somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বেনজির হত্যা ও কারণ - আমার মতামত

২৮ শে ডিসেম্বর, ২০০৭ দুপুর ১২:১০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

(লেখার মতামত আমার ব্যক্তিগত - ইন্ডিয়া-পাকিস্তান ফ্রেন্ডশিপ কমিউনিটির সদস্য হিসাবে ও পাকিস্তানে সংবাদপত্র নিয়মিত পড়ার কারণে আমার নিজস্ব ধারণা থেকে লেখা)

আমার মনে হয়না তালিবানি জঙ্গী ছাড়া বেনজিরের হত্যা আর কেউ করেছে - পর্দার পেছনেও আর কারো স্থান পাওয়াও মুশকিল। মুশারফ যতই বলুন, এই ঘটনায় সবথেকে বড় ক্ষতি তার নিজেরই হয়েছে - তাই আমার মনে হয়না এত বোকার মত কাজটা করিয়েছে।

তালিবানিরা আগে থেকেই ঘোষণা করেছিল যে মহিলা রাষ্ট্রপ্রধান তারা কিছুতেই মেনে নেবেন না কারণ তা ইসলাম-বিরোধী। আর বেনজির দেশে ফেরার চেষ্টা করলে তাকে একই কারণে হত্যা করা হবে। বর্তমান পরিস্থিতিতে ভোট হলে বেনজিরের জয় সুনিশ্চিত ছিল। সুতরাং ওই জঙ্গী-গোষ্ঠীরাই এটা সরাসরি কারো মদত ছাড়াই এই কাণ্ড করিয়েছে বলে আমার ধারণা।

অনেকেই বলে থাকতে পারেন যে এই গোষ্টীগুলোর এত দাপট কি ভাবে যদি না এদের পেছনে কারো মদত থেকে থাকে। মদতের কথায় পরে আসা যেতে পারে, তবে আপাতত বলে রাখি এদের শক্তি সম্পর্কে আমার কোনো সন্দেহ নেই। কিছুদিন আগেই খবরে প্রকাশ যে বেশ কিছু পাকিস্তানি আর্মি কম্যান্ডারও এদের পেছনে আছে। এমনকি, বার-দুয়েক, পাকিস্তানি আর্মির সৈন্য নিজে আত্মঘাতী হামলা চালিয়ে তার সহকর্মীদের মেরে ফেলার ঘটনাও সামনে এসেছে। সুতরাং, জন-সমর্থনের প্রশ্নে এদের খুব একটা সমস্যা আছে বলে মনে হয় না। এর পরে আসে, অস্ত্র-সমর্থনের প্রশ্ন। যেহেতু পাকিস্তানি আর্মির একাংশ এদের সাথে জড়িত তাই সে বিষয়েও এদের কোনো সমস্যা নেই।

উত্তর-পূর্ব পাকিস্তান আর বালুচিস্তানে আছে আফগানিস্তান থেকে বিতাড়িত এক দল তালিবানি। মজার ব্যাপার হচ্ছে, পাকিস্তান সরকার থেকে এই আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকা কখনই শাসন করার চেষ্টা করা হয়নি। ফেডারাল ট্রাইবাল ল এর সমর্থনে, এই ওয়াজিরিস্তান অঞ্চল সর্বদাই "স্বাধীন" ছিল। তাই যখন পাকিস্তান আর্মি তাদের অঞ্চলে জঙ্গী খোঁজার নামে হামলা শুরু করল তারা সেটাকে তাদের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ বলে মনে করা শুরু করল। শুধু তাই নয়, ৯/১১ পরবর্তী পাকিস্তানে তিন ধরনের দল তৈরী হল। এক দল দেশ থেকে যে কোনো মূল্যে তালিবান ও জঙ্গীবাদ দূর করা পক্ষে, একদল বাস্তবসম্মত ভাবে আমেরিকার সাথে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই বলে মনে করত আর শেষ আরেকদল যে কোনো মূল্যে আমেরিকা বিরোধিতা করতে প্রস্তুত। তাদের সমর্থন আর বিপক্ষের দল তৈরী হল পাকিস্তানে আর শুরু হল আইডিওলজিকাল কনফ্লিক্ট। যেহেতু পাকিস্তানে লোকের হাতে বন্দুকের অভাব নেই, তাই অচিরেই এই বিবাদ গলা ছেড়ে বন্দুকের আওয়াজে নেমে এল। বেনজির প্রথমদলের সমর্থক ছিলেন বলে, এই বিবাদ-কেই শর্ট টার্মে বেনজিরের হত্যার কারণ বলে চিহ্নিত করা যায়।

এবারে আসা যাক তুলনামূলক গূঢ় কারণে। আমি প্রথমে আমেরিকার ভূমিকায় আসি। সোভিয়েত ইউনিয়নের পেছনে লাগার জন্য আমেরিকা আশির দশকে ব্যবহার করত এই তালিবানিদের। আমেরিকা থেকে আসা ও রাশিয়ানদের ফেলে যাওয়া অস্ত্রবলে এরা বলীয়ান - সাথে আছে গরিলা যুদ্ধের ট্রেনিং যা আমেরিকানরা দিয়ে গেছে। আপাতদৃষ্টিতে এদের মৌলবাদী বলে মনে হলেও এরা এরকম মৌলবাদী ছিল না - আমেরিকা আর সি-আই-এ 'নাস্তিক' কমিউনিস্টদের আটকানোর জন্য যে ট্রেনিং ক্যাম্পগুলো তৈরী করেছিল, তাতে এদের মৌলবাদীত্বে দীক্ষিত করা হয়েছে। আমার এই ধারণার কারণ ভারতে (বিশেষত কোলকাতায়) বসবাসরত আফগান আর পাশতুনরা। এদের মধ্যে একজনও কোনো মৌলবাদী ধারণায় উদ্বুদ্ধ নয় - বরং শান্তিপূর্ণ ভাবে জীবন-যাপণ করে - আর দশজন বাঙালীর মতই। একই জনগোষ্ঠীর লোকে যদি আরেক জায়গায় শান্তিপূর্ণভাবে বাস করতে পারে, তবে মূল জনগোষ্ঠীকে কিভাবে মৌলবাদী বলা চলে?

সবশেষে আসা যায় পাকিস্তানের ইতিহাসের দিকে। স্বাধীনতার পর থেকেই যেহেতু (পশ্চিম) পাকিস্তান প্রায় সংখ্যালঘু-শূন্য হয়ে পড়ে - তাই রাজনীতিকরা দলাদলি করার জন্য আবার বেছে নেন ধর্মকেই। শুরু হয় কে কতটা বেশী ধর্মপরায়ণ - তার ভিত্তিতে দলাদলি। প্রথম ধাপ হিসাবে দলাদলি শুরু হয় আহমদিয়া (কাদিয়ানি) দের নিয়ে। সময় যত এগোয়, কাদিয়ানিরা একরকম এক-কোণে আশ্রয় নেয়। এদের কফিনে শেষ পেরেক পুঁতে দেন জিয়া। উনি, আইন করে কাদিয়ানিদের মসজিদ বানানো বন্ধ করে দেন, আর পাকিস্তানের ইসলামিক পাসপোর্ট পাবার জন্য কাদিয়ানি নবীকে 'ইমপোস্টার' হিসাবে ডিক্লারেশন দেওয়া বাধ্যতামূলক করে দেন (বলাই বাহুল্য - এখনো এই আইনগুলোর পরিবর্তন হয়নি)। এই জিয়ার আমলেই পাকিস্তানের আইডিওলজিকাল পার্টিশন নিশ্চিত হয়। কাদিয়ানিদের কফিনে পেরেক পোঁতা শেষ হলেও দলাদলি শেষ হয় না। রাজনীতিকরা শুরু করেন পরবর্তী পার্টিশন - সূফী বনাম তালিবানি। একই সময়ে, আশির দশকে প্রচুর আফগান পাকিস্তানে রিফিউজি হিসাবে চলে আসে, যারা এই তালিবানি ঘরাণাকে পাকিস্তানে সুপ্রতিষ্ঠিত করে।

একরকম ভাবে দেখলে আমার ব্যক্তিগত মতে, পাকিস্তানে এই আইডিওলজিকাল পার্টিশন হবারই ছিল। পারিপার্শ্বিকতা তাকে হয়ত ত্বরান্বিত করেছে। ধর্মের ভিত্তিতে দেশ পরিচালনা করলে সব সময়েই নিজেকে বেশী ধার্মিক দেখিয়ে বেশী সুবিধা অর্জনের প্রচেষ্টা জনগণের মধ্যে দানা বাঁধে। আর জনগণ যদিও বা দূরে থাকতে চায়, তাদের ব্যবহার করার মত রাজনীতিকের অভাব হয় না কখনই। আর সেই আইডিওলজিকাল পার্টিশন এখন পূর্ণোদ্যমে একের পর এক প্রাণহন্তারক হামলার আকারে আত্মপ্রকাশ করেছে - এ তো হবারই ছিল।

এখন যদি মুশারফ সরে গিয়ে দেশে গণতন্ত্রও আসে, আমার মনে হয়না একদিনে সমস্যার সমাধান হবে। অন্তত, বিশ বছর গণতন্ত্রে থাকলে যদি বা কিছু পরিবর্তন হয়। গণতন্ত্রের একটা সুবিধা হল এতে একটা প্ল্যাটফর্ম পাওয়া যায় যাতে লোকে ধৈর্য ধরতে শেখে, আলোচনার মাধ্যমে বিবাদ-মীমাংসা শেখে আর দেশের অন্যপ্রান্তে জন-মতামত সম্পর্কে ধারণা করতে শেখে। এই তালিবানি জঙ্গীরা যদি জানত যে দেশের অধিকাংশ মানুষ তাদের আসলে পছন্দ করে না, তবে হয়ত অনেকেই অস্ত্রের পথ ছেড়ে দিত - ব্রেনওয়াশ করাও শক্ত হত। লোকে সামরিক শাসনে ধৈর্য না হারিয়ে ভোটের জন্য ৫ বছর অপেক্ষা করতে শিখত। তাই পাকিস্তানের এই বিবাদ থেকে মুক্তির একটাই পথ - গণতন্ত্র।
৮টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মিশন: কাঁসার থালা–বাটি

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:২৭

বড় ভাই–ভাবীর ম্যারেজ ডে। কিছু একটা উপহার দেওয়া দরকার। কিন্তু সমস্যা হলো—ভাই আমার পোশাক–আশাক বা লাইফস্টাইল নিয়ে খুবই উদাসীন। এসব কিনে দেওয়া মানে পুরো টাকা জ্বলে ঠালা! আগের দেওয়া অনেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

J K and Our liberation war১৯৭১

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯



জ্যাঁ ক্যুয়ে ছিলেন একজন ফরাসি মানবতাবাদী যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করেছিলেন। তিনি ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে প্যারিসের অরলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ

লিখেছেন এ আর ১৫, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:৪০



এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ


২০০৪ সালের ২১ শে অগাষ্ঠে গ্রেনেড হামলার কারন হিসাবে বলা হয়েছিল , হাসিনা নাকি ভ্যানেটি ব্যাগে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন ছায়াযুদ্ধ: R থেকে MIT—কুয়াশার ভেতর নতুন ক্ষমতার সমীকরণ

লিখেছেন এস.এম. আজাদ রহমান, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:৪৪



বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন ছায়াযুদ্ধ: R থেকে MIT—কুয়াশার ভেতর নতুন ক্ষমতার সমীকরণ

কেন বিএনপি–জামায়াত–তুরস্ক প্রসঙ্গ এখন এত তপ্ত?
বাংলাদেশের রাজনীতিতে দীর্ঘদিন ধরে একটি পরিচিত ভয়–সংস্কৃতি কাজ করেছে—
“র”—ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা নিয়ে রাজনীতিতে গুজব,... ...বাকিটুকু পড়ুন

×