somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কথাচ্ছলে মহাভারত - ৯৪

০৬ ই জুলাই, ২০১৫ সকাল ১১:০৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

[পূর্বকথা - পঞ্চ পান্ডবের সঙ্গে দ্রৌপদীর বিবাহ হলে দুর্যোধনরা ক্রুদ্ধ হয়ে তাদের হত্যার পরিকল্পনা করতে থাকে....কিন্তু ভীষ্ম, বিদুর ও কৃপাচার্যের সৎ বুদ্ধিতে ধৃতরাষ্ট্র তাদের স্বিকার করতে বাধ্য হন... বিদুর গিয়ে পঞ্চপাণ্ডবকে দ্রৌপদী সহ যত্ন করে নিয়ে এলেন... ইন্দ্রপ্রস্থে কৃষ্ণের সহায়তায় পঞ্চপাণ্ডবরা অবস্থান করতে লাগলেন... ]


সুন্দ-উপসুন্দের বিবরণ ও পান্ডবদের দ্রৌপদী সম্বন্ধে নিয়ম নির্দ্ধারণঃ

জন্মেজয় মুনিকে প্রশ্ন করেন –পাঁচভাই এক স্ত্রীকে নিয়ে কিভাবে সংসার ধর্ম করতেন। তাদের মধ্যে কি বিরোধ হত না!
মুনি বলেন –নরপতি সাবধানে শুনুন।
পাঁচভাই যখন ইন্দ্রপ্রস্থে বাস শুরু করছেন তখন একদিন নারদমুনি সেখানে উপস্থিত হলেন। কৃষ্ণসহ পান্ডবরা তাঁর শ্রীচরণ পূজা করলেন। ছয়জন করযোড়ে দাঁড়ালেন। মুনি তাদের বসার আজ্ঞা দিলেন।

নারদ বলেন –হে পান্ডুর পুত্ররা, আপনারা পাঁচজন এবং আপনাদের একজন স্ত্রী। ভায়ে ভায়ে এতে বিরোধ হতে পারে। পূর্বেও এমন হয়েছে। সুন্দ ও উপসুন্দ নামে দুই ভাই ছিল স্ত্রীর কারণে দুইজন যুদ্ধ করে মরল।

যুধিষ্ঠির বলেন –মুনিবর বলুন কেন দুই সহোদর যুদ্ধ করেছিল।

নারদ বলেন –কশ্যপমুনির দুই পুত্র হিরণ্যকশিপু ও হিরণ্যাক্ষ। এই হিরণ্যাক্ষ দৈত্যবংশে নিকুম্ভ অসুরের জন্ম। তার সুন্দ-উপসুন্দ নামে দুই পুত্র হয়। এরা পরস্পরের প্রতি অত্যন্ত অনুরক্ত ছিল। এক সাথে সব কাজ করত। এরা অসুর কুলেও শ্রেষ্ঠ মহাভয়ঙ্কর রূপে দেখা দেয়। দুই ভাই এক বাক্য, একই জীবন। অল্প সময়ের জন্যেও তারা পরস্পরের থেকে বিচ্ছিন্ন হয় না।
দুজনে মিলে তারা যুক্তি করল তপোবলে ত্রৈলোক্য অধিকার করবে। বিন্ধ্যপর্বতে গিয়ে মহা তপস্যা শুরু করল। বহু বৎসর কেবল বায়ু আহার করে তপস্যা করে গেল। অনাহারে বহু তপ করল দুজনে। এত কষ্ট সহ্য করল যে তা বলে বোঝান যায় না। তাদের এই কঠোর তপ দেখে পিতামহ ব্রহ্মা তাদের বর দিতে চাইলেন।
দুই ভাই বলে –আমাদের অমর কর।

বিবিঞ্চি(ব্রহ্মা) বলেন –তোমরা অন্য বর চাও।

দুই ভাই বলে –আমরা অন্য বর চাই না। যবে এই বর পাব তবেই তপস্যা ত্যাগ করব।


বিধাতা বলেন –জন্ম হলে মরণ হবেই। মৃত্যুর ব্যাপারে কিছু চাইতে পার।

দৈত্যরা বলে –পরহস্তে যেন আমাদের মৃত্যু না হয়, নিজেদের মধ্যে বিভেদ হলেই যেন পরস্পরের হাতে আমাদের মৃত্যু হয়।


ব্রহ্মা -“স্বস্তি” বলে বর দিয়ে গেলেন। সুন্দ–উপসুন্দও আনন্দ মনে নিজেদের গৃহে গেল।
ত্রৈলোক্য জয় করার উদ্দেশ্যে তারা সৈন্য সাজাল। নানা অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে তারা সুরপুরে(স্বর্গ) গেল। দেবলোকে সকলে ব্রহ্মার বরের কথা জানত তাই ভয়ে যুদ্ধ না করেই অমরাবতী ছেড়ে পালাল।
ইন্দ্রপুরে ইন্দ্রত্ব করতে লাগল দুই ভাই-সুন্দ ও উপসুন্দ। যক্ষ, রক্ষ, গন্ধর্ব, নাগলোক সব জয় করল, সবাই এই দুই দৈত্যের ভয়ে পালাতে লাগল।
দ্বিজমুনিরা যজ্ঞ-হোম-ব্রত করলে দুই ভাই উপস্থিত হয়ে তা পন্ড করত। দেবকন্যা, নাগকন্যা, অপ্সরী, কিন্নরী ত্রৈলোক্যে যত অপূর্ব সুন্দরী ছিল সবাইকে অপহরণ করে নিজেদের ঘরে নিয়ে আসত। যখন যেখানে ইচ্ছে বিহার করতে থাকে। সব দেবতাদের বাহন, ভূষণ, অলঙ্কার ছিনিয়ে নিজেদের ভান্ডার পূর্ণ করতে থাকে।

এভাবে স্থানভ্রষ্ট হয়ে দেবতা ও ঋষিরা ব্রহ্মার কাছে উপস্থিত হলেন।
সব শুনে ব্রহ্মা কিছুক্ষণ চিন্তা করে বিশ্বকর্মাকে বললেন –আপনি মনোহরা এক নারী রচনা করুন। তার তুলনা যেন এ ত্রিভূবনে না হয়।

তখনই বিচক্ষণ বিশ্বকর্মা বিধাতার আজ্ঞা পেয়ে ত্রৈলোক্যে যত রূপবন্ত ছিল তাদের সর্ব রূপ থেকে তিল তিল নিয়ে এক অপূর্ব সুন্দরী নারী রচনা করলেন। ব্রহ্মার সামনে তাকে উপস্থিত করা হল। দেবতারাও কন্যাকে দেখে মুগ্ধ হলেন। কন্যার অঙ্গের যেখানে দৃষ্টি পরে সেখানেই চক্ষুস্থির হয়।



ব্রহ্মা বলেন –এর রূপের সীমা নেই। তিলে তিলে গড়ে তুললেন তাই এর নাম হল তিলোত্তমা।

তখন কন্যা ব্রহ্মার সামনে হাতযোড় করে বলেন –কি করতে হবে আমায় আজ্ঞা করুন।

বিরিঞ্চি(ব্রহ্মা) বলেন –সুন্দ-উপসুন্দ দুই দৈত্য তপোবলে ত্রিভুবন জয় করে সবার উপর অত্যাচার করছে। তাদের মধ্যে ভেদ হলেই তারা পরস্পরকে হত্যা করবে। তুমি কোন উপায় তাদের মধ্যে বিরোধ ঘটাও।

ব্রহ্মার আজ্ঞা পেয়ে সুন্দরী তিলোত্তমা প্রণাম জানিয়ে তাকে প্রদক্ষিণ করলেন। কন্যা দেখে মোহিত হলেন ত্রিলোচন, কন্যা যেদিকে যায় সে দিকেই মুখ রয়। এভাবে দেখতে দেখতে চারদিকে তাঁর চারটি মুখ হয়। এভাবে পূর্বসহ মৃত্যুঞ্জয়ের পাঁচটি মুন্ড হল।
পুরন্দর(ইন্দ্র) কামে পীড়িত হয়ে কন্যাকে দেখতে লাগলেন। তার শরীরে দশশত চক্ষু হল।
অন্য দেবতারাও একদৃষ্টে কন্যাকে দেখতে থাকেন। সকল দেবতা বলতে থাকে –এবার কার্যসিদ্ধি হবে। এনাকে দেখে কোনজন না ভুলবে।



তখন তিলোত্তমা যেখানে দুই ভাই সুন্দ-উপসুন্দ স্ত্রীদের নিয়ে ক্রীড়া করছে সেখানে উপস্থিত হলেন।
কোটি কোটি দৈত্য নিয়ে তাদের পরিবার। অশ্ব, গজ, রথ, সৈন্যে পূর্ণ ভান্ডার। লক্ষ লক্ষ বিদ্যাধরী নিয়ে দুজনে বিন্ধ্যপর্বতে হৃষ্ট মনে ক্রীড়ায় মত্ত।
রক্তবস্ত্র পরে তিলোত্তমা সেখানে উপস্থিত হলেন। সে পর্বতের উপর পুষ্প চয়ন করতে লাগলেন। তাকে দেখে দৈত্য ভাইরা ধিরে ধিরে তার কাছে উপস্থিত হল। সুন্দ-উপসুন্দ তখন মধুপানে মত্ত ছিল। সুন্দরী কন্যা দেখে শীঘ্র তাকে পেতে উদ্যত হল।
জ্যেষ্ঠ সুন্দ কন্যার সব্যকর(ডানহাত) ধরল। বামহাত ধরল কনিষ্ঠ উপসুন্দ। সুন্দ কন্যাকে নিজের কাছে ডাকতে লাগল।

সুন্দ বলে –ভাই, কন্যার হাত ছাড়। আমার ভার্য্যা তোর গুরুজন হবে। তাকে তুই কিভাবে ধরিস!

উপসুন্দ বলে –একে আমি বরণ করেছি। তুমি ভাতৃবধুর হাত ছার।

সুন্দ বলে –আগে আমি কন্যাকে দেখেছি।

উপসুন্দ বলে –কন্যা আমাকে আগে বরণ করেছে।

এভাবে ‘ছাড়, ছাড়’ বলে দুজনে দুজনকে গালাগাল দিতে থাকে। দুজনে পরস্পরকে ক্রুদ্ধ ভাবে দেখতে থাকে। সুরামধু পান করে ও কামবাণে তারা হিতাহিত জ্ঞান হারাল। পরস্পরের প্রতি অগ্নিসম ক্রোধিত হল। দুজনেই পরস্পরকে মারতে ভয়ঙ্কর গদা তুলে পরস্পরকে প্রহার করতে লাগল। দেখে মনে হল দুই পর্বতের যুদ্ধ হচ্ছে। শেষে যুগল মিহির(সূর্য)যেন প্রাণত্যাগ করে খসে পরল।
আর যত দৈত্যরা ছিল তারা এসব দেখে কন্যাকে কালরূপা বুঝে সেখান থেকে পালাল।

দেবতাদের নিয়ে ব্রহ্মা সেখানে উপস্থিত হলেন।
ব্রহ্মা তিলোত্তমাকে আশীর্বাদ করে বর দিলেন –সূর্যের কিরণে তুমি চিরকাল থেক। কারো দৃষ্টি তোমার অঙ্গে আর পরবে না। তোমার কারণে তপ, যজ্ঞ ভঙ্গ হবে। ধর্ম নষ্ট হবে লোকে তোমার দর্শনে। সেই জন্য সূর্যের রশ্মির মধ্যে তুমি থেক।
এই বলে ব্রহ্মা চলে গেলেন।

উপাখ্যান শেষ করে নারদ বলেন –শুনুন ধর্মপুত্র মহারাজ যুধিষ্ঠির, আপনারা পাঁচভাই পরস্পরের প্রতি অতি প্রীত, যেমন ছিল সুন্দ-উপসুন্দ। তাদের মাঝেও কন্যাকে নিয়ে এমন পরিনতি হল।
আপনারা পাঁচজন মহাবংশে জন্মেছেন। আপনাদের মাঝে স্ত্রীকে নিয়ে যাতে ভেদ না হয় তা দেখুন।

সব শুনে পঞ্চপান্ডব নারদের সামনে যোড়হাতে প্রতিজ্ঞা বদ্ধ হলেন – কৃষ্ণা এক বছর একজনের গৃহে বাস করবেন। সেই সময় অন্যরা কেউ সেখানে প্রবেশ করবে না। সে সময় অন্য কোন ভাই যদি তাদের দেখেন তবে বার বছরের জন্য তাকে বনবাসে যেতে হবে।

এভাবে ব্রহ্মার পুত্র নারদ পঞ্চপান্ডবদের মধ্যে একটি নিয়ম স্থাপন করলেন। এভাবে দ্রৌপদীকে নিয়ে পঞ্চপান্ডব সুখে বাস করতে লাগলো।
...................................
উৎসর্গ: সকল ব্লগার বন্ধুকে
......................................
আগের পর্ব:

কথাচ্ছলে মহাভারত - ৯৩ Click This Link

সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই জুলাই, ২০১৫ সকাল ১১:২৭
৫টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। মুক্তিযোদ্ধা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১



মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তালিকা প্রণয়ন ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, ‘দেশের প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটি রয়েছে। তারা স্থানীয়ভাবে যাচাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতীয় রাজাকাররা বাংলাদেশর উৎসব গুলোকে সনাতানাইজেশনের চেষ্টা করছে কেন?

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:৪৯



সম্প্রতি প্রতিবছর ঈদ, ১লা বৈশাখ, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, শহীদ দিবস এলে জঙ্গি রাজাকাররা হাউকাউ করে কেন? শিরোনামে মোহাম্মদ গোফরানের একটি লেখা চোখে পড়েছে, যে পোস্টে তিনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

চুরি করাটা প্রফেসরদেরই ভালো মানায়

লিখেছেন হাসান মাহবুব, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৩


অত্র অঞ্চলে প্রতিটা সিভিতে আপনারা একটা কথা লেখা দেখবেন, যে আবেদনকারী ব্যক্তির বিশেষ গুণ হলো “সততা ও কঠোর পরিশ্রম”। এর মানে তারা বুঝাতে চায় যে তারা টাকা পয়সা চুরি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঘুষের ধর্ম নাই

লিখেছেন প্রামানিক, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫৫


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

মুসলমানে শুকর খায় না
হিন্দু খায় না গাই
সবাই মিলেই সুদ, ঘুষ খায়
সেথায় বিভেদ নাই।

হিন্দু বলে জয় শ্র্রীরাম
মুসলিম আল্লাহ রসুল
হারাম খেয়েই ধর্ম করে
অন্যের ধরে ভুল।

পানি বললে জাত থাকে না
ঘুষ... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইরান-ইজরায়েল দ্বৈরথঃ পানি কতোদূর গড়াবে??

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:২৬



সারা বিশ্বের খবরাখবর যারা রাখে, তাদের সবাই মোটামুটি জানে যে গত পহেলা এপ্রিল ইজরায়েল ইরানকে ''এপ্রিল ফুল'' দিবসের উপহার দেয়ার নিমিত্তে সিরিয়ায় অবস্থিত ইরানের কনস্যুলেট ভবনে বিমান হামলা চালায়।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×