জন্ম ও শৈশব :
ইসলামী জগতের প্রাতঃস্মরনীয় আধ্যাত্নিক ব্যক্তিত্ব,দরবেশকুল শিরোমনি,মাহবুবে সোবহানী,কুতুবে রাব্বানী বড়পীর হযরত আব্দুল কাদির জিলানী র: ১লা রমজানুল মোবারক হিজরী ৪৭০ বা ৪৭১ সালে পারস্যের এক বিখ্যাত জনপদ ‘জিলানে’ এ জনপদে জন্মগ্রহন করেন।তার বংশতালিকায় পিতা সায়েদ শেখ আবু সালেহ র: এর একাদশতম উর্ধ্বতন পুরুষ হযরত হাসান র: এবং তার মাতা সাইয়েদেনা ফাতেমা র: এর চৌদ্দতম উর্ধ্বতন পুর্বপুরুষ ছিলেন হযরত ইমাম হোসেইন র:।এভাবেই তিনি পিতৃ সুত্রে হাসানী ও মাতৃ সুত্রে হোসাইনী বংশধারার উত্তরসুরী। আব্দুল কাদির জিলানী র: এর পিতা সাইয়্যেদ আবু সালেহ মুসা র: একজন বিশেষ পুন্যবান,কামেল ও বোযর্গ ব্যক্তি ছিলেন।সচ্চরিত্রতা ও আল্লাহ প্রেমের বিবিধ গুন তাহার মধ্যে বিরাজমান ছিল।যৌবন কালে যখন তিনি বিয়ে করেননি তখনকার একটি ঘটনা ! তিনি একদিন নদীর ধারে ক্লান্ত অবস্হায় বসে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। হঠাৎ তিনি দেখলেন একটি আপেন পানিতে ভেষে যাচ্ছে।তিনি ফলটি উঠিয়ে আনলেন ও পরম তৃপ্তিসহকারে ভক্ষন করলেন।কিছুক্ষন পর হঠাৎ তর মনে হল এই ফলটি খাওয়া তাহার ঠিক হলো ? এই ফলের মালিকতো তিনি নন।কোথা হতে এ ফল ভেসে এসেছে কে জানে।তার অনুমতিতো নেয়া হয়নি।তাহলে তিনি কি পরদ্রব্য ভক্ষনজনিত অপরাধ নিয়ে মহা বিচারকের সামনে হাজির হবেন ? যে করেই হোক মালিকের ঠিকানা বের করে মাফ চেয়ে নিতে হবে।তাই তিনি স্রোতের বিপরীত দিকে বিষন্নচিত্তে আপেল ফলের বাগানের সন্ধান করিতে লাগিলেন এবং বাগানের ও বাগানের মালিকের সন্ধান পেলেন।বাগানের মালিক সাইয়্যেদ আব্দুল্লাহ সাউয়েমী র:। তিনিও একজন খোদাভীরু ধর্মপ্রান সাধক।আল্লাহপাকের মারেফতের সাগরে সর্বতাই তিনি নিমজ্জিত থাকেন।তার কাছে সমস্ত ঘটনা খুলে বলে তার কাছে ক্ষমা চাইলেন যুবক আবু সালেহ।বিস্মিত হলেন বাগানের মালিক।এই যুবকের অন্তরে কি আল্লাহভীতি।একেতো হাত ছাড়া করা যায় না।তিনি বললেন, ‘আপেলেরতো অনেক মুল্য।কি এনেছ তার জন্য ?’ আবু সালেহ জবাব দিলেন,’আমার কাছেতো কোন টাকাপয়সা নেই’ তবে গায়ে খেটে মুল্য পরিশোধ করতে চাই।আপনি যতদিন খুশী গায়ে খাটিয়ে নিতে পারেন।’হজরত সাউয়েমী র: বললেন ওয়াদা করবার আগে ভাল করে ভেবে দেখ। আবু সালেহ বললেন আমি ওয়াদা পুর্ন করবো ইনশাআল্লাহ। সাউয়েমী র: বললেন তোমাকে পুরো এক বৎসর বাগানের দেখাশোনার কাজ করতে হবে উপরন্তু আমি যখন যে কাজের হুকুম দিব তাই করতে হবে। কোন কথা ছাড়াই সব শর্ত মেনে নিলেন আবু সালেহ।সময় শেষ হবার পর নুতন শর্ত যুক্ত করলেন সাউয়েমী র:।তিনি বললেন ‘আমার একটি অন্ধ,বধির ও বোবা কন্যা আছে তাকে তোমার বিয়ে করতে হবে’। তাতেও রাজী হলেন আবু সালেহ।বিয়ের পর বাসর ঘরে ঢুকেই তাজ্জব বনে গেলেন আবু সালেহ।তার নব বধুতো অপরুপা! অন্ধ,বধির বা বোবা কিছুই নন।পরদিন ব্যখ্যা দিলেন সাউয়েমী র:।আমার এই কন্যা কোনদিন ঘরের বাইরে যায়নি,বাইরের কোন লোকের দিকে কখনো চোখ তুলে তাকায়নি এবং তার মুখে কখনও অশ্লীল বাক্য উচ্চারিত হয়নি।তাই তাকে আমি অন্ধ,বধির ও বোবা বলেছিলাম।
আব্দুল কাদির জিলানী র: যখন মাতৃগর্ভে তখন একদিন তার মাতা সাইয়্যেদেনা উম্মুল খায়ের ফাতেমা(র
অনুরুপ আরেক স্বপ্নে দেখিলেন হযরত হযরত ইব্রাহিম আ: এর স্ত্রী বিবি সারা র: মধুর স্বরে বললেন,”হে সৌভাগ্যবতী ফাতেমা !আল্লাহ পাকের মারেফাত তত্ত্বের শ্রেষ্ঠ পথ প্রদর্শক ‘নুরে আজম’ তোমার গর্ভে আছে।সুতরাং তুমি নিবিষ্ট মনে আল্লাহর গুনগানে নিমগ্ন থেক।”
একই ভাবে আবার দেখলেন ফেরাউনের পুন্যবতী স্ত্রী আসিয়া আ: মধুর কন্ঠে বলছেন,”ওগো সৌভাগ্যবতী ও মর্যাদাশীলা ফাতেমা ! আমি তোমাকে এক অনির্বচনীয় শুভসংবাদ প্রদান করছি। তুমি অতিশয় সৌভাগ্যবতী ও মর্যাদাশীলা রমনী।তোমার গর্ভে যে আওলিয়াকুল শ্রেষ্ঠ সন্তানের আবির্ভাব হয়েছে,পৃতিবীর বুকে তার উপাধি হবে ‘রওশন জমির’।সুতরাং তুমি সতর্কতার সহিত সেই শুভক্ষনের জন্য অপেক্ষা করতে থাক।”এরকম আরো বহু স্বপ্ন তিনি তার গর্ভাবস্হায় দেখেন।
হযরত আব্দুল কাদির জিলানী(র
উজ্জল জ্যোতিবিশিষ্ট স্বর্গীয় ফিরেশতা তাহার শিয়রের নিকট এসে অত্যন্ত কোমল স্বরে বলিতেছেন- ”হে আল্লাহর মনোনিত আব্দুল কাদির!উঠ,আর নিদ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে থেক না।সুখ শয্যার কোলে ঢলে পড়বার জন্য এই পৃথিবিতে তোমার আগমন ঘটেনি।তোমার কর্তব্য ও দায়িত্ব সুদুরপ্রসারী! মোহগ্রস্হ,নিদ্রাচ্ছন্ন জনগনকে নিদ্রার মোহ থেকে মুক্ত করিবার জন্যই তোমার আগমন ঘটেছে।
শিক্ষা জীবন :
হযরত আব্দুল কাদির জিলানী(র
ঘটনাক্রমে রাস্তায় ডাকাত পড়লো।এক ডাকাত শিশু আব্দুল কাদিরকে তার কাছে কিছু আছে কিনা জিজ্ঞেস করলো।তিনি অকপটে স্বীকার করলো জামার ভিতর সেলাইকরা ৪০টি স্বর্নমুদ্রার কথা।বালকের সততায় ও সরলতায় ডাকাত মুগ্ধ হয়ে জিজ্ঞেস করলো,এবিপদের মুহুর্তে লোকেরা প্রকাশ্য সম্পদও গোপন ফেলে আর তুমি এ গোপন সম্পদের কথা কেন আমাকে দিলে ? বালক আ্ব্দুল কাদির জবাব দিল,”আমার আম্মা আমাকে সর্বদা সত্য কথা বলার উপদেশ দিয়েছেন।”
আল্লাহওয়ালাদের কথায় এমন প্রভাব থাকে যা পাষান হৃদয়ও একমুহুর্তে গলিত হতে পারে।ডাকাত সর্দার কাদতে শুরু করলো এবং বলল,”এবালকটি তার মায়ের নির্দেশ এত বিপদের মধ্যেও যেভাবে মানল ,আমি কি আমার সৃষ্টিকর্তা প্রভর হুকুম কি এভাবে মানছি ?আমিতো অর্থ-সম্পদের লোভে মহান মহান মালিকের অবাধ্য হয়ে শত শত মানুষের সর্বনাশ করছি”।কাফেলার লুন্ঠিত সম্পদ ফিরিয়ে দিয়ে ডাকাত তার গোটা দলশ তওবা করে ডাকাতি ছেড়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এলো ।বলা হয় এই ব্যক্তিটিই নাকি পরবর্তীতে আল্লাহর এক ওলীতে পরিনত হয়েছিলেন।আল্লাহুআলম।
উচ্চশিক্সার জন্য তিনি ৪৮৮ হিজরীতে যখন প্রথম তিনি বাগদাদ গমন করেন তখন তার বয়স হয়েছিল আঠার বৎসর।বাগদাত এসে তিনি শায়েখ আবু সাইদ ইবনে মোবারক মাখযুমী হাম্বলী,আবুল ওয়াফা আলী ইবনে আকীল এবং আবু মোহাম্ম ইবনে হোসাইন ইবনে মুহাম্মদ র: এর নিকট ইলমে ফিখ,শায়েখ আবু গালিবমুহাম্মদ ইবনে হাসান বাকিল্লানী,শায়েখ আবু সাইদ ইবনে আব্দুল করীম ও শায়েখ আবুল গানায়েম মুহম্মদ ইবনে আলী ইবনে মুহম্মদ র: প্রমুখের নিকট এলমে হাদীস
এবং শায়েখ আবু যাকারিয়া তাবরেয়ী র: নিকট সাহিত্যের উচ্চতর পাঠ লাভ করেন।শায়খ জীলানীর বাহ্যিক ও আধ্যাত্নিক জ্ঞান চর্চার গূরু শায়খ আবু সাঈদ মাখযুমীর মনে তরুন এ শিষ্যের যোগ্যতা ও প্রতিভা সম্পর্কে এতই সুধারনা ও আস্হাশীলতার সৃষ্টি করল যে,নিজ হাতে প্রতিষ্ঠিত মাদরাসা তত্তাবধান ও পরিচালনার দায়িত্ব শায়খ আব্দুল কাদির জিলানী র: এর নিকট অর্পন করে তিনি নিজে অবসর গ্রহন করেন।
শায়খ আব্দুল কাদির জিলানী র: এ মাদ্রাসার উন্নতি ও উৎকর্ষের কাজে আত্ননিয়োগ করেন।হাদীস ,তাফসির,ফিকহ ও অন্যান্য জ্ঙান বিজ্ঞানের শিক্ষাদান নিজেই শুরু করেন।পাশাপাশি ওয়াজ নসিহত ও তাবলিগের কর্মসুচীও চালু করেন ।অল্পদিনের মধ্যেই এ প্রতিষ্ঠানের সুনাম চারিদিকে ছরিয়ে পড়লো এবং দেশ বিদেশের বিদ্যার্থীরা এতএ ছুটে আসতে লাগলো।এ পর্যায়ে মাদরাসার নামকরনও শায়খের সাথেই সম্পৃক্ত হয়ে ‘মাদরাসায়ে কাদেরিয়া” হয়ে গেল।
শায়খ আব্দুল কাদির জিলানী র: এর শিক্ষকতার জীবন ছিল ৫২৫ থেকে ৫৬১ হিজরি পর্যন্ত মোট ৩৬ বছর।যাতে তিনি দিনের প্রথম ভাগে তাফসির ও হাদীস,যোহরের পর পবিত্র কোরাআন,আর অন্যান্য সময় ফিকহ,উসুল ইত্যাদি বিষয়ের পাঠ দান করতেন।আল্লাহ তাআলা তাকে বাহ্যিক জ্ঞান ও বিদ্যায় এতই ব্যুৎপত্তি দান করেছইলেন যে, যখন ফতোয়া দান করতেন তখণ কোন উৎস বা গ্রন্হ দেখার প্রয়োজন হতো না।কাগজ কলম নিয়ে কোনরুপ চিন্তা ভাবনা ছাড়াই উপস্হিত তিনি যা লিখতেন ,সমকালীন জ্ঞানীগুনি ও আলেম সমাজ ইহাকেই দলীল স্বরুপ মনে করতেন । -চলবে ইনশাআল্লাহ ।
– গ্রন্হ সহায়তা- হযরত আব্দুল কাদির জিলানী র: রচিত গ্রন্হ ১।গুনিয়াতুত তালেবীন ২।আল ফাতহুর রাব্বানী
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই জানুয়ারি, ২০১১ রাত ১০:২৯

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




