাপে পড়ে আমাকে বিয়ে করতে হয়েছিল। সে অনেক কথা। তোমাকেই আমি ভালোবেসে ছিলাম। এখনো বাসি। এই সত্যটুকু জেনো।’
‘কিন্তু এখন আর কী হবে? তোমার স্বামী আছে, দুটি ফুটফুটে ছেলেও আছে।’
‘ওকে আমি ডির্ভোস দিয়েছি।’
‘ডিভোর্স!’
‘হ্যাঁ, ডির্ভোস দিয়েছি। তুমি কি আমাকে বিয়ে করবে?’
এই প্রস্তাবটির জন্য ঘোর লাগা স্বপ্নে কতগুলো বছর কাটিয়ে দিয়েছে রিমন। কিন্তু ও প্রস্তাবটি পেল বড্ড অসময়ে। যখন জীবনের অংক মেলানো দায়। ও তাৎণিক কিছুই বলতে পারলো না। তিথি নাছোর বান্দা। রিমনের দুর্বল জায়গায় হাত দিল। বললো,
‘তোমার তো বৈধ কোন কাগজ নেই। আমাকে বিয়ে করলে তুমি বৈধ কাগজ পেয়ে যাবো।’
একদিকে হৃদয়ের রক্তরণ, অপরদিকে নিজের অসহায়ত্ব। প্রেম কিংবা প্রেমের মোহ থেকে বেরিয়ে আসার শক্তি নেই রিমনের। ভালোবাসা নামক তীব্র আবেগের জয় হলো। ও তিথিকে বিয়ে করে ফেললো। সব কিছু ঘটে গেল দ্রুত। বিয়ের পর ওর সঞ্চিত অর্থ কর্পূরের মতো উড়ে গেল তিথির বিলাসী শখের মূল্য দিতে গিয়ে। ভালোবাসার কাছে অর্থ খুবই তুচ্ছ। স্বপ্নের মতোই কেটে গেল কয়েক মাস। এরপরই হঠাৎ করে স্বপ্নটা ফের ভাঙ্গতে শুরু করলো। এক সময় ভেঙ্গে চূর্ণ হয়ে গেল। তিথিকে উজার করে নিজের ভালোবাসা বিলিয়ে দিতে চেষ্টা করেছে রিমন। সপ্তাহের সাতদিন কাজ করে যথেষ্ট অর্থ উপার্জন করছিলো। সব অর্থ তুলে দিতো তিথির হাতে। কিন্তু তিথি তাতেও যেন সন্তুষ্ট নয়। শপিং করাটা ওর হবি। ব্র্যান্ড আইটেম ছাড়া কিছু কিনে না। মাসে মাসে সোনার গহনা চাই। ওর চাহিদা পূরণ করতে গিয়ে রিমন যেন ক্রীতদাসে পরিণত হয়ে যায়। ভালোবাসাটা ফিকে হয়ে আসতে থাকে। এখানেই শেষ নয়, তিথি প্রতিদিন টেলিফোন নিয়ে ব্যস্ত থাকে সাবেক স্বামীর সাথে কথোপথনে। বিষয়টি জানার পর রিমন কেমন চুপসে যায়। তিথি রিমনকে বলে,
‘সাত বছর ওর সাথে সংসার করেছি। ইচ্ছে করলেই কি ওকে ভুলে থাকা যায়?’
রিমন এর কোন যুতসই জবাব খুঁজে পায় না। কিন্তু নিজের মনে আগুনও বাড়তে থাকে। ভালোবাসার স্বপ্নটা যখন চূর্ণ, তখনও নতুন একটা স্বপ্ন রিমনকে টেনে হিঁচড়ে সামনে এগিয়ে নিয়ে যায়। তা হলো বৈধ কাগজের স্বপ্ন। এরমধ্য দিয়েও যদি বৈধ হওয়া যায়, সেটাই না হয় প্রাপ্তির খাতায় যোগ হবে। তিথিকে খুশি রাখার সর্বাত্মক চেষ্টা করে যায় রিমন। কিন্তু স্বপ্নটা বিষ কাঁটা হয়ে ওর ভাগ্যকে এফোঁড়-ওফোঁড় করে দেয়। একদিন কাজ থেকে ফিরে ও দেখে তিথি নেই। ছোট্ট একটি চিরকুট লিখে তিথি চলে গেছে। চিরকুটে ও লিখেছে ‘তোমার সাথে জীবন কাটানো সম্ভব নয়। তাই চলে গেলাম। ডাকযোগে ডিভোর্স লেটার পেয়ে যাবে।’
তিথির চলে যাওয়াটা মেনে নেয়া সহজ ছিল। কিন্তু তিথির চলে যাওয়ার মধ্যে ওর বৈধ কাগজ প্রাপ্তির প্রচেষ্টা এখানেই ফ্রিজ হয়ে গেল। রিমন স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে ওর বিপন্ন ভবিষ্যতকে। রিমন বিশেষ রেজিষ্ট্রেশন কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে স্ট্যাটাজ পরিবর্তনের আবেদন জানিয়েছিলো। আদালতে ওর আবেদন বিচারাধীন রয়েছে। সিটিজেন নাগরিককে বিয়ে করার কারণে ও এক সময় বৈধ স্ট্যাটাজ পাবে, এ আশাটুকুই ওর অন্ধের যষ্টির মত ছিল। অর্থ গেছে, যাক। জীবনে কলংকের দাগ লেগেছে, লাগুক। ভালোবাসা ‘প্রহসন’ হয়ে গেছে, হোক। তবুও রিমন বৈধ কাগজটা পেলে সান্ত্বনা পেত। কিন্তু এখন কী হবে? রিমন কোন কিছুই ভাবতে পারে না। আলোকিত ম্যানহাটানে ও কোন আলো দেখতে পায় না। ওর চারপাশে শুধু অন্ধকারের কুহেলিকা!