somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বিপন্ন নিবাস

১৩ ই ডিসেম্বর, ২০১০ ভোর ৪:৫২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

"শৈবাল দীঘিরে বলে উচ্চ করি শির
লিখে রেখো একফোটা দিলেম শিশির।"

সেই স্কুল জীবনের ভাবসম্প্রসারনটি আজও বার বার মনে পড়ে। কেননা আমরা বোধহয় ঐ শৈবালের মতই। জীবনে কারও কাছ থেকে কি পেলাম সেটা আমাদের বিবেচনায়ই আসে না। অথচ দেবার পরিমানটা সামান্য হলেও ভাবি অনেক বড় করে। ষময়ের ব্যবধানে কবিতার ঐ দুটি লাইন আমার জীবনে আজ প্রচন্ড অর্থবহ।

বাবার আদর থেকে বঞ্চিত ছিলাম সেই শৈশব হতেই। বড় ভাই সৌদি প্রবাসী ১৯৯১ সালের ডিসেম্বর হতেই। তখন আমি দশম শ্রেনীতে পড়ি। দুই বোন, দুই ভাই আর মা মিলে আমাদের ছো্ট্ট সংসার। বড় ভাই বাইরে থাকেন বলে তখন থেকেই সংসারের দেখাশুনা আমাকেই করতে হতো। পুরো পরিবারটাকে আমি আগলে রাখার চেষ্টা করতাম। সংসারের খরচের চাপ কমাতে তখন থেকেই বেশ টিউশনি করতাম। নিজের হাতে সংসারের পুরো টাকা থাকা সত্বেও টিউশনির টাকা দিয়েই নিজের পকেট খরচ ও অন্যান্য খরচ চালিয়ে নিতাম। মোট কথা সংসারের গার্ডিয়ান হিসেবে নিজেকে সংযত রাখতে পেরেছি সবসময়। বড় ভাই কে নিজের হৃদয়ে বসিয়েছি ভালবাসা ও শ্রদ্ধার দেবতা হিসেবে। বাবার অবর্তমানে সংসারের পেছনে তার অবদান ছিল অসামান্য। সবসময় স্বপ্ন দেখতাম প্রতিষ্ঠিত হয়ে কত দ্রুত তার পাশে দাঁড়াবো। সময় এগিয়ে চললো। কলেজে পড়া অবস্থায় একজনের সাথে শেয়ারে ব্যবসায় নামলাম। পরবর্তীতে তার প্রতারক মনোভাবের কারনে নিজেকে গুটিয়ে নিলাম। একবছরে কিছু অর্থ উপার্জন করলাম এবং সেই সাথে ব্যবসায় খাটানো পুঁজি এক লাখ টাকা ফেরত নিয়ে নিলাম এবং ভাইকে দিয়ে দিলাম। কম্পিউটার ডিপ্লোমা শেষ করেছিলাম ১৯৯৮ সালে। এরপর গ্রাফিক্স ডিজাইন কোর্সটাও করে নিলাম। অবশেষে ডিগ্রী পাশের পর গার্মেন্টস এক্সেসরিজ সাপ্লাইয়ার হিসেবে কাজ শুরু করলাম। ভালই চলছিল সবকিছু। এরি মধ্যে প্রবাস জীবনে বড় ভাইয়ের কেটে গেছে দশটি বছর। এর মধ্যে ছুটিতে দেশে এসেছেন বেশ কয়েকবার। তিনি যখনই দেশে আসতেন, তখনই আমার কাছে বর্ননা করতেন তার মানসিক অবস্থার কথা। বিদেশ করতে আর ভাল লাগেনা, মরুভূমি তার জীবনটা চুষে নিয়ে যাচ্ছে, তার এই অবস্থা সংসারের বাকীরা বুঝতেই চায়না -- এসব নানা কথা সে বলতো আমাকে। কর্তব্য ও ভালবাসার খাতিরে এবং বিবেকের দংশনে ভাইকে আর বিদেশে থাকতে দিতে মন চাইল না। এদিকে পরিবারের খরচ একা চালানোর মত আমার অবস্থানও শক্ত নয়। তাই ভাইয়ের সাথে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিলাম আমি সৌদি আরব আসবো আর তাকে দেশে পাঠিয়ে দেবো। তাকে বসে খাওয়াবো।

জীবনের সে সিদ্ধান্তই আমার কাল হল। ভালবাসার আড়ালে লুকিয়ে থাকা বড় ভাইয়ের বিশ্বাসঘাতকতা আমি বিন্দুমাত্র টের পাইনি। অবশেষে ২০০১ সালের সেপ্টেম্বরের আনলাকি ১৩ তে আমি পা রাখলাম এই মরুভূমির দেশে। ভাইয়ে কথা ছিল কাজ ঠিক করেই আমাকে বিদেশে আনছেন। এসে দেখলাম পুরো উল্টো। নিজেই বিভিন্ন অফিসে ঘুরে ঘুরে কম্পিউটার ডিজাইনার হিসেবে কাজ যোগাড় করলাম। এ ব্যাপারে ভাইয়ের কোন রকম সাহায্য পেলাম না। সৌদি আরব এবং মিডলইস্ট এর অন্যান্য দেশে কন্ট্রাক্ট এবং ট্রান্সফার ছাড়া কাজ করা যায় না। প্রায় সব কোম্পানিই নির্দিষ্ট কন্ট্রাক্ট পিরিয়ডে লোক নিয়োগ করে। ঐ সময়ের মধ্যে কোন শ্রমিক নিয়োগকৃত কোম্পানি ছেড়ে অন্য কোন কোম্পানীতে অনেক ভাল জব পেলেও যেতে পারে না। এখানে লেবার প্রফেশনটা একটা বড় বিষয়। কিছু কিছু প্রফেশন ট্রান্সফারেবল নয়। তার মধ্যে একটি ভিসা প্রফেশন হল মাজরা (কৃষি)। বড় ভাই আমাকে ঐ মাজরা ভিসাতেই এনেছিলেন। ব্যাপারটা তখন আমার জানা ছিল না। অফিসে তিনমাস প্রবেশনারী পিরিয়ড শেষে যখন ট্রান্সফারের প্রশ্ন এলো, তখনই সবচেয়ে বড় ধাক্কাটা খেলাম। মাজরা ভিসার কারনে আমার ট্রান্সফার হলনা এবং চাকরী চলে গেল। মনের দিক দিয়ে পুরোপুরি ভেঙ্গে পড়লাম। কারন যেখানেই চাকরী পাচ্ছি, সমস্যা ঐ একটাই। আগে ভিসা প্রফেশন চেইঞ্জ করতে হবে। অবশেষে এখানে আর এক ভাল কোম্পানীতে ক্যাশিয়ার হিসেবে চাকরী হল। তখন ভাইকে বললাম ভিসা প্রফেশন চেইঞ্জ করে দিতে। কিন্তু জানিনা কোন কারনে তিনি সেটা করতে অপারগতা প্রকাশ করলেন। তার বিয়ের পর থেকেই কি তার এই ষড়যন্ত্রমূলক আচরন শুরু হয়েছে নাকি মনে মনে অনেক আগে থেকেই প্ল্যান করেছিলেন বুঝতে পারিনি। তিনি আরও কিছু এমন আচরন আমার সাথে করলেন যা বলতে গেলে লেখা অনেক দীর্ঘায়িত হয়ে যাবে। ভাইয়ের প্রতি আমার বিশ্বাস ভালবাসা পুরোটাই নষ্ট হয়ে গেল তার ব্যাখ্যাহীন কাজের কারনে। এহেন আচরনের কারনে আমি তার সঙ্গ ছাড়তে বাধ্য হলাম। তিনিও হয়তো এটাই চাচ্ছিলেন। তাই একবারের জন্যেও আর কাছে ডাকলেন না। সারা জীবনের বিশ্বাস একবার ভেঙ্গে গেলে তা বোধহয় আর জোড়া লাগে না। আমি সম্পূর্ন নিস্বঃ অবস্থায় পথে নামলাম। দীর্ঘ চারমাস অমানূষিক যন্ত্রনা বুকে নিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করেছি। দিন কেটেছে অনাহারে, অর্ধাহারে। দেশে ফিরে আসবো তাতেও বিপত্তি দেখা দিল। যেহেতু আমি জানতাম না আমার স্পন্সার কে বা কোথায় (এ ব্যাপারে ভাই আমাকে কিছুই জানতে দেননি), তাই একমাত্র পথ ছিল পুলিশের কাছে ধরা দিয়ে দেশে আসতে হবে। কত দিন জেলে থাকতে হবে তাও জানি না।

এই ছিল আমার দুঃখের ইতিহাসের সার সংক্ষেপ। যেহেতু বড় ভাইয়ের পরিচালনায় আমাদের সংসার, তাই মা-বোনেরা সবাই বড় ভাইয়ের সাথ দিয়ে আমাকে পরিত্যাগ করল। আপন নিবাসেও আমার অবস্থান বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। এ প্রবাসও আজ আমার কাছে বিপন্ন নিবাস। আজও আমি নিভৃতে আমার মায়ের জন্য চোখের জল ফেলি। জানিনা আমার মা সেটা অনুভব করেন কিনা। বোনদের জন্য আমার হৃদয় কাঁদে। বিশেষ করে ছোট বোন কে ( যে আমার বোন ও সবচেয়ে কাছের বন্ধুও ছিল) মনে পড়ে খুব বেশি। হয়তো আমার কথা তাদের মনেও পড়েনা একবারও। আপনদের স্নেহ-ভালবাসা বঞ্চিত হতে কে চায়? আমার মত দুর্ভাগ্য যেন আর কারও না হয়। আপন মানুষের চক্রান্তে পড়ে আর কারও জীবন যেন এভাবে ধ্বংস না হয়ে যায়।
(একটি সত্য ঘটনা)

সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০১০ ভোর ৪:৫২
৬টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বন্ডাইর মত হত্যাকাণ্ড বন্ধে নেতানিয়াহুদের থামানো জরুরি...

লিখেছেন নতুন নকিব, ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১১:২৫

বন্ডাইর মত হত্যাকাণ্ড বন্ধে নেতানিয়াহুদের থামানো জরুরি...

বন্ডাই সৈকতের হামলাস্থল। ছবি: রয়টার্স

অস্ট্রেলিয়ার সিডনির বন্ডাই সৈকত এলাকায় ইহুদিদের একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠানে সমবেত মানুষের ওপর দুই অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী অতর্কিতে গুলি চালিয়েছে। এতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আল্লাহ সর্বত্র বিরাজমাণ নন বলা কুফুরী

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:১৪



সূরাঃ ২ বাকারা, ২৫৫ নং আয়াতের অনুবাদ-
২৫৫। আল্লাহ, তিনি ব্যতীত কোন ইলাহ নেই।তিনি চিরঞ্জীব চির বিদ্যমাণ।তাঁকে তন্দ্রা অথবা নিদ্রা স্পর্শ করে না।আকাশ ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে সমস্তই... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিজয়ের আগে রাজাকারের গুলিতে নিহত আফজাল

লিখেছেন প্রামানিক, ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৫:১৩


ঘটনা স্থল গাইবান্ধা জেলার ফুলছড়ি থানার উড়িয়া ইউনিয়নের গুণভরি ওয়াপদা বাঁধ।

১৯৭১সালের ১৬ই ডিসেম্বরের কয়েক দিন আগের ঘটনা। আফজাল নামের ভদ্রলোক এসেছিলেন শ্বশুর বাড়ি বেড়াতে। আমাদের পাশের গ্রামেই তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

৫৫ বছর আগে কি ঘটেছে, উহা কি ইডিয়টদের মনে থাকে?

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৫:৫৮




ব্লগের অনেক প্রশ্নফাঁস ( Gen-F ) ১ দিন আগে পড়া নিউটনের ২য় সুত্রের প্রমাণ মনে করতে পারে না বলেই ফাঁসকরা প্রশ্নপত্র কিনে, বইয়ের পাতা কেটে পরীক্ষার হলে নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

১৯৭১ সালে পাক ভারত যুদ্ধে ভারত বিজয়ী!

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯


দীর্ঘ ২৫ বছরের নানা লাঞ্ছনা গঞ্জনা বঞ্চনা সহ্য করে যখন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বীর বাঙালী অস্ত্র হাতে তুলে নিয়ে বীরবিক্রমে যুদ্ধ করে দেশ প্রায় স্বাধীন করে ফেলবে এমন সময় বাংলাদেশী ভারতীয়... ...বাকিটুকু পড়ুন

×