somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বিভাজনের বাইরে এক মূসাভাই

২৭ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১০ সকাল ১১:৫৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আজকের সাংবাদিকতা জগতে এক মহীরুহ আমাদের প্রিয় মূসাভাই। সবার কাছে ও সব মহলে সমান গ্রহণযোগ্য একজন নির্ভীক সাংবাদিক। রাজনৈতিক বিভাজনের এই সমাজে কারও পক্ষে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হওয়া অতি দুরূহ। এই বিভাজনের সমাজে আপনি হয় আমার সঙ্গে, না হয় আমার বিপক্ষে। এই বিভাজনের সীমারেখা অতিক্রম করতে পেরেছেন এবিএম মূসা। সাংবাদিকতা জগতের সর্বত্র বিচরণ করেছেন অর্ধশতাব্দীরও অধিক কাল। সাব-এডিটর ও রিপোর্টার, এমনকি ক্রীড়া প্রতিবেদক থেকে সফল নিউজ এডিটর, পরে সম্পাদক, বিদেশি পত্রিকার প্রতিনিধি, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে রণাঙ্গনের সংবাদদাতা। এখন সবচেয়ে জনপ্রিয়তা পেয়েছেন কলামিস্ট মূসাভাই।
এই মূসাভাই ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১০ ৮০ বছরে পা রাখবেন। এই দীর্ঘ সময়ের অর্ধেকটা আমি নানাভাবে তাঁর খুব কাছে কাছে ছিলাম। এখনো আছি প্রেসক্লাবের আড্ডায়, প্রেস কনফারেন্সে, জনপ্রিয় টিভি টকশোতে আর সামাজিক অনুষ্ঠানে। শুরুটা হয়েছিল ষাটের দশকের শেষ দিকে, বিশ্ববিদ্যালয়ের লেখাপড়া শেষ করে আমি যখন তদানীন্তন পাকিস্তান অবজারভার-এ যোগ দিই। সাংবাদিকতা শুরু করেছিলাম অনুসন্ধানী রিপোর্টিং করার জন্য রিসার্চ সেলে। এক বছর কাজ করার পর অবজারভার পত্রিকার রিপোর্টিং টিমে যোগদানের আদেশ। এই রোমাঞ্চকর অবস্থার মধ্যেও দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়ি। কারণ মূসাভাই তখন জাঁদরেল বার্তা সম্পাদক। অফিসে শুধু তাঁর গলার আওয়াজ শুনলেই আমরা যারা নতুন, ভয়ে তাঁর দিকে তাকাতেও পারতাম না। তাই যখন অবজারভার-এর ম্যানেজিং এডিটর মাহবুবুল হক আমাকে রিপোর্টিংয়ে যোগ দিতে বললেন, তখন দ্বিধায় পড়ে গেলাম। ভাবলাম, তাঁর রক্তচক্ষুর সামনে দাঁড়াতেই পারব কিনা সংশয় রয়েছে, রিপোর্ট লিখব কেমন করে? কিন্তু মাহবুব ভাই মূসাভাইকে ডাকলেন। বললেন, ‘রিয়াজ অর্থনৈতিক বিষয়ে রিপোর্ট করবে। তোমাকে সে ভয় পায়, ওকে কিছু বলো না।’ মূসাভাই চোখ বড় বড় করে কটমট করে তাকালেন। তবে কিছুই বললেন না।
মরহুম শহীদুল হক, এনায়েতউল্লাহ খান (হলিডে), আতাউস সামাদ, আবদুর রহিম টাইপরাইটারের সামনে। ডেস্কে বসে আছেন মূসাভাই, কে জি (মুস্তাফা) ভাই; ভয়ে টাইপরাইটার চলে না। এর মধ্যে মূসাভাই কাছে এলেন, কী রিপোর্ট করতে হবে বললেন, আরও কিছু নির্দেশ দিলেন—কী সাইজের কাগজে টাইপ করতে হবে, কীভাবে রিপোর্ট শুরু করতে হবে—শিক্ষকের মতো এসব বলে চলে গেলেন। কাজ করতে গিয়ে দেখি, সে এক অন্য মূসাভাই, যাঁর ছিল সাংবাদিকতায় অভিজ্ঞতা আর পাণ্ডিত্য গভীর, প্রখর নিউজ সেন্স, আর সহকর্মীদের জন্য মমত্ববোধ। অনেক ঘটনার মধ্যে একটা ঘটনার উল্লেখ করলেই বোঝা যাবে তাঁর সাহসের পরিধি। মহাপ্রলয়ের বছর। ১৯৭০ সাল। ঘূর্ণিঝড় আর জলোচ্ছ্বাসে উপকূলীয় অঞ্চলে লাখ লাখ লোকের মৃত্যু। মূসাভাই বললেন, ব্রিটিশ রয়্যাল নেভির হেলিকপ্টারে আমাকে পটুয়াখালী যেতে হবে। পরদিন সকালে পটুয়াখালী হয়ে চর বাইসদিয়ার ওপারে গভীর সমুদ্রে ব্রিটিশ রণতরী এইচএমএস ইনট্রিপিডে গেলাম। ওই যুদ্ধজাহাজেই হেলিকপ্টার অবতরণ করে। ওই জাহাজে হাজার হাজার যানবাহন, রাবার ডিঙি আর সেনা ত্রাণকাজে নিয়োজিত। সন্ধ্যায় অফিসে ফিরে লিখতে বসলাম। সেনা জনসংযোগ বিভাগ থেকে ফোন। মেজর সালেক সিদ্দিকী (২৫ মার্চ, ’৭১-এ ঢাকায় ছিলেন এবং নয় মাস সব অভিজ্ঞতার ওপর উইটনেস টু সারেন্ডার বই লেখেন) বললেন রিপোর্টটি কীভাবে লিখতে হবে। কারণ তিনি জানতেন, রিপোর্টে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ত্রাণকাজের সমালোচনা করা হবে। মূসাভাইকে আমি মেজর সালেকের নির্দেশের কথা বললাম। তিনি সঙ্গে সঙ্গে ফোন তুলে মেজর সালেককে বললেন, ‘নাক গলাবেন না।’ ১৯৭১-এর ২৫ মার্চের পর অবশ্য সব বদলে যায়। সালেক সিদ্দিকীদের কথায়ই তখন সব চলত। কিন্তু মূসাভাই তাঁর কথায় চলতেন না। অবশ্য তখনকার অবস্থায় তা প্রতিহত করাও ছিল দুরূহ ব্যাপার। জুন মাসের কোনো এক সময় মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়ার জন্য তিনি দেশ ত্যাগ করেন। আমিও ঢাকা ছেড়ে চলে যাই।
মূসাভাইয়ের সংবাদ পরিবেশনায় অসংখ্য মুনশিয়ানার আরেকটি উদাহরণ দেব। ষাটের দশকে পাকিস্তান অবজারভার ছিল আইয়ুব শাহীর ত্রাস। সারা পাকিস্তানে এই কাগজের প্রভাব ছিল অনেক। সেই কাগজের নিউজ এডিটর মূসাভাই। তখন শুনতাম, পাকিস্তানে যে কয়জন তুখোড় নিউজ এডিটর ছিলেন, মুসাভাই ছিলেন তাঁদের একজন। দ্রুততার সঙ্গে কপি এডিটিং, চমকপ্রদ হেডিং আর রিপোর্ট এডিটিং ছিল দেখার মতো। একটি হেডিং আমার আজও মনে আছে। একজন লোক ৫০ টাকা দিয়ে টিকিট কাটলেন, গন্তব্যে গেলেন। তিনি সেখানে মারা যান। লাশ আনতে একই উড়োজাহাজ দাবি করল কয়েক শ টাকা ভাড়া। মূসাভাই হেডিং দিলেন ‘জীবিতের চেয়ে লাশের মূল্য বেশি’। আবার ১৯৭০ সালের নির্বাচনে কে কত বড় বাঙালি, তা প্রমাণ করার প্রতিযোগিতা। এর মধ্যে একজন রিপোর্ট করলেন—খাজা খয়ের উদ্দিন বক্তৃতায় বলেছেন, ‘কোন বোলতা হামি বাঙ্গালি না, হামি ভি বাঙ্গালি আছে।’ মূসাভাই কপিটি এডিট করে খাজা খয়ের উদ্দিনের এ কথাটি বাংলায় ইংরেজির ভেতরে পাঞ্চ করে দিলেন। তাঁর সম্পাদনার এই মুনশিয়ানা, কৌশলী পরিবেশনা সেই সময়ে ছিল আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। এ ধরনের আরও অনেক মজার ঘটনা আছে মূসাভাইকে নিয়ে।
যার রক্তচক্ষুর ভয়ে রিপোর্টার হতে চাইনি, সেই মূসাভাইকে পাই বড়ভাই, সাংবাদিকতার গুরু আর একজন অকৃত্রিম সুহূদ হিসেবে। তাঁর সঙ্গে মেশার জন্য বয়স কোনো বাধা নয়। ৮০ বছর বয়সে পা দিয়েও প্রেসক্লাব মাতিয়ে রাখেন। ছোটবড় সবার সঙ্গে আড্ডায় মেতে ওঠেন। তিনবার তিনি প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ও চারবার সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়। ক্লাব তাঁকে আজীবন সদস্য পদের সম্মাননা দিয়েছে।
মূসাভাই রাজনৈতিক ও গোষ্ঠীগত সংকীর্ণ পরিচয়ের ঊর্ধ্বে উঠে ‘সবার মূসাভাই’ হতে পেরেছেন। দলমতের ঊর্ধ্বে উঠে রাজনৈতিক অঙ্গনের সকল দলের সমর্থক ও নেতা-নেত্রীর সমান শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, সন্মান এবং সবার কাছে সমান গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছেন ও পাচ্ছেন। তাই তাঁর অবস্থান এখন মুরব্বির আসনে। আর আমাদের সাংবাদিকদের কাছে তিনি হয়ে আছেন শুধু প্রিয় মূসাভাই, নির্ভীক ও আদর্শবাদী সাংবাদিকতার আদর্শবান অভিভাবক। আশিতে পা-দেওয়া আমাদের মূসাভাই দীর্ঘজীবী হোন।

রিয়াজউদ্দিন আহমেদ: দৈনিক নিউজ টুডে-র সম্পাদক।

http://www.noakhaliweb.com.bd
২টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আরো একটি সফলতা যুক্ত হোলো আধা নোবেল জয়ীর একাউন্টে‼️

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৮:৪০



সেদিন প্রথম আলো-র সম্পাদক বলেছিলেন—
“আজ শেখ হাসিনা পালিয়েছে, প্রথম আলো এখনো আছে।”

একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে আজ আমি পাল্টা প্রশ্ন রাখতে চাই—
প্রথম আলোর সম্পাদক সাহেব, আপনারা কি সত্যিই আছেন?

যেদিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

হামলা ভাংচুর অগ্নিসংযোগ নয়, আমরা শান্তি চাই

লিখেছেন নতুন নকিব, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১০:১১

হামলা ভাংচুর অগ্নিসংযোগ নয়, আমরা শান্তি চাই

ছবি এআই জেনারেটেড

হামলা ভাংচুর অগ্নিসংযোগ প্রতিবাদের ভাষা নয় কখনোই
আমরা এসব আর দেখতে চাই না কোনভাবেই

আততায়ীর বুলেট কেড়ে নিয়েছে আমাদের হাদিকে
হাদিকে ফিরে পাব না... ...বাকিটুকু পড়ুন

তৌহিদি জনতার নামে মব সন্ত্রাস

লিখেছেন কিরকুট, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১১:৫৪




ছবিঃ অনলাইন থেকে সংগৃহীত।


দেশের বিভিন্ন স্থানে সাম্প্রতিক সময়ে ধর্মের নাম ব্যবহার করে সংঘটিত দলবদ্ধ সহিংসতার ঘটনা নতুন করে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। বিশেষ করে তৌহিদি জনতা পরিচয়ে সংঘবদ্ধ হয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুখ গুজে রাখা সুশীল সমাজের তরে ,,,,,,,,

লিখেছেন ডঃ এম এ আলী, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৪:০৫


দুর্যোগ যখন নামে আকাশে বাতাশে আগুনের ধোঁয়া জমে
রাস্তা জুড়ে কখনো নীরবতা কখনো উত্তাল প্রতিবাদের ঢেউ
এই শহরের শিক্ষিত হৃদয়গুলো কি তখনও নিশ্চুপ থাকে
নাকি জ্বলে ওঠে তাদের চোখের ভেতর নাগরিক বজ্র
কেউ কেও... ...বাকিটুকু পড়ুন

নজরুল পরিবারের প্রশ্ন: উগ্রবাদী হাদির কবর নজরুলের পাশে কেন?

লিখেছেন মাথা পাগলা, ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৩:০১



প্রায় অর্ধশতাব্দী আগে কাজী নজরুল ইসলামের দেহ সমাধিস্থ করা হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদের পাশে। শনিবার বাংলাদেশের স্থানীয় সময় বিকেল ৪টে নাগাদ সেখানেই দাফন করা হল ভারতবিদ্বেষী বলে পরিচিত ইনকিলাব মঞ্চের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×