somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

এ্যালবাম রিভিউ- নস্টালজিক

২১ শে এপ্রিল, ২০১৫ দুপুর ২:২৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


ছেলেবেলায় আমাদের একটা সস্তা কি-বোর্ড ছিলো সাথে যদি একটা মাউথ অর্গান জুটে যায় তো কেল্লা ফতে! আমি আর আমার কাজিন রানা ভাইয়া (ব্লগের নস্টালজিক) একটা টুইন ওয়ান আর ব্ল্যাঙ্ক ক্যাসেট যোগাড় করে নিজেদের লিরিকে অথবা পত্রিকার সাহিত্য পাতা থেকে কবিতা নিয়ে সুর করে গান বাঁধতাম, সাথে ছিলো কি বোর্ড আে মাউথ অর্গানের যথেচ্ছ ব্যবহার! । সেই ব্ল্যাঙ্ক ক্যাসেটগুলি কোথায় হারিয়ে গিয়েছে! তবে স্বপ্ন হেরে যায় নি। নিজেদের একটা ব্যান্ড! রানা ভাইয়া তার নতুন-পুরাতন বন্ধুদের সাথে এক হয়ে গান কম্পোজ করা শুরু করলো। প্রচুর পরিশ্রম আর প্রতিকূলতা পার করে এখন তার নিজস্ব এ্যালবাম বের হলো অবশেষে। এই এ্যালবামটি এত আপন মনে হয় আমার! যেন আমি নিজেই এই ব্যান্ডের একজন সদস্য! এ্যালব্যামটিতে নাগরিক জীবনের ক্লান্তি, ঘটনা-দুর্ঘটনা, জীবন যাপনের ক্লেশ ছাড়াও অসম্ভব সুন্দর কিছু রোমান্টিক গান লিখেছেন রানা। একটি মাত্র গানের লিরিক কেবল স্বদেশ হসনাইনের।গানগুলি হলো-

১।পোড়া শহর- নিমতলীর কথা মনে আছে? সেই যে ২০১০ সালে ভয়াবহ এক অগ্নিকাণ্ডে ১২৫ জন মানুষ প্রাণ হারালো? এই গানটি সেই নিমতলী ট্রাজেডিকে নিয়েই গাওয়া হয়েছে। পোড়া শহরে একজন কবির অনুভূতি কেমন হতে পারে? সে কি এমন রাতে ব্যস্ত ছিলো তার কবিতার খাতায় নতুন কোনো পঙক্তি লিখতে? বারবার লিখতে গিয়ে কাগজ ছিড়ে ফেলা। পোড়া শহরের উত্তাপ খুব কাছ থেকে অনুভব করলেও সেখানে যাওয়া হয় না তার। বুকের মাঝে পাষাণ ভার চেপে রেখে সেই মেয়েটার কথা ভাবে সে, যার ওদিন ছিলো গায়ে হলুদ। সেই হলুদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো আরেকটি হলুদ, আগুনের লেলিহান শিখা। পোড়া শহরের এমন অনেক ছোট ছোট গল্প গানটিকে বিষাদে ভারাক্রান্ত করেছে। শেষ দিকে গায়কের স্বকণ্ঠে আবৃত্তি গানটিকে অন্য মাত্রা দিয়েছে।

২। তোমার কি আর দু:খ পেলে চলে- নিমতলীর ট্রাজেডি বুকের মদ্যে গেড়ে থাকবে অনেকক্ষণ। তাই শ্রোতাকে একটু রিলিফ দেয়ার জন্যে চমৎকার একটা রোমান্টিক গান। গানটির কথা লিখেছেন রানা, সুর ও সঙ্গীত বনি। লিরিকটা অসম্ভব সুন্দর। সুরটাও চমৎকার। প্রতিটি মানুষের কাছেই একজন না একজন কেউ বিশেষ থাকবেই। যার কাছে আমরা আশ্রয় পেতে পারি, মন খারাপ হলে কথা বলে হালকা হতে পারি। এই গানের 'তুমি'টা সেরকমই একজন? তার কি আর দুঃখ পেলে চলে? তার জন্যে রয়েছে মেদুর আকাশ, সবুজ বৃক্ষ, শান বাঁধানো পুকুর ঘাট। দু:খবতীর যাবতীয় বেদনা মুছে দিতে প্রকৃতি এক মহা আয়োজনের ব্যবস্থা করেছে। তুমি মানুষ নও, তুমি দেবী। পৃথিবীর যাবতীয় পাপ আর পঙ্কিলতা তোমার কাছ থেকে দূরে থাকুক। তুমি হয়ে ওঠো বিজয়ীনির বেশে ঋজু হয়ে দাঁড়িয়ে সকল দুঃখের পরিত্রাতা। অবশ্য তোমার সাথে কখনও দেখা হবে কী না তাও জানি না। তারপরেও কোন এক ধূসর সন্ধ্যায় বিষণ্ণ মনে হয়তো দেখবো তোমাকে দূর থেকে, হাসছো।

৩/স্যাটেলাইট- স্যাটেলাইট গানটি আগের দুটো গানের চেয়ে একদম ভিন্ন। পার্শবর্তী রাষ্ট্রের মোড়লীপনা, আর আমাদের কাঙালপনা নিয়ে এক দুর্দান্ত স্যাটায়ার। গানটির প্রথমে প্রায় চল্লিশ সেকেন্ড দীর্ঘ একটি লিড সওলো আছে। সুন্দর। এই গানে রয়েছে ভারতীয় ডেইলী সোপ প্রজন্মের প্রতি তীব্র ক্ষোভ আর শ্লেষ। গানের লিরিকটা বেশ সাহসী বলতে হবে। এই কর্পোরেট মাফিয়াদের যুগে তাদের বিরুদ্ধাচরণ করে গান বাঁধাকে অভিনন্দন না জানালেই নয়। মাঝখানে তো একটা বিধ্বংসী লাইন আছে! "মানিক মিয়া এ্যাভিনিউতে হাসছে গোপাল ভাড়"। মানিক মিয়া এভিনিউয়ে আমাদের মাননীয় সাংসদেরা দেশ উদ্ধার করে ফেলেন, আর তাদের কর্মকাণ্ড দেখে গোপাল ভাঁড় না হেসে পারে না। গানটার লিরিক দৈর্ঘ্যে অনেক বড়। সেই তুলনায় ভেরিয়েশন নাই গানে। প্রথম অংশটুকু দারুণ ক্যাচি, কিন্তু শেষ লাইন পর্যন্ত প্রায় একই রকম সুরে গেয়ে যাওয়াটা শ্রোতাকে বোরড করে দিতে পারে।

৪। গুচ্ছ ঘাসের সবুজ- এত এত ভালো গানের মধ্যে এই গানটি কেমন একটু ম্রীয়মাণ লাগতে পারে প্রথম দিকে। শুরুটা বেশ বোরিং। তবে কোরাসে আসার সময় নিজেকে ফিরে পেয়েছে গানটি। সব মিলিয়ে বেশ ভালো গান।

৫। গেটলক সার্ভিস- চমৎকার ব্লুজ স্টাইলে গানটার শুরু। নিঃসন্দেহে এ্যালবামের সবচেয়ে অন্যরকম গান। পুরো লিরিকটাই একটা গল্পের মতো। গেটলক সার্ভিস বাসে উঠে একজনের আধো ঘুম, আধো তন্দ্রায় নাগরিক ক্লেশকে ভুলে যাওয়া, যেখানে টিয়াপাখি টিকেট চেকিং করে, মানুষে ঠাঁসা বাসে তার মেঘের দেশে যেতে ইচ্ছে করে। ঘুমের মধ্যে চমৎকার একটা সুররিয়াল যাত্রা। কিন্তু আমাদের নাগরিক সংবিধান অনুযায়ী বাসের ভেতরে সুখকল্পনায় মজে থেকে তন্দ্রালু ভাব আনয়ন রীতিমত ক্রাইম! গানটার শেষে একটা মজার টুইস্ট আছে। সেটার কথা নাই বা বললাম। সিডি কিনে শুনেন!

৬। ঘুমায় শহর- আমার মতে এই এ্যালবামের সেরা গান। সেরা হবে নাই বা কেন? এই গানটির সাথে জড়িত আছে তিনজন প্রতিভাবান কবি/সুরকার। গানটির লিরিক লিখেছেন প্রখ্যাত ব্লগার স্বদেশ হাসনাইন। তার লিরিকের ব্যাপারে নতুন করে কিছু বলার নেই। অসাধারণ। সুর করেছেন কবি অমিত চক্রবতী। গানটি একবার শুনলে সাধ মেটে না, বারবার শুনতে হয়। ঘুমন্ত শহরের দৃশ্যকল্প মনের মধ্যে ত্রিমাত্রিক ছবির মত করে ধরা দেয়,

৭। আমি যখন স্বপ্ন দেখি- এই গানটিতেও অমিত সুর করেছেন, সাথে রানা ভাইয়া তো আছেই! অদ্ভুত সুন্দর একটা মেলোডিয়াস গান। একজন স্বপ্নবাদী, যার স্বপ্নে আকাশটা হয় হাওয়াই মিঠাই রঙ। রাতের গোপন উৎসবে জোনাকপোকাদের মাতাল অনুভব, নানা রঙের ফুলের পুষ্পবিহার; এক অপার্থিব সুন্দর জগৎ। আপনাকে এই জগতে স্বাগতম পাঠক!

৮। প্রহরীর মত রাত-গানটায় একটা সাইকোডেলিক আবহ আছে। মিউজিক কম্পোজিশনে তেমন ভারভারিক্কি নেই। পুরো গানে কিবোর্ড একরকমভাবে বাজানো হয়েছে। পিয়ানোর টুংটাং এর মতো। মাঝেমধ্যে গিটারের সফট রক স্টাইলে প্লাকিং। গানটা বেশ ভালো, তবে প্রথম প্রথম শুনতে বোরিং লাগতে পারে। ধীরে ধীরে গানটার ভেতর ঢুকে গেলে গানটি অবশ্যই ভালো লাগবে।


৯। রোদ হয়ে ছুঁই- আরো একটি অসম্ভব সুন্দর মেলোডিয়াস গান। এই গানের সবকিছুই সু্ন্দর। মিউজিক, হামিং, লিরিক, ব্যাকভয়েস, সুর, গায়কী সব অসাধারণ। এ্যালবামের সেরা গানের তালিকা করতে গেলে "ঘুমায় শহর"এর সাথে এটার হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে।

১০। বর্ষা অনুভূতি-বাংলাদেশে বাস করে অথচ বৃষ্টি পছন্দ করে না এরকম কাউকে পাওয়া দুষ্কর। নস্টালজিক ব্যান্ডও তার ব্যতিক্রম নয়। বর্ষার অনুভূতিকে শুধু নিজের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে কৃষ্ণচূড়া ফুল, বৃষ্টির আবাহনে সবুজ হয়ে যাওয়া গাছের পাতা, মেঘের পোষাক, আশ্রয়ের খোঁজে উড়ে বেরানো পাখি এবং উদাস পাহাড়ের সাথে বর্ষা অনুভূতি ভাগাভাগি করে নেয়া হয়েছে।

সব মিলিয়ে চমৎকার একটা এ্যালবাম। দয়া করে সিডি কিনুন, অডিও শিল্পকে বাঁচান।
১১টি মন্তব্য ১১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

দিশ হারা

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২১ শে মে, ২০২৪ সকাল ১০:২২

তোয়াত্তন আ`‌রে কেন লা‌গে?
গম লা‌গে না হম লা‌গে?
রাই‌ক্কো আ‌রে হোন ভা‌গে
ফেট ফু‌রে না রাগ জা‌গে?

তোয়া‌রে আত্তন গম লা‌গে
ছটফড়াই আর ডর জাগে
ছেত গরি হইলজা ফাড়ি
হইবানি হোন মর আগে।

হোন হতার হোন ইশারা
ন'বুঝি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। VF 3 Mini: মাত্র 60 মিনিটে 27 হাজার বুকিং!

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২১ শে মে, ২০২৪ দুপুর ১২:০৪



আমার ব্যাক্তিগত গাড়ি নেই কিন্তু কর্মসূত্রে বেঞ্জ , ক্যাডিলাক ইত্যাদি ব্যাবহার করার সুযোগ পেয়েছি । তাতেই আমার সুখ । আজ এই গাড়িটির ছবি দেখেই ভাল লাগলো তাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

খাদ্য পন্যের মান নিয়ন্ত্রন

লিখেছেন ঢাবিয়ান, ২১ শে মে, ২০২৪ দুপুর ১২:১২

মশলা প্রস্তুতকারী কিছু ভারতীয় সংস্থার মশলায় ক্যানসার সৃষ্টিকারী উপাদান পাওয়া গিয়েছে।সম্প্রতি এমনই তথ্য প্রকাশ্যে এনেছে আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘সেন্টার ফর ফুড সেফটি’। সংস্থা জানিয়েছে, ভারতীয় বাজারে জনপ্রিয় বেশ কিছু সংস্থার মশলায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

ময়লাপোতার কমলালেবুর কেচ্ছা!! (রম্য)

লিখেছেন শেরজা তপন, ২১ শে মে, ২০২৪ বিকাল ৫:১৩


বাংলাদেশের বিশেষ এক বিভাগীয় শহরে ময়লাপোতা, গোবরচাকা, লবনচোরা, মাথাভাঙ্গা, সোনাডাঙ্গার মত চমৎকার সব নামের এলাকায় দারুণ সব সম্ভ্রান্ত পরিবারের বাস।
আমার এক বন্ধুর আদিনিবাস এমনই এক সম্ভ্রান্ত এলাকায় যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

সাময়িক পোস্ট: বন্ধ হয়ে গেল সচলায়তন

লিখেছেন করুণাধারা, ২১ শে মে, ২০২৪ রাত ৯:৩৭


বন্ধ হয়ে গেল সচলায়তন! view this link

সামহোয়্যারইনব্লগ থেকে কয়েকজন ব্লগার আলাদা হয়ে শুরু করেছিলেন সচলায়তন বা সংক্ষেপে সচল ব্লগ। এটি বন্ধ হবার মূল কারণ উল্লেখ করা হয়েছে দুটি:

১)... ...বাকিটুকু পড়ুন

×