আকাশলীনার শেষ চিঠি আমার হাতে। আজ বিকেলে ওর সাথে শেষবারের মত দেখা হল! খুব কাঁদছিল ও। আমি ওর চোখের জল মুছে দিতে পারিনি। সেই অধিকার আমি হারিয়েছি। বিশ্বাস ভঙ্গ করেছি আমি ওর সাথে। নিজেকে খুব বেশি ছোট মনে হচ্ছিল ওর সামনে। ওর কোন প্রশ্নেরই জবাব দিতে পারিনি। জবাব যে আমার কাছে ছিল না!
আমার ভালবাসা নাকি ওকে আর স্পর্শ কর না। সত্যিই কি স্পর্শ করে না? জানিনা...হয়তোবা ওর মুখের কথাটাই ঠিক। আমি একটা কাপুরুষ। একজন পুরুষকে ভালবাসা যায়,কাপুরুষকে নয়। ও কি জানবে এই কাপুরুষটা তার হৃদয় মন্দিরে এই দেবীর জন্য কত সুন্দর একটা আসন তৈরি করে রেখেছিল?
ওকে নিয়ে কত স্বপ্ন দেখিছিলাম... হয়তো আমাকে নিয়ে ও নিজেও বুনেছে হাজারো স্বপ্নের জাল। কিন্তু সব স্বপ্ন কি সত্য হবার জন্য জন্ম নেয়! হারিয়ে যাওয়ার জন্যই তো স্বপ্নের সৃষ্টি...! যেগুলোকে আমরা ধরতে পারি তারাই বাস্তব নামে টিকে থাকে। সব বাস্তবের অঙ্কুরোদগম তো সপ্নের মাঝেই।
ও আমার খুব কাছে বসে ছিল... কিন্তু ওকে আজ অনেক বেশি দূরের মানুষ মনে হচ্ছিল। এতো বেশি দূরের যে কখনো তার নাগাল পাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়।
আমার হৃদয়ে প্রতি মূহুর্তে একটি কথাই প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল, ‘আমার সবটুকু দিয়ে তোমায় ভালবেসেছিলাম,আজও একই ভাবে তোমায় ভালবাসি। কিন্তু সেই ভালবাসায় তোমায় সঙ্গী করতে পারিনি। আমায় ক্ষমা কর। সুখে থেকো তুমি...সুখে থেকো আকাশলীনা!’
ও চলে গিয়েছে অনেকক্ষণ আগে...আমায় ছেড়ে...যেমনিভাবে আমি গিয়েছিলাম আজ থেকে দু’বছর আগে।না,ওর আর আমার যাওয়া এক নয়। আমি গিয়েছিলাম ওকে কাঁদিয়ে। আর আজ ও চলে গেল কান্নাকে নিজের সঙ্গী করে।
ও বলেছিল ওকে আমার জীবন সঙ্গী করে নিতে। সমাজের রক্তচক্ষু তুচ্ছ করে আমার সাথে ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখেছিল ও। ওর কাছে ভালবাসাই ছিল সবকিছু... কিন্তু আমার কাছে? তখন সমাজের ছি ছি করে ওঠাকে বড্ড বেশি ভয় করেছিলাম। আমার ভয়টুকুর জন্য সমাজ কিংবা ধর্মের কাছে হয়তো অনেক বেশি বাহবা পেয়েছি... কিন্তু ওর কাছে আমি হয়েছি একজন পরাজিত প্রেমিক... একজন মৃত মানুষ!
কিইবা ক্ষতি হত যদি সেদিন রাতের অন্ধকারে পালিয়ে না গিয়ে আমি ওর আহবানে সাড়া দিতাম,সমাজের সব নিয়ম-কানুন উপেক্ষা করে ওর সাথে ঘর বাঁধতাম? ওর কাছে অন্তত আমি একজন সত্যিকারের প্রেমিক হতে পারতাম!
আজ এই নির্জন সন্ধ্যায়,এই উন্মুক্ত আকাশের নিচে,এই নদীর তীরে আমি একজন পরাজিত মানুষ আমার সবটুকু শুন্যতা নিয়ে একা দাঁড়িয়ে আছি। আমার শুন্যতা মুছে দেবার জন্য আজ ও আসবে না। আজ ও আমার নয়।আমার অমূল্য সম্পদ আমি হেলায় হারিয়েছি!
আমার হাতে আমায় লেখা ওর শেষ চিঠি!সাদা খামের উপর তারিখ দুবছর আগের ঠিক আজকের এই দিন! সেদিন হয়তো ও কত আশা আর কত কান্নার রঙে লিখছিল এই চিঠি! কিন্তু সেই চিঠি তার গন্তব্য খুঁজে পায়নি। সবকিছু পেছনে ফেলে আমি নিজেকে নির্বাসিত করেছিলাম ভালবাসা শুন্য এক নিষ্ঠুর পৃথিবীতে!
আজ সে চিঠি তার হারিয়ে যাওয়া গন্তব্য খুঁজে পেয়েছে। কিন্তু বড্ড বেশি দেরি হয়ে গেছে!
আকাশলীনা কেন ঠিক আজকের দিনটি বেছে নিল? আমাকে কেন মর্মে মর্মে মনে করিয়ে দিল সেই দিনটি যেদিন আমি পরাজিত হয়েছিলাম ওর পবিত্র ভালবাসার কাছে?
এই চিঠি খুলে পড়ার বিন্দুমাত্র সাহস আমার নেই। আমি আজও এতটুকু শক্তি অর্জন করতে পারিনি যাতে ওর ভালাবসার মুখোমুখি হতে পারি। আজ এতকাল পর ওর চিঠি পড়ে কিইবা হবে যদি আমি চিঠির মাঝে লুকিয়ে থাকা ওর কান্নার জল মুছে দিতে না পারি!
তাই বয়ে চলা একলা নদী ভাসিয়ে নিক আমায় লেখা ওর শেষ চিঠি! আমায় নিয়ে ওর রচিত শব্দগুলো ভেসে চলুক মহাকালকে সঙ্গী করে। আমি নাহয় সমস্ত জীবন এই অদেখা শব্দগুলোকে নিয়ে রচনা করব নানা রঙের কল্পনা। যুদ্ধ করব অতৃপ্তিকে সঙ্গী করে বেঁচে থাকার।
‘আকাশলীনা...মহাকালকে শুন্যতায় রাঙিয়ে ভাসিয়ে দিলাম আমায় লেখা তোমার শেষ চিঠি’
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে নভেম্বর, ২০১১ বিকাল ৪:৪৯