-(গল্প)-
কাঁচাপাকা চুলের পঞ্চাশোর্ধ্ব বিমল চন্দ্রের ত্রিশ বছরের চাকুরি জীবনে বিচিত্র সব অভিজ্ঞতা হয়েছে। সামান্য 'হ্রস্বই কার' 'দীর্ঘই কার' যে কারও জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে তা বিমল চন্দ্র স্বচক্ষে দেখেছেন। একটা ভুল বানানের জন্য চাকরি হারিয়েছিল তার সহকর্মী। নিজের বেলায় এমনটা আশঙ্কা করলেও কখনই ভীত ছিলেন না। শেষতক আশঙ্কাই সত্য হয়েছিল। 'করুণ' শব্দটা ভুলবশতঃ 'করুন' হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু কর্তৃপক্ষের করুণা হয়নি তাতে। চাকরি হারিয়েছিলেন বিমল চন্দ্র। মধ্যবয়সে এসে হুট করে বেকারত্ব আর মাঝ নদীতে নৌকা ফুটো হয়ে যাওয়া সমান কথা। কিন্তু বিমল চন্দ্রের জীবনে মোড় ঘোরেনি। নির্বিকার চিত্তে নতুন চাকরি খোঁজা শুরু করেছিলেন। অবশেষে একদিন চাকরির দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেও গেলেন।
বিমল চন্দ্রের সামনে বসে থাকা অতিশয় ব্যস্ত ভদ্রলোক একজন সম্পাদক। বয়স চল্লিশ ছুঁই ছুঁই। বিমল চন্দ্র তাকে টিভিতে অনেক দেখেছেন। সামনাসামনি বসে থাকতে তাই কিছুটা আড়ষ্ট বোধ করছেন। অভিজ্ঞতার জোরে যতোটুকু জানেন, সম্পাদকদের কথাবার্তায় কোনও নয়-ছয় নেই, হয় নয় না হয় ছয়। এই সম্পাদকের কথাবার্তা শুনেও তাই মনে হচ্ছে। কিন্তু বেতন সংক্রান্ত কোনও আলোচনার ধারে কাছেও যাচ্ছেন না তিনি। অবশ্য বিমল চন্দ্রের ও নিয়ে চিন্তা-দুশ্চিন্তা কোনটিই নেই। নীরবে একবার নিজেকে সেঁধিয়ে দিতে পারলেই নিশ্চিন্ত। মাস শেষে অল্প কিছু পেলেই হিসেব চুকে যায়। শুধু কোনও মাসে আটকে গেলে বিন্তির কাছে ধার নিতে হয়।
'বসে আছেন কেন? কম্পিউটার জানা আছে? বাংলা টাইপ? এটা কিন্তু পেপারলেস হাউস, কাগজে কলমে কোনও প্রুফ দেখা চলবে না।'
'জ্বি জানা আছে। কম্পিউটারেই দেখবো'
'ভাল।'
এটুকু বলেই সাইফুল নামে আরেকজনকে ডাকতে শুরু করলেন সম্পাদক সাহেব। বিমল চন্দ্রের মনে হল এখন তার উঠে গিয়ে কাজ শুরু করা উচিত। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। সাইফুল নামের লোকটা এগিয়ে এসে তার দিকে হাসিমুখে ইশারা করল। অর্থাত সেই তাকে কাজ বুঝিয়ে দেবে।
বিমল চন্দ্রের দিকে আর কারো খেয়াল নেই। সবার চোখে মুখে ব্যস্ততা উপচে পড়ছে। বিমল চন্দ্র ভাবছেন, যতো বেশি ব্যস্ততা, ততো বানান ভুল, ততো বেশি কাজ। বিমল চন্দ্র উঠে গিয়ে আরেকবার সম্পাদকের দিকে তাকালেন। সম্পাদক একটা কথা ভুল বলেছেন। অফিসটা পুরোপুরি পেপারলেস না। সবাই কম্পিউটারে কাজ করলেও সম্পাদকের সামনে একগাদা কাগজ। তিনি সেগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ছেন তার কলম দিয়ে কাটাকুটি করছেন।
প্রতিদিন গাদা গাদা বানান ভুল ঠিক করলে অন্য সব ভুলকে স্বাভাবিক মনে হতে পারে। বিমল চন্দ্রের কাছেও তাই জগতের কোনও ভুল মারাত্মক নয়। একই সূত্রে, বিন্তি তার আপন বোন না হলেও তার কাছে টাকা ধার চাওয়াটা অন্যায় কিছু হতে পারে না। এসব ভাবার সময় বিমল চন্দ্রের নিজেকে দার্শনিক মনে হয়। নিজে নিজে অনেক তত্ত্ব দাঁড় করিয়েছেন তিনি। ভাবেন, উপরে একজন দক্ষ প্রুফ রিডার আছেন। জগতের সকল ভুলকে শুদ্ধ করতে জানেন তিনি। কিন্তু তা করেন না। করলে আর মানুষের দরকার হতো না।
লেখক আর রিপোর্টাররা বানান ভুল না করলে বিমল চন্দ্রকে বেকার বসে থাকতে হতো। তাই ভুলেরও দরকার আছে। দোকানের সাইনবোর্ডে 'ফটোস্ট্যাট' বানানে 'মূর্ধন্য ষ' না দেখলে মগজে ষত্ব বিধান অতোটা কড়া আসন গাড়তো না নিশ্চয়ই। এ রকম গুটিকয় তৃপ্তিময় ভাবনা নিয়ে প্রতিদিন রাত এগারোটায় অফিস থেকে মেসে ফেরেন বিমল। ফেরার পথে ফার্মগেটের মোড়ে দেখা হয় মালতীর সঙ্গে। মালতী মেয়েটার আসল নাম নয়। এদের আবার আসল নাম থাকে না। সিনেমার তারকা কিংবা লেখকের মতো তাদেরও দুচারটে ছদ্মনাম থাকে। বিমল চন্দ্রের সঙ্গে মালতীর সখ্যতা কোনও কালে ছিল না। কখনও চোখাচোখিও হয়নি। তারপরও তারা পরিচিত। বিমল চন্দ্রের হাঁটা পথে মালতীর নিয়মমাফিক প্রতীক্ষা। দু'চারদিন অবশ্য চোখাচোখি হয়েছিল। কিন্তু সময়ের ব্যবধান অনেক। তাই দুপরে দৃষ্টিতে ছিল নির্বিকারত্ব। আর 'মালতী' নামটা? তা তৈরি করেছে বিমল চন্দ্রের অবচেতন মন।
মালতীর চোখের কাজল বাহুল্য দোষে দুষ্ট। তবে নিছক প্রয়োজনের তাগিদে ঐ অতিরিক্ত কাজলও অনেক অর্থবহ মনে হয় বিমল চন্দ্রের কাছে। কেমন যেন কাঁচা হাতের সাজ। তার চোখ দেখলেই চিরকুমার বিমল চন্দ্রের মনের ভেতর কেমন পাক খায়। সেই পাক খাওয়া অনুভূতিটাকে বেশ পবিত্র মনে হয়। মাঝে মাঝেই তার মালতীর মাথায় হাত বুলিয়ে বলতে ইচ্ছে করে, 'মা, তুই রাতে খেয়েছিস?' কিন্তু তিনি তা বলবেন না। সুযোগ পেলেও বলবেন না। বলে দিলেই ব্যাপারটা বিশ্রীরকম শুদ্ধ হয়ে গেল। এসব বড় মাপের শুদ্ধ করার মতা তার নেই।
বিমল চন্দ্রের কাজে সম্পাদক বেশ খুশি। তবে ভাবে তা খুব একটা প্রকাশ পায় না। ইদানীং কাজের চাপও বেড়েছে। বেশি বেশি বিজ্ঞাপন আসছে। সতর্কতার মাত্রা বাড়িয়ে সব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে হয়। বেশি সতর্ক থাকলে বিমল চন্দ্রের ভেতর অন্য এক অতি প্রাকৃতিক প্রুফ রিডারও কাজ করে। তার কাজও ভুল বের করা। তবে ভুল গুলো অন্যরকম। বানান নয়, সেই ভেতরের প্রুফ রিডার মানুষের মনের ভুল, কথার ভুল এগুলোর কারেকশন করে, নিঃশব্দে।
একটু আগেই সম্পাদককে ফোনে বেশ একচোট আত্তপ্রচার করতে শুনলেন। কথার মাঝে বিনয় আছে, আবার কেমন যেন ক্ষোভ। কথার সারমর্ম বিজ্ঞাপন কেন্দ্রিক। বিমল চন্দ্র ভাবেন, এই সব 'ভুল'ও থাকা চাই। এই সব ভুল না থাকলে তার মত লোকের বেতন মিলবে কোত্থেকে?
পাশ দিয়ে কে যেন হেঁটে গেল। বিমল চন্দ্র স্পষ্ট বুঝতে পারলেন, লোকটা ভুল বানানে হেঁটেছে। তা না হলে তার পা মাড়িয়ে যেত না। পা মাড়ানোর ব্যাপারটা দুজনের কেউ খেয়াল করলো না। বিমল চন্দ্র শুধু ভুলটুকুই বুঝতে পারেন। এর বেশি নয়। প্রুফ দেখায় বেশি ডুবে গেলে শরীরের প্রতি বিশেষ খেয়াল থাকে না। তাই তাপমাত্রা বৃদ্ধি সংক্রান্ত লক্ষ্মণগুলো অগোচরেই থেকে গেল।
রাত যত গভীর হয়, রাতের শুদ্ধ শব্দগুলো তত ডালা মেলতে থাকে। বিমল চন্দ্রের জ্বরও বাড়তে থাকে। মধ্যরাত পেরোয়নি। কিন্তু চারপাশে রাতের শব্দের ছড়াছড়ি। অদৃশ্য অক্ষর। বিমল চন্দ্রের প্রবল ইচ্ছে করে সেই শব্দগুলোর বানান ঠিক আছে কি না দেখে নিতে। আবার ইচ্ছেটা চলেও যায়। তিনি মুগ্ধ হয়ে প্রকৃতির অক্ষরমালা দেখতে থাকেন।
বিমল চন্দ্রের মনে হচ্ছে রাতের অর্ধেকটা সময় হেঁটে তিনি ফার্মগেট মোড়ে পৌঁছেছেন। এতো রাতে বাস পাওয়া যাবে না জেনেও তিনি স্ট্যান্ডের দিকে এগোচ্ছেন। পা এলোমেলো। তবে ভীড় না থাকায় চলার শুদ্ধতা পরীক্ষা নিস্প্রয়োজন। বিমল চন্দ্রের মনে হুট করে গেঁথে গেল, আরে! গোটা জগতটাই তো একটা ভুল! মহাজাগতিক ভুল! যে ভুল শোধরানো কিছুতেই সম্ভব নয়। সামনে একটা মানুষ হ্ন্তদন্ত হয়ে ছুটে যাচ্ছে। তার প্রতিটি পদেক্ষেপে ডবল স্পেস পড়ছে। ব্যাকস্পেস কী'টা কোথায়? মৃদু গুঞ্জন শুনতে পেলেন বিমল চন্দ্র। একগাদা মানুষ হড়বড় করে কী যেন বলছে। বিমল চন্দ্রের তাপমাত্রা ক্রমশ বাড়ছে। নিজেও তা টের পেলেন। বুঝতে পারলেন ডাহা ভুল শুনছেন তিনি। আশপাশে কেউ কথা বলছে না। দুচারজন রাস্তার আইল্যান্ডে ঘুমুচ্ছে। কিন্তু তারপরও কানে প্রচণ্ড লাগছে। এতোগুলো কণ্ঠ, সবাই ভুল বানানে কথা বলছে কেন? কাকে যেন বলতে শুনলেন, 'বুড়োটাই যত গণ্ডগোলের গোড়া' বিমল চন্দ্র স্পষ্ট বুঝতে পারলেন লোকটা 'গণ্ডগোল' বানানটা ভুল বলেছে। কিন্তু শুদ্ধ বানানটা তিনি নিজেই মনে করতে পারলেন না। কথার মধ্যে বানান ভুল ঠিক করার উপায়টা তিনি মনে করতে পারছেন না।
'স্যার কি অসুস্থ?'
বিমল চন্দ্র মেয়েটার দিকে তাকিয়ে রইলেন। স্যার সম্বধোন শুনে তিনি চমকে উঠলেন না।
'কেমন আছ মালতী?'
'স্যার আমার নাম জোনাকি। জোনাকি সিনেমা হলের নিচে থাকি, এই জন্যে জোনাকি। স্যার আফনের কি শইল বেশি খারাফ?'
আহা! কি সুন্দর করে মেয়েটা ভুল বানানে কথা বলছে! বিমল চন্দ্র এগিয়ে এসে মেয়েটার কপালে হাত রাখলেন, 'মা, রাতে খেয়েছ?'
'স্যার, আমার লগে চলেন, এতো রাইতে এই জ্বর লইয়া রাস্তায় পইড়া থাকবেন।'
আশপাশে ভুল বানানে কথা বলা লোকগুলো এখন ফিসফিস করছে। কে যেন বলল, 'বুইড়ার ভীমরতি হইছে'। একসঙ্গে সবাই তা বলতে শুরু করলো। ভীমরতি বানানে সবকটা হ্রস্বইকার দিয়ে ফেলেছে সবাই। বিমল চন্দ্রের ইচ্ছে হল, কাগজ কলমের মত সবার মুখে ছুরি দিয়ে কাটাকুটি করে বানান ঠিক করে দিয়ে আসে।
'স্যার, আফনে বসেন, মাথায় পানি দেই'। বিমল চন্দ্র কীভাবে বসবেন বুঝতে পারছেন না। তিনি মুগ্ধ হয়ে জোনাকির কথা শুনছেন। মনে হচ্ছে মেয়েটা যা বলবে তাই শুদ্ধ। আশপাশের লোকগুলোর ফিসফিস শব্দ ক্রমেই ম্রিয়মান হচ্ছে। জোনাকিকে মনে হচ্ছে শব্দদেবী। রাতের গভীরতার সঙ্গে তার শব্দের ঝুলিও উপচে পড়ছে। মায়ার শব্দ, ভালবাসার শব্দ। জোনাকির শব্দে ভুল আছে, তবে তার সাপেক্ষে নিজেকে নিজের কাছে বিমল চন্দ্রের বেশ অদক্ষ প্রুফ রিডার মনে হয়।
---১০ অক্টোবর, মিরপুর, ঢাকা।