গতকাল মাইশা কোরআন তেলাওয়াত খতম করেছে। আজ বাদ মাগরিব মসজিদে ইমাম সাহেব দোয়া করেন। অবশ্য তবারক হিসেবে জিলাপির আয়োজন ছিল। আজ প্রথম মাইশার পরিবারের তরফ থেকে কোন কিছু আমার উদরে গেল। খাস নিয়তে মাইশার জন্য দোয়া করলাম। মাইশা আমার দুঃসম্পর্কের ফুফাতো বোন। আমি ওর মামাতো ভাই। ওদের সংসারের ঝামেলায় মাইশা আমাদের গ্রামের মাদ্রাসায় মামা বাড়ি থেকে আলিমে পড়ছে। আমি তখন ইন্টারমিডিয়েট ফেল মেরে স্টার ফুঁকি। পাড়ার মধ্য ছিলাম এক নম্বরের বদের হাড্ডি। আমাদের একটা গ্যাং ছিল। সে গ্যাঙয়ের নাম ছিল- "আইলশা গ্যাং"। অবশ্য গ্রামের ময়- মুরুব্বিরা এই নামটা দিয়েছিল। কারণ- আমরা ছিলাম মন্দির-মসজিদ, মাজারের ভক্ত। একবার ভিতরে ঢুকলে আর বের হতাম না, যতক্ষণ তবারক না দিত ততক্ষণ ঘুমিয়ে থাকতাম। ভাঙ্গা কবরে আমরা কতো রাত সময় কাটিয়েছি তার হিসেব করা দুঃসাধ্য। মোবারক হাজী সাহেবের পুকুরপাড়ে আমাদের হেড অফিস ছিল। সেখানে যে কোন সময় যে কোন একজন থাকতই! আমাদের ব্রাঞ্চ অফিস ছিল- আমাদের স্কুলের ছাদ (বিকাল), মাঠের গভীর নলকূপের ছাদ(সন্ধ্যা- রাত) এবং মিতালী স্টোরের সেই ক্যারাম বোর্ড(দিবা-রাত্রি)। আমরা কেউ-ই বাড়িতে ফিরতে পারতাম না। খাইতে, শুইতে, উঠতে, বসতে শুধু কথা খাইতাম। তাই আমরা রাজার মতো চলি। আর কথা শুনছি- পরে আর কোন কথা কইলে কানেই ঢুকে না।
হঠাৎ সেদিন মাইশার তবারক খাওয়ার পর তাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করলো। আইলশা গ্যাং- এ শুইয়া স্টারে ফুঁ দিলাম। সেই ফুঁতে আমার চিঠি মাইশার কানের ভিতরে ঢুকে গেল। রাত পার করলাম ভাঙ্গা কবরে শুয়ে। সকাল পার করলাম মিতালীতে। দুপুর গড়িয়ে আছর। তার খবর নেই। তাহলে কি স্টারের ফুঁ কাজ করেনি? দেখি- তার মামাকে সাথে নিয়ে হাজী সাহেবের বাসায় গেল। আমরা তখন পুকুরপাড়ে তিন তিন খেলছিলাম। কিছুক্ষন পরে দেখি- ওর মামা মানে আমার পাড়াতো চাচা উজ্জ্বল চাচা আর হাজী সাহেবের ছোট ছেলে বাইক চেপে বেরিয়ে গেলেন। মাইশা আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে। তিনের টিপাটিপি বন্ধ করে দিলাম। ইশারা করতেই আমার আইলশা গ্যাং এর পার্টনার রা সটকে পরার প্রস্তুতি নিতেই মাইশা চেঁচিয়ে উঠলো-
আপনারা একজনও যাবেন না! খাড়ান.।.।.।.।.।.।! (আমি ততোক্ষণে মাইশাকে এক পলক দেখে নিলাম। হেব্বি লাগছে। এই ক' দিন আগেই দেখেছিলাম নাক টিপলে দুধ বেরুবে। সেই মেয়েটা এতো তাড়াতাড়ি এতো বদলে গেলো?)
সুমন ভাইয়া বলুন, কেন ডেকেছেন?
না মানে.।.।।। রতন বলতে বলেছিল তাই বলেছিলাম।
সে চুপ কেন! কি বলবে তাড়াতাড়ি বলতে বলুন- মাগরিবের সময় হয়ে আসছে-
মাইশা, তুমি তো অনেক বড় হয়ে গেছ! তোমার তবারক গতকাল খেলাম। তাই ভাবলাম ধন্যবাদ জানাই। তুমি যেন কোন ক্লাসে পড়ছ এবার?
ও তাই? তাহলে প্রতি রাতে যাদের পুকুর থেকে মাছ চুরি করে পোলা পাকান, সিমাদের মুরগী চুরি করে বিরিয়ানি রান্না করেন তাদের ধন্যবাদ জানান তো!
এই তোমাকে এসব বাজে কথা কে বলেছে!
কেউ বলেনি। গ্রামের সবাই জানে। ছিঃ রতন ভাই ছিঃ কি লাভ হয় এসব করে? আমি আপনাদের প্রত্যেকের খবর জানি। রতন ভাই আপনি কি জা্নেন, আমি আপনার মায়ের কাছে কোরআন শিখেছি! আপনার মা আপনার জন্য কতো কাঁদেন তা কি আপনি জানেন? জানবেনই-বা কি করে- শুধু খাওয়ার সময় হলেই তো চারটে খেয়ে উধাও। আর এই যে ইলিয়াস ভাই, আপনি আবার এদের দলে নতুন করে নাম লেখালেন নাকি?
না মানে আমি ঐ.।
হইছে থাক থাক আর বলতে হবে না।
শুনুন রতন ভাই, এসব ছেড়ে দিয়ে আবার সবাই মিলে লেখাপড়া শুরু করুন। লেখাপড়া না করলে জমিতে কাজ করুন। তাও না পারলে ঢাকায় যান, বিদেশে যান। বাপ- মায়ের মুখ আর ডুবায়েন না। আপনারা সবাই ভালো ছিলেন একথা গ্রামের বেবাকে জানে। কিন্তু, এখন আপনারা গ্রামের অভিশাপ হয়ে দাঁড়াচ্ছেন। স্বীকার করতেছি- আপনাদের কারণে এই গ্রামে কেউ কোন মেয়েকে খারাপ কথা কইবার পারে না। তারপরেও আপনারা একটা বার ভাইবা দেখেন। ভাই আপনারা কেউ আমারে ভুল বুইঝেন না। আমি আস্তাছি। আজান পড়বো এখন।
পরের দিন গ্রামে হৈ চৈ পরে গেলো। আইলশা গ্যাং এর কাউকে সারা গ্রামে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। বাইরের গ্রামের তের টি বিচার এসেছে আইলশা গ্যাং দের কাছে। গ্রামের লোকজন তখন বুঝল রতন, ইলিয়াস, আনিস, রুঞ্জু, আতোয়ার, হারুন, হক, সুমনদের অভাব। একটানা পাঁচ মাস তারা য়ার কেউ গ্রামে ফিরেনি।
আজ সবাই প্রতিষ্ঠিত। রতন একটি কীটনাশক কোম্পানির ম্যানেজার। ইলিয়াস প্রাণের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, আনিস ব্যবসায়ী, আতোয়ার ও হক প্রবাসী, হারুন ইপিজেতে একটি কারখানার ডাইরেক্টর, সুমন একটি চ্যানেলের রিপোর্টার। সবাই সবার সাথে যোগাযোগ রেখেছে। আজ তারা গ্রামের ইজ্জত, মেহমান। গ্রামের সকল উন্নয়নমূলক কাজে অবদান রাখছে সেই আইলশা গ্যাং।
হঠাৎ বাংলাদেশে নোংরা রাজনীতির বহিঃপ্রকাশ ঘটে। পেট্রোলবোমায় নিহত হয় আইকন মাইশা। যার কথায় কয়েকটি বিপথগামী যুবক ফিরে এসেছিল আলোর পথে। মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়ে ওরা সবাই। চ্যানেলের শিরোনাম এডিট করতে গিয়ে সুমন অবাক। গর্জে উঠে আইলশা গ্যাং। আজো তারা পেট্রোলবোমার বিরুদ্ধে কাজ করে যাচ্ছে।
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই জানুয়ারি, ২০১৬ সন্ধ্যা ৭:৪৮