somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

"দ্য ব্যাটেল অব লস্ট আইজ"

১৩ ই মার্চ, ২০১৬ দুপুর ১:৪২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



খালিদের ইয়ারমুখ যুদ্ধ
কিস্তিঃ ০৯
৪র্থ দিনের যুদ্ধ - "দ্য ব্যাটেল অব লস্ট আইজ"

ইয়ারমুখ যুদ্ধের ৪র্থ দিন, ১৮ আগস্ট ৬৩৬, দুপুর নাগাদ খালিদকে তার মুসলিম বাহিনীর রাইট উইং নিয়ে বেশ চিন্তিত দেখাল। বাইজান্টাইন জেনারেল জাবালাহর নেতৃত্বে খ্রিস্টান আরব আর আর্মেনিয়ান সৈন্যরা ইতোমধ্যে সুরাবিলের বাহিনীর ফ্রন্টে বেশ কয়েক জায়গায় পেনিট্রেট করে ফেলেছে। আরো ডানে আমরের বাহিনী জেনারেল কানাতিরের বাহিনীর বিরুদ্ধে মাটি কামড়ে যুঝছে। কিন্তু সুরাবিল মনে হয়না আর খুব বেশিক্ষন তার ফ্রন্ট ধরে রাখতে পারবে । আর সুরাবিল একবার পিছু হটতে শুরু করলে আমরের পক্ষে এককভাবে তার ফ্রন্ট ইন্টেক্ট রাখাটা অসম্ভব, তাই সেও পিছিয়ে আসতে বাধ্য হবে। তাই তার ক্যভুলরি রিজার্ভ এখনই লঞ্চ করতে না পারলে দেরী হয়ে যাবে, আর পরাজয় ঠেকানো অসম্ভব হয়ে পরবে।

খালিদের ক্যভুলরি রিজার্ভ যখন আক্রমনের প্রস্তুতি নিচ্ছিল তখনই হঠাত খালিদকে বেশ বিচলিত ভাবে কিছু একটা খুঁজতে দেখা গেল। তার সহযোদ্ধারা যখন জানতে চাইল তিনি কি খুজছেন, তখন খালিদ জানালেন যে তিনি তার লাল রঙের টুপিটা খুঁজে পাচ্ছেন না। অবশেষে একজন সহযোদ্ধা তার সেই লাল টুপিটা খুঁজে এনে দিল আর খালিদের মুখে প্রশান্তি আর আত্মবিশ্বাস ফিরে এল।

তখন সহযোদ্ধারা সেই লাল টুপির মাহাত্ম্য জানতে চাইলে খালিদ জানালেন যে একবার হজ্বের সময় যখন মহানবী (সাঃ) তার মাথা কামিয়েছিলেন তখন তিনি মহানবী (সাঃ) এর কিছু চুল সংগ্রহ করছিলেন। ব্যাপারটা দেখতে পেয়ে মহানবী (সাঃ) খালিদকে তার চুল কুড়ানোর কারন জানতে চাইলেন। জবাবে খালিদ বলেছিলেন যে সে এই চুল স্মৃতি হিসেবে তার সংগ্রহে রাখতে চান। জবাব শুনে মহানবী(সাঃ) নাকি বলেছিলেন যে এই চুল যতদিন তার সাথে থাকবে আল্লাহর ইচ্ছায় ততদিন খালিদ যুদ্ধে হারবেন না। এরপর খালিদ তার ঐ লাল টুপিতে সেই চুল সেলাই করে নিয়েছিলেন আর ঐ টুপি ছাড়া যুদ্ধক্ষেত্রে পা ফেলতেন না।

যাহোক ইয়ারমুখ যুদ্ধের প্রথম দিন থেকেই ভাহান মুসলিম বাহিনীর রাইট উইং দিয়ে বারবার আক্রমন করে সাফল্য পাবার চেস্টা করছে, ফলে উপর্যুপরি বাইজান্টাইন আক্রমন সামলাতে সামলাতে ইতোমধ্যে আমরের বাহিনীর অবস্থা বেশ শোচনীয়। সেনাপতি হিসেবে আমরের সুনাম মুসলিম সেনাবাহিনীতে খালিদের পরেই, আর বাইজান্টাইন কোন সেনাপতিই সেনাপতিত্বে তার ধারে কাছেও নেই। কিন্তু গত তিনদিনের যুদ্ধে তার সৈন্যরা শুধু পরিশ্রান্তই না বরং সংখ্যায়ও তারা প্রথম দিনের চেয়ে আজ অনেক কমে গেছে।

ব্যাপারটা খালিদের মতই ভাহানও বেশ ভাল করেই জানেন। গত তিনদিনের ব্যর্থতার কারনে ইতোমধ্যে বাইজান্টাইনদের ভেতর হতাশা দানা বাধতে শুরু করেছে। ইতোমধ্যে কিছু সৈন্য ক্যাম্প ছেড়ে পালিয়ে গেছে বলেও রিপোর্ট আসছে। তাই আজকেই যুদ্ধেই মুসলিম সেনাবাহিনীর ওপর চূড়ান্ত আঘাত হেনে জয় নিশ্চিত করে ফেলাটা ভাহানের জন্য খুব জরুরী।
জেনারেল আমর বিন আসের অধীন মুসলিম রাইট উইং গত তিনদিনের যুদ্ধে সবচেয়ে বেশি ডিপ্লিটেড, তাই ভাহান আজও চূড়ান্ত হামলাটা মুসলিম রাইট উইং দিয়েই শুরুর প্ল্যান করলেন। মুসলিম রাইট উইং আক্রান্ত হলে মুসলিম সৈন্যদের উদ্ধার করতে খালিদ তার ক্যভুলরি রিজার্ভ লঞ্চ করতে বাধ্য হবেন। আর খালিদ যখনি তার ক্যভুলরি রিজার্ভ নিয়ে মুসলিম রাইট উইং সামলাতে ব্যস্ত থাকবেন তখনি ভাহান তার জেনারেল কুরিন আর গ্রেগরির বাহিনী নিয়ে মুসলিম লেফট সেন্টার আর লেফট উইং এ আবু উবায়দা আর ইয়াজিদের বাহিনীকে আক্রমন করবেন; এবং খালিদ তার রাইট উইং সামলে মুসলিম লেফট উইং উদ্ধারে ফিরে আসার আগেই যুদ্ধ শেষ করে ফেলবেন। এমন একটা ব্রড ফ্রন্ট এটাক সামলানোর সাধ্য আসলে এই মুহুর্তে মুসলিম বাহিনীর নেই।

দিনের শুরুতেই কানাতির তার স্লাভ সৈন্য বাহিনী নিয়ে আমরের বাহিনীকে আর আর্মেনিয়ান ও খ্রীস্টান আরবদের নিয়ে প্রিন্স জাবালাহ সুরাবিলের বাহিনীকে আক্রমন করলেন। গত তিনদিনে আমরের বাহিনী বাইজান্টাইনদের আক্রমনে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। স্লাভদের আক্রমনের তোড়ে আমরের বাহিনী কিছুটা পিছু হটতে বাধ্য হল ঠিকই কিন্তু এবার তারা প্রচন্ড প্রতিরোধ গড়ে তুলে স্লাভদের অগ্রযাত্রা অনেকখানিই ঠেকিয়ে দিল।

কিন্তু সুরাবিলের ফ্রন্টে মুসলিম সৈন্যরা বাইজান্টাইন অগ্রযাত্রার গতি কমাতে সমর্থ হলেও তাদের ঠেকাতে পারছিল না। ফলে আর্মেনিয়ানরা প্রিন্স জাবালাহর খ্রিস্টান আরবদের সহযোগে একাধিক পয়েন্টে মুসলিম ফ্রন্ট পেনিট্রেট করে ফেলল। সুরাবিলের মুসলিম বাহিনী যে আর খুব বেশিক্ষন বাইজান্টাইনদের ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না সে কথা প্রকাশ্য দিবালকের মত স্পস্ট হয়ে উঠল। তাই ক্যাভুলরি রিজার্ভ নিয়ে খালিদের এগিয়ে আসা ছাড়া আর কোন উপায়ই অবশিষ্ট রইল না। সবকিছুই আজ যেন ভাহানের প্ল্যান মতই ঘটতে চলেছে।

ক্যভুলরি রিজার্ভ নিয়ে সুরাবিলের ফ্রন্ট স্ট্যবিলাইজ করতে এগিয়ে যাবার প্রস্তুতি নেবার সময়ই খালিদের মনে এই আশংকা উকি দিল যে বাইজান্টাইনরা এবার মুসলিম লেফট সহ একটা ব্রড ফ্রন্টে এটাক করে বসতে পারে; এবং খালিদ তার এই ব্যাটেলফিল্ড ইন্সটিঙ্কটটিকে যথাযথ গুরুত্বসহকারেই আমলে নিলেন। গত তিনদিনের যুদ্ধে সৈন্য হারিয়ে মুসলিম ফ্রন্টের ডেপথ এই মুহুর্তে ২য় বা ৩য় দিনের তুলনায় অনেক কম। তাই বাইজান্টাইনরা এখন ব্রড ফ্রন্টে এটাক করে বসলে আজ ঠিক কয় স্থানে মুসলিম ফ্রন্ট ধ্বসে পরবে তা নিশ্চিত বলা মুস্কিল। সেক্ষেত্রে তার একটা মাত্র ক্যভুলরি রিজার্ভ নিয়ে কোন ক্রমেই সব কয়টা বাইজান্টাইন পেনিট্রেশনের বিরুদ্ধে লড়ে জেতা সম্ভব না। যুদ্ধের এমন ক্রিটিক্যাল স্টেজে তিনি অত্যন্ত দুঃসাহসী আর বাইজান্টাইনদের জন্য অপ্রত্যাশিত একটি সিদ্ধান্ত নিলেন; তিনি সুরাবিলের বাহিনীকে উদ্ধারের জন্য নিজের কভ্যুলরি রিজার্ভ লঞ্চ করবার আগে আবু উবায়দা আর ইয়াজিদকে জেনারেল কুরিন আর গ্রেগরির বাহিনীর ওপর অতর্কিতে হামলা চালানোর নির্দেশ দিলেন।

আবু উবাইদা আর ইয়াজিদও ইতোমধ্যে লক্ষ্য করেছিলেন যে তাদের সামনের বাইজান্টাইনরা সকাল থেকেই আক্রমনের জন্য নিশপিশ করছিল। এবার খালিদের নির্দেশ পেয়েই আবু উবাইদা আর ইয়াজিদ তাদের বাহিনী নিয়ে বাইজান্টাইন রাইট সেন্টার আর রাইট উইং এর উপর স্পয়েলিং এটাক লঞ্চ করলেন। আক্রমনের তীব্রতায় কুরিন আর গ্রেগরির বাহিনী খানিকটা পিছু হটতে বাধ্য হল। বাইজান্টাইন ব্রড ফ্রন্ট এটাকের সম্ভাবনা নস্যাত করে দিয়ে এবার খালিদ সুরাবিলের বাহিনীকে উদ্ধারের উদ্দেশ্যে ছুটলেন।

খালিদ তার ক্যভুলরি রিজার্ভ কে সমান দুই ভাগ করে নিয়ে সুরাবিলের বাহিনীর দুই পাশ দিয়ে একযোগে এগিয়ে গেলেন। জাবালাহর খ্রীস্টান আরব আর আর্মেনিয়ানদের দুই ফ্ল্যাঙ্কে মুসলিম ক্যভুলরিকে আক্রমন করতে দেখে সুরাবিলের পদাতিক মুসলিম বাহিনীও বীরদর্পে সামনে থেকে আক্রমন চালাল। জবাবে বাইজান্টাইনরা তুমুল প্রতিরোধযুদ্ধ শুরু করল। কিন্তু তিনদিন থেকে খালিদের এই থ্রি প্রঞ্জড ফ্ল্যাঙ্কিং মেনুভারের কাছে অবশেষে পরাজয় স্বীকার করে নিয়ে খ্রীস্টান আরব আর আর্মেনিয়ানরা দ্রুত পিছু হটল।

একই সময়ে আমরও তার ক্যভুলরি রিজার্ভকে জেনারেল কানাতিরের বাইজান্টাইন স্লাভ বাহিনীর বামে পাঠিয়ে দিয়ে নিজের পদাতিক মুসলিম বাহিনী নিয়ে সামনে থেকে পূর্নোদ্যমে আক্রমন শানালেন। কিন্তু আগের দুই দিনের অভিজ্ঞতায় কানাতির আজ আমরের এই চালের জন্য আগে থেকেই প্রস্তুত ছিলেন। তাই আমরের ক্যভুলরি চার্জ নস্যত করতে তিনি নিজের বাইজান্টাইন ক্যভুলরি রিজার্ভটাকে স্লাভদের বাম দিয়ে সামনে পাঠিয়ে আমরের ক্যভুলরি রিজার্ভকে এনগেজ করবার নির্দেশ দিলেন। রোমান কমপ্লেক্স মিক্সড ফর্মেশনে কানাতিরের এই কাউন্টার কাউন্টার এটাক সাফল্যের মুখ দেখতে পারার আগেই সুরাবিলের বাহিনীর সামনের খ্রীস্টান আরব আর আর্মেনিয়ানরা খালিদের আক্রমনে পিছু হটতে শুরু করল। ফলে কানাতিরের স্লাভ বাহিনীর ডান ফ্ল্যাঙ্ক সম্পুর্ন উন্মুক্ত হয়ে পড়ল। তাই তার এই উন্মুক্ত ডান ফ্ল্যাঙ্কে খালিদ সহজেই তার ক্যভুলরি নিয়ে আক্রমন করে বসতে পারে বুঝে কানাতির অনিচ্ছাসত্বেও তার স্লাভ বাহিনীকে দ্রুত পিছু হটার নির্দেশ দিলেন।

এরি মধ্যে সূর্য পশ্চিম দিকে ঢলে পরতে শুরু করেছে। আচমকা কানাতিরের স্লাভ বাহিনী দ্রুত পিছু হটাতে শুরু করায় তার পরিকল্পিত রোমান কমপ্লেক্স মিক্সড ফর্মেশন এলোমেলো হয়ে গেল। ফলে তার বাইজান্টাইন ক্যভুলরি রিজার্ভ হঠাতই স্লাভ পদাতিক বাহিনীর মিউচুয়াল সাপোর্ট হারিয়ে ফেলল। কনফিউজড বাইজান্টাইন ক্যভুলরিকে হাতের কাছে পেয়ে জাররার তার মুসলিম ক্যভুলরি ইউনিট নিয়ে অতর্কিতে তাদের উপর আক্রমন করে বসলেন। আক্রান্ত হয়ে বাইজান্টাইন ক্যভুলরি দ্রুত পিছু হটার চেস্টা করল। কিন্তু নাছোড়বান্দা জাররার তাদের পিছু ধাওয়া করতে লাগলেন।

বাইজান্টাইন ক্যভুলরি পিছু হটার ভান করে শত্রুকে টেনে এনে ফাঁদে ফেলে আক্রমনের রণকৌশল বেশ ভাল করেই রপ্ত করেছিল। কিন্তু কানাতিরের পিছু হটার হঠাত সিদ্ধান্ত আর মুসলিম ক্যভুলরিকে ফাঁদে ফেলার কোন পূর্ব পরিকল্পনা না থাকায় বাইজান্টাই ক্যভুলরি কোন সিদ্ধান্ত নিতে না পেরে উর্ধ্বশ্বাসে ওয়াদি উর রাকাদের ব্রিজ বরাবর পালাতে চেস্টা করল। কিন্তু জাররার জোকের মত তাদের পিছু লেগে থাকলেন এবং পথেই কানাতিরের এই ক্যভুলরি রিজার্ভকে পরাস্ত করে ফেলেন।

কানাতিরের কভ্যুলরি রিজার্ভকে হারাতে গিয়ে ইতোমধ্যে জাররার তার বাহিনী নিয়ে ওয়াদি উর রাকাদের ব্রিজের বেশ কাছাকাছি পৌছে গিয়েছিলেন। এবার তিনি সুযোগ বুঝে ব্রিজের পাহারায় থাকা বাইজান্টাইন গার্ডদের আক্রমন করে বসলেন। বাইজান্টাইন মূল বাহিনী তখন ফ্রন্ট সামলাতে ব্যস্ত, তাই কেউই ব্রিজ পাহারায় থাকা বাইজান্টাইন গার্ডদের সাহায্য করতে এগিয়ে এল না।

অতএব তেমন কোন বড় প্রতিরোধ ছাড়াই জাররার বাইজান্টাইনদের পিছু হটার একমাত্র পথ এই ওয়াদি উর রাকাদের ব্রিজটি দখল করে নিলেন। তারপর ব্রিজটি সিকিউর করতে কিছু মুসলিম সৈন্য পাহারায় বসিয়ে তিনি ফের যুদ্ধক্ষেত্রের উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন। বাইজান্টাইন মুল বাহিনী তখনো সদ্য বেদখল হয়ে যাওয়া এই ব্রিজের ব্যাপারে কিছুই জানতে পারেনি। অথচ এই ব্রিজটি হারানোর কারনেই শেষ দিনের যুদ্ধে তাদের খুবই চড়া মাশুল গুনতে হয়েছিল। অবশ্য ভাহান তখন মুসলিম লেফট উইং বরাবর পাওয়া মোক্ষম সুযোগকে কাজে লাগিয়ে চূরান্ত বিজয় হাসিল করে নিতেই বেশি ব্যস্ত।

যাহোক, খালিদকে মুসলিম রাইট ফ্রন্ট স্ট্যাবিলাইজড করবার সুযোগ করে দিতে গিয়ে আবু উবায়দা আর ইয়াজিদ তাদের বাহিনী নিয়ে জেনারেল কুরিন আর গ্রেগরির বাহিনীকে আক্রমন করে শুরুতে বাইজান্টাইনদের কিঞ্চিত হচকে দিতে পেরেছিলেন ঠিকই। কিন্তু কিছুক্ষনের ভেতরই কুরিন আর গ্রেগরির বাহিনী নিজেদের সামলে নিল এবং বুঝে ফেলল যে আবু উবায়দা আর ইয়াজিদ আসলে তাদের ফ্রন্ট পেনিট্রেট করতে চাইছেন না বরং স্রেফ তাদের আটকে রাখতে চাইছেন যেন তারা ব্রড ফ্রন্টে মুসলিমদের এটাক করতে না পারে। তাই ব্রড ফ্রন্টে এটাকে যাবার আগে বাইজান্টাইনরা তাদের মুসলিম প্রতিপক্ষকে আরো ডিপ্লিটেড করে নিতে চাইল।

কুরিন আর গ্রেগরির বাহিনী ফ্রন্ট বরাবর ঢালের দেয়াল তুলে দিয়ে এবার তাদের সব ধরনের তীরন্দাজদের কাজে লাগালেন। ইয়াজিদ আর আবু উবায়দার ক্যভুলরি রিজার্ভ খালিদের ক্যভুলরি রিজার্ভকে সাপোর্ট দিতে চলে যাওয়ায় তারা প্রায় কোন প্রকার ক্যভুলরি সাপোর্ট ছাড়াই গ্রেগরি আর কুরিনের বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়ছিলেন। বাইজান্টাইনরা এই সুযোগে তাদের অশ্বারোহী তীরন্দাজদের মাঠে নামালেন। সামনে থেকে বাইজান্টাইন পদাতিক তীরন্দাজ আর দুপাশ থেকে তাদের অশ্বারোহী তীরন্দাজদের তীর আক্রমনে ইয়ারমুখের আকাশ যেন তীরে ঢেকে গেল প্রায়। ইতিহাসে তীরন্দাজদের দ্বারা এমন সুপরিকল্পিত অভিযানের দৃস্টান্ত এবং যুদ্ধে তীরন্দাজদের এমন ভয়াবহ হয়ে উঠবার উদাহরন সত্যি বিরল।

বাইজান্টাইনদন চেয়ে মুসলিম তীরন্দাজদের তীরের রেঞ্জ যেমন অপেক্ষাকৃত কম ছিল, তেমনি মুসলিম তীরন্দাজদের তীরের রিজার্ভও ধীরে ধীরে কমে আসছিল। তাছাড়া গত তিনদিনের যুদ্ধে ইতোমধ্যে মুসলিম তীরন্দাজদের সংখ্যাও অনেক কমে গিয়েছিল। তাই এবার বাইজান্টাইন অশ্বারোহী তীরন্দাজরা পরিকল্পিতভাবে মুসলিম তীরন্দাজদের আক্রমন করতে শুরু করল। বাইজান্টাইন সম্মিলিত তীরন্দাজদের তীরের এই আক্রমন এতটাই প্রবল ছিল যে কথিত আছে যে প্রতি ৭০০ জন মুসলিম যোদ্ধার একজন তীরের আঘাতে এই যুদ্ধে চোখ হারিয়েছিলেন। আবু সুফিয়ানও এদিন তার একটি চোখ হারান। তাই এদিনের যুদ্ধ ইতিহাসে ‘দ্য ব্যাটেল অব লস্ট আইজ’ নামে পরিচিত।

অগত্যা তীরন্দাজ আর ক্যভুলরি সাপোর্ট হারিয়ে তীব্র এই তীরের আক্রমনের মুখে ইয়াজিদ আর আবু উবায়দা তাদের মুসলিম পদাতিক বাহিনী নিয়ে পিছু হটার সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হলেন। মুসলিমদের পিছু হটতে দেখে ভাহান বুঝলেন এই সেই মোক্ষম সময়। খালিদ তখনো মুসলিম রাইট উইং সামলাতে ব্যস্ত। তাই এখন মুসলিম লেফট উইং এর ওপর আক্রমন চালালে এত কম সময়ের ভেতর খালিদের পক্ষে আক্রান্ত রাইট উইং ফেলে রেখে লেফট উইং এ চলে আসা কোনভাবেই সম্ভব না। তাই ভাহান কানাতিরকে প্রাণপণে লড়ে যাবার নির্দেশ দিয়ে এবার নির্দ্বিধায় গ্রেগরি আর কুরিনকে একটা অল আউট এক্সপ্লোয়টেশনে যেতে নির্দেশ দিলেন।

পিছু হটতে থাকা মুসলিম বাহিনীর পিছু ক্ষুধার্ত হায়েনার মত ছুটে এল বাইজান্টাইন সৈন্যরা। কিন্তু মুসলিম বাহিনীর পিছু হটাকে নিরাপদ করতে ইকিরিমাহ বিন আবু জাহল তার ইউনিট নিয়ে রিয়ারগার্ড এর দায়িত্ব নিয়েছিলেন। তাই এবার ইকিরিমাহর রিয়ারগার্ড আপ্রান লড়তে শুরু করল। ইকিরিমাহ তার বাহিনী নিয়ে শুধু সামনে থেকেই বাইজান্টাইনদের ঠেকালেন না বরং তাদের রিয়ারগার্ডকে আউটফ্ল্যাঙ্ক বা বাইপাস করে মূল মুসলিম বাহিনীর কাছে পৌছুবার সব বাইজান্টাইন প্রচেষ্টাও নস্যাৎ করে দিতে লাগলেন। অগত্যা বাইজান্টাইনরা সর্বশক্তি দিয়ে ইকিরিমাহর রিয়ারগার্ডকে তিনদিক থেকে আক্রমন করল। ইকিরিমাহর মুসলিম সেনারা শেষ রক্ত বিন্দু দিয়ে বাইজান্টাইনদের ঠেকিয়ে রাখার চেস্টা করে একে একে মাটিতে লুটিয়ে পড়তে লাগলেন। অবশেষে বাইজান্টাইনরা যখন ইকিরিমাহর রিয়ারগার্ডকে পরাস্ত করতে সক্ষম হল ততক্ষনে ইকিরিমাহ আর তার রিয়ারগার্ডের প্রত্যেকটি সদস্য হয় শাহাদত বরন করেছেন অথবা মৃত্যু পথযাত্রী।

যুদ্ধের এই চরম অবস্থার গুরুত্ব বুঝতে পেরে আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দ আর জাররার এর বোন খাউলাহ সহ অন্যান্য নারী যোদ্ধারা হাতে অস্ত্র তুলে নিয়ে ফ্রন্টের দিকে ধেয়ে এলেন। ইতোমধ্যে পিছু হটতে থাকা মুসলিমরা যখন তাদের পাশে তাদের স্ত্রী সন্তানদেরও লাঠিসোটা হাতে দেখতে পেলেন, মূহুর্তে মুসলিম ফ্রন্টের চেহারা পাল্টে গেল। শুরু হল এমন এক রক্তক্ষয়ী এক সংঘর্ষ যেখানে না আছে কোন জেনারেলশিপ আর না আছে কোন ফর্মেশন অথবা মেনুভারের বালাই। স্রেফ সৈন্যে সৈন্যে রোমহর্ষক দ্বৈরথ চলতে থাকল।

গ্রেগরির ইউরোপিয়ান আর কুরিনের আর্মেনিয়ান সৈন্যরা দীর্ঘদিন যাবত তাদের নিউমেরিক সুপেরিওরিটি দিয়ে শত্রুকে চিরে চ্যাপ্টা করে যুদ্ধ জয়ে অভ্যস্ত। পারতপক্ষে তারা বরাবরই পিচড ব্যাটেল এড়িয়ে গিয়েছে। কিন্তু মুসলিম যোদ্ধারা প্রত্যেকে আজ নাঙ্গা তরবারি হাতে আসুরিক শক্তি নিয়ে উন্মাদের মত ক্লোজ কোয়ার্টারে লড়ে চলেছে। কোন এক অপার্থিব শক্তিতে বলীয়ান এই যোদ্ধাদের ঠেকানোর কোন কৌশলই বাইজান্টাইনদের জানা নেই। এমনকি জাররারের বোন খাউলাহ পর্যন্ত এক বাইজান্টাইকে তরবারি হাতে ধরাশায়ী করে ফেললেন। অবশ্য দ্বন্দযুদ্ধের এক পর্যায়ে সেই বাইজান্টাইন যোদ্ধার তরবারির আঘাতে খাউলাহর মাথা থেকে তখন দরদর করে রক্ত পড়ছে। লড়তে লড়তে খাউলাহ একসময় মাটিতে লুটিয়ে পরেন আর অতিরিক্ত রক্তক্ষরনে তিনি জ্ঞান হারান। পরে জাররার মুমুর্ষ অবস্থায় তাকে যুদ্ধক্ষেত্রে খুজে পেয়েছিলেন।

মুসলিম বাহিনীর এমন অপার্থিব প্রতিরোধযুদ্ধের মুখে দিনের আলো নিভে এল আর জয়ের এতোটা কাছে এসেও বাইজান্টাইনরাও ধীরে ধীরে পিছু হটতে বাধ্য হল। বিমর্ষ ভাহান দেখলেন টানা চারদিন যুদ্ধের পরেও তার বিশাল বাহিনী ক্ষুদ্র এই মুসলিম বাহিনীকে তাদের অবস্থান থেকেই হঠাতে পারেনি। যুদ্ধ শেষে হতাহতের সংখ্যা জেনে তিনি মুষড়ে পড়লেন। কিন্তু সবচেয়ে বড় শক পেলেন যখন শুনলেন ওয়াদি উর রাকাদের ব্রিজ এখন মুসলিম বাহিনীর দখলে। আগামীদিন আরেকবার আক্রমনে যাবার শক্তি আর ইচ্ছে কোনটাই আর বাইজান্টাইনদের অবশিষ্ট নেই, তার উপর ব্রিজটাও হাতছাড়া হওয়ায় পিছু হটার পথও এখন বন্ধ। পঞ্চম দিনের পরিনতির কথা ভাবতে গিয়েই ভাহান শিউরে উঠলেন। কারন পাশার দান পাল্টে গেছে, কাল থেকে যুদ্ধের ইনিশিয়েটিভ খালিদ বিন ওয়ালিদের হাতে!

(ক্রমশ...)
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই মার্চ, ২০১৬ দুপুর ১:৪২
৮টি মন্তব্য ৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমাদের কার কি করা উচিৎ আর কি করা উচিৎ না সেটাই আমারা জানি না।

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১:২৮




আমাদের কার কি করা উচিৎ আর কি করা উচিৎ না সেটাই আমারা জানি না। আমাদের দেশে মানুষ জন্ম নেয়ার সাথেই একটি গাছ লাগানো উচিৎ । আর... ...বাকিটুকু পড়ুন

মানবতার কাজে বিশ্বাসে বড় ধাক্কা মিল্টন সমাদ্দার

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ২:১৭


মানুষ মানুষের জন্যে, যুগে যুগে মানুষ মাজুর হয়েছে, মানুষই পাশে দাঁড়িয়েছে। অনেকে কাজের ব্যস্ততায় এবং নিজের সময়ের সীমাবদ্ধতায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারে না। তখন তারা সাহায্যের হাত বাড়ান আর্থিক ভাবে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। আমের খাট্টা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৫৪



তাতানো গরমে কাল দুপুরে কাচা আমের খাট্টা দেখে ব্যাপারটা স্বর্গীয় মনে হল । আহা কি স্বাদ তার । অন্যান্য জিনিসের মত কাচা আমের দাম বাড়াতে ভুল করেনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ডাক্তার ডেথঃ হ্যারল্ড শিপম্যান

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:০৪



উপরওয়ালার পরে আমরা আমাদের জীবনের ডাক্তারদের উপর ভরশা করি । যারা অবিশ্বাসী তারা তো এক নম্বরেই ডাক্তারের ভরশা করে । এটা ছাড়া অবশ্য আমাদের আর কোন উপায়ই থাকে না... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার ইতং বিতং কিচ্ছার একটা দিন!!!

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:০৩



এলার্ম এর যন্ত্রণায় প্রতিদিন সকালে ঘুম ভাঙ্গে আমার। পুরাপুরি সজাগ হওয়ার আগেই আমার প্রথম কাজ হয় মোবাইলের এলার্ম বন্ধ করা, আর স্ক্রীণে এক ঝলক ব্লগের চেহারা দেখা। পরে কিছু মনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×