রফিক অতীতে আমাদের বন্ধু ছিলো, বর্তমানে আমাদের বন্ধু নয় এমন পরিচিত-প্রিয়জন এবং ভবিষ্যতে হয়তো হয়ে যাবে - অবসরে বলা যায় -এমন একটি গল্প।
*
পঞ্চম শ্রেণী শেষে আমরা যেবার হাইস্কুলের খাতায় নাম উঠিয়ে নিজেদের এবং বাপ-চাচাদের মুখ উজ্জ্বল করেছি বলে লেখাপড়া শিকেয় তুলেছিলাম, সেবারই রফিকের সাথে আমাদের প্রথম পরিচয় হয়েছিল। গোবেচারা রফিক তখন সর্ষে ভেজানো চুলে চিরুনি চালিয়ে , হাফ-প্যান্টের ভেতর নিজেকে সেঁধিয়ে, খালি গায়ে, গামছা কাঁধে স্কুলে আসত। ওর জামা, জুতো, ব্যাগ কিছুই ছিলো না। তাই লিকলিকে দুই হাতের মধ্যিখানে ছেঁড়া কিছু বই নিয়ে মাস্টার মশাইয়ের ‘বই এনেছিস?’- প্রশ্নের উত্তর খুঁজত।
অতঃপর রফিকের পিঠে সপাং সপাং শব্দ হলে, আমরা পেছনের বেঞ্চিতে ম্যাজিক দেখতাম। আমাদের হতদরিদ্র মাস্টারমশাই তার দারিদ্র্যের সচিত্র প্রতিবেদন রফিকের পিঠে দেখতে পেয়েই এমন উতলা হয়ে উঠতেন কি না – সে তথ্য আমাদের তখনো জানা হয় নি। তবে আমরা ভীষণ আনন্দ পেতাম। আমাদের আদিগন্ত অক্ষত পিঠ আর রফিকের মানচিত্রময় পিঠের বিভেদতলে যে চীনের মহাপ্রাচীর অবস্থিত, সে কথা আমরা তখনই টের পেয়েছিলাম।
পরিপাটি উজ্জ্বল ক্লাসরুমে রফিকের মতো এরকম ম্যাদামারা কাউকে না দেখতে পেলেই যেন বেঁচে যাই, এরমকই মনোভাব ছিলো আমাদের। দল পাকিয়ে আমরা ওর সামনে গিয়ে দাঁড়াতাম, অট্টহাসিতে বিদ্রুপ মাখিয়ে বলতাম , একি রফিক ! তোর প্যান্টের পেছনে ফুটো কেন?
ভাবলেশহীন রফিকের চোখে কোনো বিব্রত চামচিকা অথবা খ্যাপাটে কুকুর দেখতে না পেয়ে আমাদের আয়োজন যখন ব্যর্থ হত; তখন আমরা ওর উদোম গায়ের দিকে তাকিয়ে ভ্রূকুটি করতাম। বলতাম, কিরে এরকম ল্যাংটো হয়ে ক্লাসে আশিস ক্যানো, তোর লজ্জা শরম নেই? ও মাথা নিচু করে থাকত। আমরা পরস্পরের দিকে তাকিয়ে ‘এইবার জিতে গেছি’ ভেবে মুখে হাত চেপে হাসতাম। কিন্তু রফিকের মধ্যে গা-ছাড়া ভাব দেখে; আর ওর নিঃসঙ্কোচ ‘জামা নেই’- উত্তর শুনে আমাদের উৎসাহে ভাটা পড়ত। বিব্রত সৈনিকের মত কিংকর্তব্যবিমূঢ় উপলব্ধি নিয়ে, আমরা নিজ নিজ আসনে ফিরে আসতাম।
ক্লাসের বিরতিতে সবাই বাইরে গেলেও রফিক উদাস চোখে ব্ল্যাকবোর্ডের দিকে হা করে, একমনে কি যেন ভাবত। আমরা তখন ক্যাবলাকান্ত রফিকের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে একটু আকটু খুনসুটি করতাম, কখনোবা চুপিচুপি পেছনে গিয়ে হালুম করে ভয় দেখাতাম। আর রফিকের সরলতা কোনো কোনোদিন নির্বুদ্ধিতায় বদলে গেলে ‘শালা একটা আস্তো রামছাগল’- বলে মনের মধ্যে অদ্ভুত এক আনন্দ পেতাম।
ওর গামছা ধরে টানাটানি করে, ছেড়া বইগুলো লুকিয়ে রেখে, আর পিঠের জমিনে বিচিত্র মানচিত্র দেখেই আমাদের স্কুলজীবন হয়ে উঠেছিল অপার আনন্দময় ।
শৈশবে ঘুড়ির মাঞ্জা দেয়া সুতোয় প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করে, কিংবা ডানহাতের চিমটিতে ফড়িং ধরেও সে আনন্দ আমাদের কোনদিনও হয়নি। অন্যকে হেয় করার এমনই অপার আনন্দের সাথে রফিকের মাধ্যমেই আমাদের প্রথম পরিচয় হয়েছিল।
*
বছরের পর বছর অপরিবর্তনীয় রফিককে দেখে আমরা ভেবেছিলাম - জীবন এমনি যাবে, আমাদের চারদেয়ালে কোকিলের আনাগোনা বাড়লে, আমরা পায়রা হয়ে আকাশে উড়ব। রফিক চিরকাল মাটিতেই থাকবে আর আমাদের বিষ্ঠাগুলো মাথায় নিয়ে নিজেকে ধন্য মনে করবে। ভেবেছিলাম, এভাবেই রাতের পর রাত জেগে লেখা প্রেমপত্রগুলো রফিকের মাধ্যমেই আমাদের হবু প্রেমিকাদের হাতে গিয়ে পড়বে, আমরা পত্রদূত রফিককে একটু শুকনো হাসি উপহার দিয়েই আপন কর্তব্য সমাপণ করব। তারপর কোনো একদিন আকাঙ্ক্ষিত অর্ধাঙ্গিনীদের ওপর অধিকার প্রতিষ্ঠা করেই আমরা চিরসুখী হব। ছেলেমেয়েদেরকে নামতা শেখাব, এক এককে এক, দুই এককে দুই,...; তখন রফিকের কথা কে আর মনে রাখবে !
কিন্তু একদিন - সে অনেকদিন পর - হাইস্কুলের গাড়ল ম্যাদামারা ছেলেটার হঠাৎ মেধাতালিকায় প্রথম হওয়ার সংবাদে, আমাদের মধ্যে বিস্ময়ের বিস্ফোরণ ঘটেছিল। আর মাস্টারমশাই, যাকে আমরা রফিকের জন্য সাক্ষাত জমদূত বলে ভাবতাম, রফিককে একজোড়া জামা-প্যান্ট উপহার দিলে - আমাদের বিস্ময় রীতিমত হিমালয় ছুঁয়েছিল। যার মানচিত্রময় পিঠ দেখতে দেখতে আমরা অষ্টমশ্রেণির বারান্দা অতিক্রম করে মাধ্যমিকের দিকে ছুটেছি, সে আমাদের ডিঙিয়ে যাবে, এমন দুঃস্বপ্ন আমরা কোনোদিনও দেখিনি।
রফিক এর আগে কখনোই আমাদের বন্ধু ছিলো না, বরং খেলার উপকরণ ছিলো; ছিলো অবসরের আনন্দ। আমরা বলতাম, ঐ দেখ রামছাগলটা আসছে। আর হা হা হা অট্টহাসি। সেই আমরাই হঠাৎ এই রামছাগলের সাথে সখ্যতা গড়তে তাকে ঘিরে ধরলাম। গালভরা হাসি নিয়ে বললাম, আমরা জানতাম তুই পারবি। তুই তো আমাদেরই বন্ধু।
ওর অন্তরে অবিশ্বাস ছিলো কিনা জানিনা, তবে চোখেমুখে বন্ধুসুলভ আন্তরিকতা ছিল। তাই আমরা রফিককে প্রয়োজনীয় বন্ধু তালিকায় স্থান দিয়ে পাটিগণিতের ‘থ্রি পয়েন্ট এইট’ চ্যাপ্টারটা উপহার দিয়েছিলাম। ওর নাটাইয়ের সুতোয় জটিল রাসায়নিক সমীকরণ বেঁধে দিয়ে বাংলা দ্বিতীয়পত্রের ‘স্বদেশপ্রেম’ রচনাতে আমরা আশ্রয় খুঁজেছিলাম। রাদারফোর্ডের সাথে তাই আমাদের কোনোদিনই জানাশোনা হয়নি। প্যাসকেল কিংবা আর্কিমিডিসও তাই আমাদের বন্ধু ছিলেন না।
রফিক সেই আগেকার মতই মাথা নিচু করে সব আবদার মিটিয়ে যেতে লাগল। আমাদের প্রাণিবিজ্ঞানের প্রাকটিকাল কিংবা জ্যামিতির অতিরিক্ত উপপাদ্য রফিকের হাত ছুঁয়ে যৌবনে পৌঁছেছিল বলেই, আমাদের বাপ-চাচারা আমাদের জন্য বরাদ্দকৃত হাতখরচে কোনদিনও রক্তচক্ষু রাখেননি।
কিন্তু যে রফিককে আমরা ভেবেছিলাম নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর অমলকান্তি, সেই রফিকই আমাদের সামনে ধীরে ধীরে ফজলুল হক হয়ে উঠলো। মাধ্যমিকের ফলাফল প্রকাশের পর যেদিন আমরা বাতাসবিহীন বেলুনের মতো চুপসে গেলাম, সেদিন রফিক - কপালে আশীর্বাদের পাত্র এঁকে - মাস্টারমশাইয়ের পা ছুঁয়েছিল।
*
তারপর একদিন পাঠ্যবইয়ের অংকের হিসেব বাদ দিয়ে আমরা পৈতৃক সম্পত্তির হিসেবে মনযোগী হলে রফিকের সাথে আমাদের একটা স্থায়ী বিচ্ছেদ হয়ে যায়।
তবু মনে পড়ে, সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ের সাতান্ন নম্বর পৃষ্ঠায় হাজী মহসীনকে দেখিয়ে রফিক বলেছিল, ‘দেখিস, আমিও একদিন ইতিহাস হয়ে যাব’। আমরা বন্ধুরা গোপণে খুব হেসেছিলাম, কপটতা পেটে চালান করে দিয়ে মুখে বন্ধুসুলভ ভদ্রতা রেখে বলেছিলাম, ‘হ্যাঁ, অবশ্যই। তোকে দিয়েই হবে, বুঝলি।’
অথচ আমরা বিশ্বাস করতাম, রফিককে দিয়ে কিচ্ছু হবে না; ওর মা চিরকাল অন্যের বাড়িতে থালাবাসন ধোয়ার কাজ করে যাবে, ওর বাবা গাঁজার নেশায় বুদ হয়েই দিন কাটাবে, আর আমরা এইসব দেখে হা হা হা করে চিরকাল হেসেই যাব। আগাগোড়া ভণ্ডামী মগজে পুরে কথার পিঠে কথা সাজিয়ে, রফিকের অনাবৃত কাঁধে হাত রেখে বলব, ‘কিচ্ছুটি ভাবিস না রফিক, আমরা জানি তোর একদিন হবেই হবে’।
রফিক অন্তর্যামী নয় বলেই আমাদের কথা বিশ্বাস করেছিল। আর তাই হয়তো, মাধ্যমিকের বিচ্ছেদের পর রফিকের গল্প কেমন যেন রূপকথার মতো বদলে গেল। কোনো একদিন শোনা গেল, রফিক স্টার মার্কস নিয়ে উচ্চমাধ্যমিক উতরে গেছে। কখনোবা জানা গেল, ওর গাঁজাখোর বাবা গাঁজার কল্কে সঙ্গে করে স্বর্গবাসী হয়েছে, এবং মাকে সঙ্গে নিয়ে সে ভাগ্যবিড়ম্বিতদের খাতায় নিজেকে স্ট্যাপলার করে নিয়েছে। আবার কখনোবা শুনলাম, রফিক এখন ভালোই আছে। উচ্চশিক্ষার জন্যে বৃত্তি নিয়ে বিদেশ পাড়ি দিচ্ছে। অনেক নাম হয়েছে ওর। সেসব রূপকথার সত্যমিথ্যা যাচাইয়ের মতো অনর্থক সময় আমাদের হাতে তখনো ছিলো না।
ততদিনে আমাদের গুরুজনে মতি হয়েছিল। উড়নচণ্ডী স্বভাবকে ঘরে থিতু করার অভিপ্রায়ে, পিতৃআজ্ঞা শিরোধার্য করে, আমরা বংশগতির ধারা সচল রাখতে সম্মত হয়েছিলাম।
রমণীর ষোলকলা প্রেমে নিজেদের সৌভাগ্যবান বিবেচনা করে কয়েক বছরের মাথায় আমরা বাবা হলে, সৃষ্টিকর্তার মতো আনন্দে তখন আমাদের সাময়িক অন্ধত্ব জেগেছিল। তারপর ঠিক কবে যেন একঘেয়ে রতিক্রিয়ায় আগ্রহ হারিয়ে আমরা জীবনের মানে খোঁজার দার্শনিক শখ করেছিলাম – তা আর মনে নেই।
সন্ধ্যা হলেই আমাদের আড্ডা জমে উঠত বাজারের আলোঝলমল বড়ো দোকানটিতে। তারপর রাতের আকাশ - ঘন মেঘে অবলুপ্ত – করে দিয়ে আমরা ওষুধের দোকান থেকে ঘুমের বড়ি কিনে বাড়ি ফিরতাম। রফিক তখন হারিয়ে গিয়েছিল অনেক দূরের অচেনা কোনো আকাশে। শুনেছিলাম, ওর মাও নাকি ডুবে গেছেন সময়ের অনিবার্য চোরাস্রোতে।
আমাদের তখন সংসারসম জ্বালা দুই কাঁধের উপরে ‘সমগ্র বাংলাদেশ পাঁচ টন’ বলে দুরন্ত গতিতে ছুটেছিল বলেই আমরা রফিককে ভুলে গিয়েছিলাম অথবা ভুলে যেতে চেয়েছিলাম চিরতরে।
*
আমাদের গুরুজনেরা গত হলে এবং ছেলেমেয়েগুলো ক্রমশ পুরুষ আর নারী হয়ে উঠলে - পৃথিবীর ঘূর্ণন গতির সত্যতা আমরা প্রথম উপলব্ধি করি। ভোরে ঘুম থেকে উঠে নিজেদের তখন ভীষণ ক্লান্ত কোনো বৃদ্ধ মনে হয়। তারপর একদিন আমাদের ছেলেমেয়েরা নিজেদের দায়িত্ব নিজেদেরই হাতে নিয়ে স্বাবলম্বী হতে চাইলে আমরা সত্যিকারের বৃদ্ধ এবং অপাক্তেয় হয়ে উঠি। শর্করার আধিক্যে বিপর্যস্ত দেহটা তখন আকাশে ছায়াপথ খুঁজে ফেরে। আর বৃদ্ধমাত্রই ফেলে আসা শৈশবে সুখ খুঁজে বেড়ায় বলেই - আমাদের আবারো একদিন রফিকের কথা স্মরণ হয়। অথচ ততদিনে যোগাযোগের সকল সুত্র সুতোকাটা ঘুড়ি হয়ে কোথায় কোন চিলেকোঠার আড়ালে যে হারিয়ে গেছে – আমরা সে তথ্য আর খুঁজে পাই নি।
আমাদের ভাঙা টেপরেকর্ডার হেমন্তের সুরে ‘তুই ফেলে এসেছিস কারে, ও মন রে আমার’- বলে কেঁদে উঠলে, আমাদের তখন কেমন যেন লাগত।
রফিকের অনেক কথাই আমরা অসময়ে জেনেছি। আমরা জেনেছি, রফিকের মা চিকিৎসার অভাবে ধুকে ধুকে একদিন মরে গিয়েছে। জেনেছি, রফিক সারারাত ল্যাম্পপোস্টের আলোয় বসে এডিসনের সাথে সখ্যতা গড়েছে। শুনেছি, মাধ্যাকর্ষণ শক্তির প্রভাবেই সেসব রাতে রফিকের মাথা ক্লান্তিতে, অবসাদে হাঁটুতে এসে এক হয়ে মিশেছে। তবু পরাজিত হয় নি রফিক। নিউটনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে সে মাথা তুলেছে আকাশে। মন্ত্রের সাধন কিংবা শরীর পাতন – এই প্রতিপাদ্যে রক্ততিলক কপালে এঁকে রফিক মন্ত্রসিদ্ধ হয়েছে। আমরা অসময়ে আরো জেনেছি, রফিক কুলি হয়েছে, হোটেলবয় হয়েছে, অনাহারে অর্ধাহারে থেকেছে। অপমান, অসম্মান আর ঘৃণার ব্যাকরণ পাঠ করে অনেকদিন ধুঁকে ধুঁকে বেঁচে থাকার পরও গোর্কির মতো নিজের বুকে গুলি চালাইনি। বরং পরাজিত হবার সকল সম্ভাবনা পকেটে নিয়ে অবশেষে বিজয়ীর শেষ হাসি হেসেছে। তবে রফিকের সেই হাসি আমরা দেখিনি।
অসময়ে দরকারী সবকিছু জানার পর রফিককে - যাকে এককালে আমরা নিজেদের প্রয়োজনে বন্ধু বানিয়েছিলাম - আমাদের এখন ভীষণ অচেনা-প্রিয়জন মনে হয়। মনে হয় কাছের মানুষ।
*
ছেলেমেয়েদেরকে স্বাধীন জীবন উপহার দেয়ার ফলাফল হাতে নিয়ে আমরা এখন যে বৃদ্ধাশ্রমে ভীড় করেছি - সেটা রফিকেরই বানানো। শুনেছি গতবছর সে শোক করার মতো কাউকে না রেখেই স্বর্গে পাড়ি জমিয়েছে; আর আমাদের নামে লিখে দিয়ে গেছে তার সমস্ত সঞ্চয়।
উৎসর্গঃ প্রিয় প্রবাসী পাঠক ও মাহমুদ রহমান কে
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই নভেম্বর, ২০১৪ রাত ১১:০২