না…একনায়ক হিটলারের কর্ম নিয়ে স্তুতি কিংবা নিন্দা করার জন্য আমার লেখা নয়।আমি একটি মুভি রিভিউ দেবার অপচেষ্টা করব।মুভির নাম Downfall!
সফলতার চরম শীর্ষে উপনীত হবার পর ইতিহাসের সবচেয়ে আলোচিত এই মহানায়ক(কিংবা স্বৈরশাসক) কিভাবে তার পতনের শেষ দিনগুলো একজন দর্শক হয়ে প্রত্যক্ষ করেন তা নিয়েই এই মুভি!
স্টালিনগ্রাদ যুদ্ধের(১৯৪২-১৯৪৩) পূর্ব পর্যন্ত হিটলার তার সাম্রাজ্য বিস্তারে ছিল অপ্রতিরোধ্য!ইউরোপ জুড়ে জার্মান বাহিনী তাদের চরম আধিপত্য ও নৃশংশসতার ছাপ রেখে সদর্পে এগিয়ে চলছিল। কিন্তু রাশিয়ার স্টালিনগ্রাদে প্রকৃতির সাথে ভয়াবহ যুদ্ধে পরাজয় বরণ করে জার্মান বাহিনী। পতনের শুরু এখানেই। এর ঠিক দুবছর পর ১৯৪৫ এর এপ্রিলে জার্মানীর বার্লিনের দ্বারপ্রান্তে রুশ বাহিনী শক্ত অবস্থান প্রতিষ্ঠা করে। বার্লিনের পতন তখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। নিশ্চিত পতনের সম্মুখে দাঁড়িয়ে একসময়ের প্রবল পরাক্রমশালী একনায়ক হিটলার। এখানেই শুরু এই মুভির ঘটনাপ্রবাহ!
চলচিত্রে ইতিহাসের চিত্রায়নঃ
হিটলারের একজন ব্যাক্তিগত সেক্রেটারীর জবানবন্দির মাধ্যমে মুভির প্লট উন্মোচন। মুভির প্রথমদিকের একটি দৃশ্যে দেখা যায় ১৯৪৫ এর ২০ এপ্রিল সকালে বার্লিন শহরে প্রথম আর্টিলারি বোমা বর্ষণ শুরু হয়। প্রবল প্রতাপের সাথে অগ্রায়মান রুশ বাহিনীকে হিটলারের জার্মান বাহিনী আপ্রাণ চেষ্টা করে ঠেকিয়ে রেখেছে কোনমতে। কিন্তু তা যে ক্ষণস্থায়ী এ ব্যাপারে সবাই কমবেশি নিশ্চিত।জরুরী সভা বসে তার অধীনস্ত জেনারেল ও অফিসারদের নিয়ে। হিটলারকে যখন জানানো হচ্ছিল যে একে একে জার্মান বাহিনী রুশদের কাছে পরাজিত হচ্ছে...তাদের আর কোন রকমে প্রতিরোধ করে রাখা সম্ভব হচ্ছে না তখন হিটলার এমন সব সামরিক নির্দেশ দিচ্ছিলেন যা বাস্তবায়ন করা কোনভাবেই সম্ভব ছিল না।কারণ জার্মান বাহিনীর বিভিন্ন ফ্রন্ট রুশদের কাছে ক্রমাগত পর্যদুস্ত হচ্ছিল।একসময়ের পৃথিবী কাপানো অজেয় জার্মান বাহিনীর শক্তি মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে প্রায় ক্ষীয়মান হয়ে আসছিল।
বাঙ্কারের নিচের ঐ সভায় হিটলার যখন তার অধীনস্ত অফিসারদের উদ্দেশ্যে করে উদ্ধত স্বরে নির্দেশ দিচ্ছিল এবং তাদের বিভিন্ন ভুল ও অবাধ্যতার জন্য দায়ী করছিল...তখন ঐ অভিনেতা (ব্রুনো গ্যানজ) যেন হিটলারকে শতভাগ নিজের মাঝে ধারণ করছিল! একমূহুর্তের জন্যও মনে হয়নি অভিনয় দেখছি! মনে হয়েছে হিটলার চরিত্রটি বাস্তবে এর চেয়ে এক বিন্দু এদিক ওদিক ছিল না! হ্যাটস অফ টু ব্রুনো গ্যানজ। বাহ্যিক গড়নেও হিটলারের কাছ থেকে আলাদা করা প্রায় অসম্ভব।
এরপর একটি দৃশ্যে দেখা যায় হিটলার তার কয়েকজন প্রিয় অফিসাদের তার স্বপ্নের শহরের মডেল দেখাচ্ছেন। সেখানেও জার্মানী নিয়ে তার উচ্চাশার প্রকাশ দেখতে পাই। তার স্বপ্ন বার্লিন হবে জ্ঞান-বিজ্ঞান,শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিতে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ শহর যা হাজার বছর মাথা উঁচু করে টিকে থাকবে। বার্লিন শহরে যখন প্রতিনিয়ত রুশবাহিনী বোমা নিক্ষেপ করছে তখন এ নিয়ে তার উক্তি,“এই বোমা বর্ষণের একটা ভাল দিক আছে। আমার স্বপ্নের এই শহর গড়ার জন্য এমনিতেই অনেক স্থাপনা ভাঙতে হত...রুশরা নিজেরা তা ধ্বংস করে আমার কাজ এগিয়ে দিচ্ছে!”
সময় যত গড়িয়ে যায় রুশরা জার্মানীর তত বেশি অংশ দখল করে নেয়।তার অধীনস্ত জেনারেল ও অফিসাররা তাকে বারবার বার্লিন ত্যাগ করার অনুরোধ করেন।কিন্তু হিটলার তখনো মিথ্যে আশায় নিজেকে ডুবিয়ে রেখছেন। হয়তো এভাবে নিজের পতন কোনভাবেই মানতে পারছিলেন না!যখন হিটলার বুঝতে পারেন পরাজয় অবশ্যম্ভাবী হিটলার সিদ্ধান্ত নেন কোনভাবেই রুশদের হাতে নিজেকে সোপর্দ করবেন না! নিজের আত্নঅহংকার বজায় রেখে হিটলার আত্নহত্যার সিদ্ধান্ত নেন।
হিটলারকে যখন তার বিশ্বস্ত জেনারেল হিমলার তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে তাকে ত্যাগ করে তখন তিনি অনেক বেশি বিমর্ষ হয়ে পরেন।নিজের চূড়ান্ত ক্ষোভ প্রকাশ করেন নিজের ভাগ্যের প্রতি।
আত্নহত্যার আগে হিটলার তার ১৫ বছরের সঙ্গী এক সময়ের সেক্রেটারী ইভা ব্রাউনকে বিয়ে করে স্ত্রীর স্বীকৃতি দেন। এরপর তার দেহরক্ষী ও একসময়ের এস এস এর সদস্য গুনশেকে নির্দেশ দেন যে আত্নহত্যার পর হিটলারের মৃত দেহটিকে যেন পুড়ে ফেলা হয়। তার ভস্ম শরীরের একটু ছাইও যেন রুশরা খুঁজে না পায়।এরপর হিটালার ও তার সহধর্মিনী ইভা ব্রাউন একসাথে আত্নহত্যা করেন।
হিটলার আত্নহত্যা করার পর তার দীর্ঘদিনের সহযোগী ও জার্মানীর চ্যান্সেলর গোয়েবলস ও তার স্ত্রী আত্নহত্যা করার সিধান্ত নেন। যেখানে তাদের প্রিয় ফুয়েহার(নেতা) নেই, ফুয়েহারের স্বপ্নের জাতীয়তাবাদ নেই সেখানে তাদের ও তাদের সন্তানদের কোন ভবিষ্যৎ থাকতে পারে না! গোয়েবলস ও তার স্ত্রী তাদের ছয় সন্তানকে নিজ হ্যাতে হত্যা করে নিজেরা আত্নহত্যা করেন হত্যা!
এমনিভাবে উচ্চপদস্থ অনেক অফিসার,সেনা কর্মকর্তা ও যারা হিটলারের প্রিয় পাত্র ছিল তারা আত্নহত্যা করে। ১৯৪৫ সালে জার্মানীতে ৭০৫৭ টি আত্নহত্যার ঘটনা ঘটে যা অন্য যেকোন বছরের তুলনায় পাঁচগুণ। আর এই সংখ্যার অর্ধেকেরও বেশি ঘটে বার্লিন যুদ্ধের সময়(১৬ এপ্রিল ১৯৪৫- ২ মে ১৯৪৫)।
হিটলার কি এমন নেতা ছিলেন যে জার্মান জাতিকে নিজের প্রতি এমনভাবে মোহমুগ্ধ করে রেখেছিলেন...তা ভাবলে সত্যি বিস্ময় জাগে! একজন নেতা কিভাবে একটি জাতিকে জাগাতে পারে তা সবচেয়ে বড় উদাহরণ হয়ে থাকবে সর্বকালের সবচেয়ে আলোচিত(নন্দিত এবং নিন্দিত) এডলফ হিটলার ।
হিটলার পরাজিত হয়েছে বলে ইতিহাস রচিত হয়েছে তাকে ‘নরখাদক’ আখ্যা দিয়ে। কিন্তু হিটলার জয়ী হলে ইতিহাস নিঃসন্দেহে অন্যভাবে লেখা হত। হিটলার তখন স্বৈরশাসক হিসেবে নিন্দিত না হয়ে মহানায়ক বলে জায়গা করে নিত ইতিহাসে পাতায়!
মুভিটা দেখে আমি এতই মুগ্ধ হয়েছিলাম যে একদিনে তিনবার দেখে ফেলি! মুভিটা নিয়ে আমার লেখা কিছুটা পক্ষপাত দুষ্টু হলেও মুভিটা এই দোষ পুরোপুরি উৎরে গেছে!একনায়কের উর্দ্ধে হিটলার যে সর্বোপরি একজন মানুষ তা স্পষ্টভাবে তুলে ধরা হয়েছে!
নিঃসন্দেহে এটা হিটলারকে নিয়ে করা শ্রেষ্ঠ মুভি।যারা ইতিহাস ভালোবাসেন তাদের কাছে মুভিটা ভাল লাগবে এ বিষয়ে আমি নিশ্চিত।
একনকজরে কিছু তথ্যঃ
মুভির নামঃ Downfall
দেশঃ জার্মানী
ভাষাঃ জার্মান
রিলিজিং ইয়ারঃ ২০০৪
ডিরেক্টরঃ Oliver Hirschbiegel.
রানটাইমঃ ১৫৩ মিনিট( ১৭৮ মিনিট এক্সটেন্ডেড ভার্সন)
আই এম ডি বি রেটিং: ৮.৪
রোটেন টমেটোস রেটিং: ৯১%
স্টেজভু ডাউনলোড লিংক
টরেন্ট ডাউনলোড লিঙ্ক
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই ডিসেম্বর, ২০১১ দুপুর ১২:৩৭