একটি গল্প দিয়ে শুরু করি।গ্রীক পুরাণের খুব বিখ্যাত এক গল্প।ইকো ও নার্সিসাস এর গল্প...
“অনেক অনেক দিন আগে নার্সিসাস নামে এক যুবক ছিল।সে ছিল এক দেবতার পুত্র।রূপ মাধুর্যে সে ছিল অতুলনীয়।তার রূপে মুগ্ধ হয়ে অনেক নারী তার প্রেমে পড়ে গিয়েছিল।কিন্তু সে কাউকেই প্রেমের আহবানে সাড়া দেয়নি।
একদিন নার্সিসাস তার বন্ধুদের সাথে বনের মাঝে শিকার করতে বের হয়।একটি হরিনের পেছনে ছুটতে ছুটতে সে একটি জলাধারের কাছে এসে থামে। সে খুব তৃষ্ণার্ত ছিল তাই সেই জলাধারের পানি পান করার জন্য নিচু হয়।সে তখন জলাধারের স্বচ্ছ পানিতে প্রথমবার নিজের অপরূপ প্রতিবিম্ব দেখে সব কিছু ভুলে অপলক নয়নে চেয়ে থাকে।
এদিকে ঐ জলাধারে ইকো নামে এক জলপরী বাস করত দেবতার অভিশাপে যে নিজ থেকে কিছু বলার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছিল।সে শুধু যা শুনত তাই বলতে পারত।অর্থাৎ প্রতিধ্বনি করতে পারত।
জলপরী ইকো রূপবান নার্সিসাসকে দেখে ভালবেসে ফেলে।কিন্তু সে অভিশাপের কারণে কথা বলে তার ভালবাসা প্রকাশ করতে পারে না।সে তার ভালবাসা প্রকাশের অনেক চেষ্টা করেছিল।কিন্তু নার্সিসাস নিজেতে এত বেশি মগ্ন ছিল যে সে সেদিকে ভ্রুক্ষেপও করেনি।
এতে ইকো খুব কষ্ট পায় এবং প্রত্যাখানের বেদনা নিয়ে গুহায় আশ্রয় নেয়।এতে দেবতা নেমেসিস নার্সিসাসের উপর খুব ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠেন এবং তাকে এক ভয়াবহ শাস্তি দেন।
দেবতার অভিশাপে নার্সিসাস নিজের প্রতিচ্ছবিকে ভালবেসে ফেলে।নার্সিসাস দিনের পর দিন নিজের প্রতিচ্ছবির দিকে তাকিয়ে থাকে এবং একসময় তার মৃত্যু হয়। নার্সিসাস যেখানে মারা যায় সেখানে খুব সুন্দর একটি ফুল জন্ম নেয় যার নাম নার্সিসাস ফুল।”
সবার জানা গল্পটি আবারো বললাম শুধু এটি বোঝানোর জন্য যে মানুষ রূপকথা,পুরাণ কিংবা ইতিহাস সব স্থানে,সব কালে নিজের প্রতিবিম্ব দেখে বারবার বিস্ময় অনুভব করছে।এবং আজ অবধি তার খুব ব্যতিক্রম হয়নি।
নিজের রূপের প্রতি মুগ্ধতা নেই এমন মানুষ খুব কমই আছে তা সে দেখতে যেমনই হোক না কেন।নিজের প্রতি জ্ঞাত কিংবা অজ্ঞাত এই আকর্ষণকে বলে ‘নার্সিজম’।আর তাইতো মানুষ আয়নার সামনে ঘন্টার পর ঘন্টা সময় ব্যয় করে।এক জরিপে দেখা যায় নারীরা গড় হিসেবে বছরে পাঁচ দিন আয়নার সামনে সময় ব্যয় করে অর্থাৎ তার সমস্ত জীবনের প্রায় এক বছর!
পুরুষের জন্যও কিন্তু সময়টা খুব কম নয়। খুব ব্যস্ত পুরুষও দিনে তিন-চারবার আয়নার সামনে এসে দাঁড়ান। আর শেভ করা কিংবা চুল কাটার জন্য তারাও বিরাট একটা সময় আয়নাকে দিতে বাধ্য হন।
আয়না নিয়ে এত কথা বলছি কারণ আয়নার ব্যাপারটা আমাকে খুব মুগ্ধ করে।ভাবতেই খুব অবাক লাগে সৃষ্টির বহু বছর পর্যন্ত মানুষ জানত না সে দেখতে কেমন! খুব অবাক হয়ে ভাবি কেমন হয়েছিল তাদের মুখভংগি,কেমন হয়েছিল তাদের চোখের ভাষা যখন সে অবাক বিস্ময়ে নিজের রূপ আবিষ্কার করে। নার্সিসাসের গল্পের চেয়েও অনেক বেশি আলোড়িত করে সেই ভাবনা।
আয়না নিয়ে মানুষের জল্পনা কল্পনার শেষ নেই। বিজ্ঞানীরাও করেছেন বিস্তর গবেষণা।তারা আবিষ্কার করলেন প্রতিফলনের সূত্র যা আলোকবিদ্যাকে সূচনা করে দিল নতুন এক অধ্যায়ের। এই সূত্র ব্যবহার করেই মানুষ জানতে পারল কিভাবে আয়নায় তার প্রতিবিম্ব তৈরি হয়।
আজ আয়নার ব্যবহার শুধু মুখশ্রী দেখায় সীমাবদ্ধ নয়।পরীক্ষাগারে,যানবাহনে,চিকিৎসাক্ষেত্রে সর্বত্র আয়না ব্যবহৃত হচ্ছে।
যাই হোক আয়নার নিয়ে তত্ত্বকথা বলার জন্য এ লেখা নয়।আয়না মানুষের সংস্কৃতির মাঝে নানা ভাবে বার বার স্থান করে নিয়েছে। লালনের খুব বিখ্যাত একটি গান আছে
“বাড়ির কাছে আরশি নগর,
সেথা পড়শি বসত করে;
আমি একদিনও না দেখিলাম তারে”
এই গানটি নিয়ে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তার ‘মনের মানুষ’ উপন্যাসে খুব সুন্দর একটি গল্প লিখেছেন। গল্পটি এরকম...
“লালনের সাথে জ্যোতিরিন্দ্রনাথের দেখা হয়েছে।জ্যোতিরিন্দ্রনাথ লালনের পোট্রেট করছিল আর লালন তাকে এই গানটি শুনাচ্ছিল।গান শেষে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ তাকে তার পোট্রেট দেখালে লালনের সমস্ত মুখে বিস্ময়ের হাসি ছড়িয়ে গেল।লালন এই প্রথম তার ছবি দেখছে।সে জানত না সে দেখতে কেমন। কোন মানুষ তার সমস্ত জীবনে নিজেকে একবারও দেখেনি জ্যোতিরিন্দ্রনাথ তা জানতে পেরে খুবই অবাক হন। তিনি জানতে চান আরশি সম্পর্কে না জেনে তিনি আরশি নিয়ে গান লিখলেন কিভাবে।লালনের প্রত্যুত্তর ছিল যে সে এমনি এক আরশি নগর যেথায় নিজেকে দেখা যায় না পরশীকেও দেখা যায় না।এই পরশীই হল ‘মনের মানুষ’ বা পরমেশ্বর!”
আরশি,দর্পণ কিংবা আয়না যাই বলি না কেন এই বস্তুটি প্রত্যেক মানুষকে নিজেকে চিনতে শিখিয়েছে।মানুষকে এনে দিয়েছে তার আপন পরিচয়।
আয়না নিয়ে বাংলা সাহিত্যে অনেক কবিতা রচিত হয়েছে।অনেক লেখক রচনা করেছেন অনেক উপন্যাস।আমার খুব প্রিয় লেখক হুমায়ূন আহমেদের খুব সুন্দর দুটি উপন্যাস আছে এই আয়না নিয়ে। প্রথমটি হল ‘আয়নাঘর’ ।আর দ্বিতীয়টি হল ‘মিসির আলির চশমা’ ।
সবশেষে আয়না নিয়ে রচিত আমার খুব প্রিয় একটি গান,‘আয়নাতে ঐ মুখ দেখবে যখন,কপোলের কাল তিল পরবে চোখে
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১২ দুপুর ২:০৯