somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কথাচ্ছলে মহাভারত - ১৪৪

০৭ ই মে, ২০১৭ সকাল ১১:৫৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

[পূর্বকথা - যুধিষ্ঠির কৃষ্ণের অনুমতি নিয়ে রাজসূয় যজ্ঞের আয়োজন করেন ....... যথাকালে যুধিষ্ঠির যথাযথ ভাবে যজ্ঞ সমাপন করলেন.....সকলকে যার যা যজ্ঞভাগ তা দান করে তুষ্ট করলেন.... ভীষ্মের পরামর্শে যুধিষ্ঠির সকলের শ্রেষ্ঠ কৃষ্ণের পূজা করতে গেলে চেদিরাজ শিশুপাল তীব্র প্রতিবাদ করে কৃষ্ণ নিন্দা করতে লাগল .....কিছু রাজারা শিশুপালের সঙ্গ দিল...... রাজা যুধিষ্ঠির শিশুপালকে শান্ত করতে চাইলেন..... ভীষ্ম শিশুপালের কৃষ্ণ নিন্দার বিরোধ করলেন .....শিশুপাল ভীষ্মকেও অপমান করতে থাকে.. ... ]



ভীষ্ম কর্তৃক শিশুপালের জন্মকথন ও শিশুপালের ক্রোধঃ

ভীষ্ম বলেন –চেদিরাজ দমঘোষের গৃহে শিশুপাল চারটি হাত ও তিন চোখ নিয়ে ভুমিষ্ট হয়েছিল এবং জন্মমাত্র গর্দভের মত চিৎকার করতে থাকে। এমন অদ্ভূত শিশু দেখে তার বাপ-মা কষ্ট পায়। তারা তখনই শিশুটিকে ত্যাগ করতে চায়।
তখন হঠাৎ শূন্য থেকে আসুরী বচনে বাণী আসে –শ্রীমন্ত বলিষ্ঠ হবে এই নন্দন। ভয় না পেয়ে একে পালন কর। এর অদ্ভূত গড়ন দেখে চিন্তিত হচ্ছে বটে তবে তার কারণও সাবধানে শুনে রাখ। সেই ব্যক্তি এর সংহার করবে যার স্পর্শে শিশুর হাত লুকাবে।

এদিকে চেদিরাজের চতুর্ভুজ সন্তান হয়েছে চারদিকে সে খবর ছড়াতে লাগল। বিভিন্ন রাজ্যের রাজারা সেই শিশু দেখতে আসতে লাগল। দশ-বিশজন রাজা প্রতিদিন এই পুত্রকে দেখতে আসে। দমঘোষও সবার কোলে পুত্রকে অর্পণ করতে থাকেন।

কিছুদিন পর সব ঘটনা শুনে রাম ও নারায়ণ সেই শিশুকে দেখতে চললেন। শিশুপালের জননী গোবিন্দ-কৃষ্ণের পিতৃস্বসা(পিসি)। তাদের দেখে পিসি খুব খুশি হলেন। অনেক আদর যত্ন করলেন যদুমণি কৃষ্ণ গোপালকে। নিজ সন্তানকে কৃষ্ণের কোলে দিলেন। তখনই শিশুটির দুটি হাত মাটিতে খসে পরে গেল এবং কপালের চোখটি অদৃশ্য হল।
তা দেখে শিশুপালের মা আতঙ্কিত হলেন। তিনি জোড়হাতে দেব দামোদর কৃষ্ণকে বলেন –হে কৃষ্ণ তুমি আমায় একটি বর দাও। আমি খুবই ভয় পাচ্ছি, দেখ আমার শরীর কাঁপছে। দয়া করে আমার এ ভয় ভেঙ্গে আমায় সুস্থ কর।

শ্রীকৃষ্ণ বলেন –হে মাতা, আপনি কিছু মাত্র ভয় পাবেন না, কি বর চান আজ্ঞা করুন।

মহাদেবী বলেন –আমায় এই বর দাও যে তুমি আমার পুত্রের একশত অপরাধ ক্ষমা করে দেবে। আমি বুঝতে পারছি এ তোমার প্রতি অনেক অন্যায় করবে। আমার কথা ভেবে একে ক্ষমা করে দিও, পুত্র!

কৃষ্ণ বলেন –মাতা, আপনার বচন আমি লঙ্ঘন করব না। এর একশত অপরাধ আমি ক্ষমা করব। তবে কেবল একশতবারই সে আমার ক্ষমা লাভ করবে। আপনার সামনে আমি প্রতিজ্ঞা করলাম।

এই মূঢ শিশুপালের দুই চোখ থেকেও সে আজও অন্ধ। গর্বে মত্ত হয়ে সে তোমায় যুদ্ধে ডাকছে। কিন্তু একে নাশ করা ভীম তোমার কাজ নয়। শ্রীকৃষ্ণ যবে থেকে প্রতিজ্ঞা করলেন, তবে থেকেই তার কিছু অংশ এর মধ্যে আছে। তাই এর সাথে তোমার যুদ্ধ করা উচিত নয়।
হে পুত্র ভীম, তুমি আমার জন্য কষ্ট পাচ্ছ। কিন্তু এ কুলাঙ্গারের কুবচনে দুঃখ পেওনা। এ শরীরে বিষ্ণুর কিছু অংশ পেয়ে আমাদের সকলকে তৃণবৎ মনে করে অপমান করে চলেছে। আমায় কেউ অপমান করার সাহস পায় না। এর গালি সহ্য করছি কেবল গোবিন্দের কথা ভেবে।

ভীষ্মের এত কথা শুনে চেদীশ্বর শিশুপাল উপহাস করে বলে –ভাল হয়েছে আমার শত্রু নন্দের নন্দন কৃষ্ণ। তুমি ভীষ্ম তার এত স্তুতি করছ, কারণ কি! অন্য কারো এত স্তুতি করলে তাদের কাছ থেকে অনেক কিছুই এতক্ষণে পেতে।
বাহ্লীক রাজার এত স্তুব করলে অনেক পুরস্কার পেতে।
মহাদাতা কর্ণবীরের স্তব করতে পারতে। ইনি জরাসন্ধকেও যুদ্ধে হারিয়েছেন। কর্ণের শ্রবণে কুন্ডল যা দেবের নির্মাণ, অভেদ্য কবচ অঙ্গে-যা সূর্যের মত দীপ্তিমান। এই অঙ্গ রাজ্যেশ্বর দানে অকাতর। সেই কর্ণের স্তুতি করলে ভাল বর পেতে পারতে।
এছাড়া দ্রোণদ্রোণি পিতাপুত্রও বিখ্যাত সংসারে। তাদের এত স্তব করলে তারা মুহূর্তে তোমার জন্য ভূমণ্ডল জয় করে দিত।
রাজাদের মধ্যে দুর্যোধন মহাবল, সাগরান্ত পৃথিবী এর করতলে।
ভগদত্ত, জয়দ্রথ, ভীষ্মক, দ্রুপদ, রুক্মি, দন্ডবক্র, মৎস্য, কলিঙ্গ, কামদ, বৃষসেন, বিন্দ, অনুবিন্দ, কৃপাচার্য-এদের এত স্তুতু করলে কিছু কার্য সিদ্ধি হত।
তোমার বুদ্ধিকে ধিক্কার, কি আর বলব তোমায়! হিমাদ্রিতে(হিমালয়) ভূলিঙ্গ পাখির মত তোমার চরিত্র। এই পাখির কথা লোকমুখে শুনেছি। সব পাখিদের সে উপদেশ দিয়ে বেরায় –সাহস ভাল না। বেশি সাহস দেখাতে গেলে দুঃখ পাবে। পাখিরাও খুব মন দিয়ে তার কথা শোনে। সেখানেই এক সিংহ আহার করে বিশ্রাম নেয়। ভূলিঙ্গ তার সামনে বসে থাকে, কখন সিংহ হাই তুলবে। সিংহের দাঁতের ফাঁকে ভক্ষ্য মাংস সে অতি দ্রুত খুটে খায়। নিজের এই কাজ আবার অন্যকে শিক্ষা দেয়! সে জানে না যে সিংহের কৃপায় তার জীবন রক্ষা পাচ্ছে। সিংহ সামান্য ইঙ্গিতেই মনে করলে ভূলিঙ্গকে মারতে পারে।
তেমনি এই সব রাজারা তোমায় এখনও ক্ষমা করে চলেছে। এরা ক্ষেপে উঠলে এখনই তোমায় যমের ঘরে পাঠাতে পারে।

এমন অসহ্য কটু কথা শুনে বীর ভীষ্ম অস্থির হয়ে কাঁপতে কাঁপতে বলেন – আরে মূর্খ, দুরাচার, ক্রুরমনা, কৃষ্ণ স্তুতি করছি বলে এত কথা শোনাচ্ছ! চতুর্বেদে চতুর্মুখে যার গুণ গায়, পঞ্চমুখে স্তুতি যাকে করেন দেবরায়। সহস্র মুখে শেষনাগ যার স্তুতি করেন, চরাচরের আর যত মহামতি আছেন সকলে কৃষ্ণের স্তুতি করেন। সংসারে যার জ্বিহ্বাতে কৃষ্ণের গুণগান নেই সে তার পাপতনু ধারণ করে অকারণ।
আমি অতি সামান্য ক্ষুদ্র মানুষ, আমি কি আর কৃষ্ণের তেমন স্তুতি করতে পারি!
হে পাপী তুমি বললে এই রাজারা ক্ষমা করে আমায় বাঁচিয়ে রেখেছে। আমি এদের তৃণতুল্যও জ্ঞান করি না।

গঙ্গাপুত্র ভীষ্মের এই কথায় রাজারা ক্রোধে গর্জাতে থাকে। সাধু রাজারা ভীষ্মের কথা শুনে হাসে, দুষ্ট রাজারা কর্কশ ভাবে গালাগাল দিতে থাকে – গর্বিত দুর্মতি পাপাচারী, ভীষ্ম! একে আজ পশুর মত হত্যা করব। কেউ বলে –একে বেঁধে নিয়ে চল। এর আবার ইচ্ছামৃত্যুর অহঙ্কার আছে। আজ একে পুড়িয়ে মারব।

হেসে ভীষ্ম বলেন –হে রাজগণ, অকারণ কথা বলে যাচ্ছ, এই বিবাদের কোন শেষ নেই। আমি তোমাদের সবার শিরে পা দিয়ে বলছি, যার মৃত্যুর ইচ্ছা আছে সে যুদ্ধে আহ্বান কর। পূজায় সন্তুষ্ট থাকেন দৈবকী নন্দন কৃষ্ণ। কিন্তু যার মরণের ইচ্ছে হয়েছে সে তাকে যুদ্ধে ডাকুক, যদি সাহস থাকে। শিশুপালের দেহে গোবিন্দের কৃপাংশ আছে। তাই এখনও কৃষ্ণ তাকে ক্ষমা করে যাচ্ছেন। এর ব্যবস্থা হলে তারপর তোমাদেরও সবাইকে যমের বাড়ি পাঠাবো।

ভীষ্মের একথায় শিশুপাল অতি ক্রুদ্ধ হয়ে হাক দিয়ে কৃষ্ণকে বলে –ওই, গোপাল! আজ তোমার সাথে এই পাণ্ডুপুত্রদেরও আমি হত্যা করব। তারা কেন এত রাজা থাকতে সবার আগে তোমার পূজা করল! আজ তোমাদের সবার শেষ দিন।
......................................
উৎসর্গ: সকল ব্লগার বন্ধুকে
.....................................
আগের পর্ব:

কথাচ্ছলে মহাভারত - ১৪৩ Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই মে, ২০১৭ সকাল ১১:৫৩
২টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

দু'টো মানচিত্র এঁকে, দু'টো দেশের মাঝে বিঁধে আছে অনুভূতিগুলোর ব্যবচ্ছেদ

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১২:৩৪


মিস ইউনিভার্স একটি আন্তর্জাতিক সুন্দরী প্রতিযোগিতার নাম। এই প্রতিযোগিতায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সুন্দরীরা অংশগ্রহণ করলেও কখনোই সৌদি কোন নারী অংশ গ্রহন করেন নি। তবে এবার রেকর্ড ভঙ্গ করলেন সৌদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার প্রফেশনাল জীবনের ত্যাক্ত কথন :(

লিখেছেন সোহানী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সকাল ৯:৫৪



আমার প্রফেশনাল জীবন বরাবরেই ভয়াবহ চ্যালেন্জর ছিল। প্রায় প্রতিটা চাকরীতে আমি রীতিমত যুদ্ধ করে গেছি। আমার সেই প্রফেশনাল জীবন নিয়ে বেশ কিছু লিখাও লিখেছিলাম। অনেকদিন পর আবারো এমন কিছু নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

×