somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

“Made in Bangladesh”

০৯ ই মার্চ, ২০১৪ রাত ১১:৩৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

নগ্ন উর্ধাঙ্গের একজন তরুনী, লাস্যময়ী ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে দুহাতে তার জিপার খোলা জিন্সের প্যান্টটির সম্মুখ উন্মুক্ত করে ধরে আছেন, মুখের স্মিতহাসির মতো ভিতরের অন্তর্বাসটিও কিঞ্চিৎ দৃশ্যমান। নগ্নবক্ষের উপরে আড়াআড়ি লেখা “Made in Bangladesh” , তার “প্রাক্তন” পরিচয়। সম্ভাব্য ক্রেতা যাতে বুঝতে ভুল না করেন, সে জন্য নোটও দেয়া আছে, তরুনী ম্যাক্‌স্‌- জন্মগতভাবে বাংলাদেশী মুসলিম, কিন্তু এখন তিনি ধর্ম, বাংলাদেশ বা আমেরিকার উর্ধে উঠে সেগুলোকে অপ্রয়োজনীয় মনে করছেন গৎবাঁধা সংজ্ঞার বাহিরে নিজের পরিচয়ে পরিচিত হবার জন্য।

অ্যামেরিকান এপারেলস্‌-এর সাম্প্রতিক সময়ের আলোচিত বিজ্ঞাপন এটি। মডেল একজন বাংলাদেশী বংশোদ্ভুত আমেরিকান তরুনী যিনি অ্যামেরিকান এপারেলস্‌-এর একজন মার্চেন্ডাইজার। বিজ্ঞাপনটি নিয়ে দেশে-বিদেশে ইতোমধ্যে প্রচুর সমালোচনা হচ্ছে। অ্যামেরিকান এপারেলস্‌ বরাবরই তাদের বিজ্ঞাপনের ক্ষেত্রে বিতর্কিত। সম্প্রতি তারা বাষট্টি বছরের বৃদ্ধাকে দিয়ে অন্তর্বাসের বিজ্ঞাপন, যৌনকেশযুক্ত ম্যানিকিন ব্যবহার করে পোষাক প্রদর্শন ইত্যাদি কারনে বিতর্কিত হয়েছিলো। গত বছর যুক্তরাজ্যে এই কোম্পানীর বিজ্ঞাপন নিষিদ্ধ করা হয় যৌন-উদ্দীপক ছবি ব্যবহার করার কারনে।

এবারের আলোচিত বিজ্ঞাপনটিতে অ্যামেরিকান এপারেলস্‌-এর বক্তব্য খুব স্পষ্ট। তারা এই “প্রাক্তন” বাংলাদেশী নারীকে উপস্থাপন করেছে একজন প্রাক্তন রক্ষনশীল মুসলিম পরিবারের বাংলাদেশী নারী হিসেবে, যিনি এখন আমেরিকান, কিন্তু নিজের নিজস্বতা প্রকাশের জন্য তিনি বাংলাদেশী বা আমেরিকান নন, কোন গৎবাঁধা সংজ্ঞায় তার জীবন আবদ্ধ নয়। তিনি নিজ পরিচয়ে পরিচিত মুক্ত একজন নারী। তিনি অ্যামেরিকান এপারেলস্‌-এর জিন্স পরিধান করেন।

নারীমুক্তির সফল একজন উদাহরন হিসেবে “ম্যাক্‌স্‌”-কে অভিবাদন জানাতেই পারি। ঢাকার রক্ষনশীল মুসলিম পরিবারে জন্ম নেয়া এই নারী চার বছর বয়সে পিতা-মাতার সাথে আমেরিকায় চলে যায়। তারপর সেখানে লেখাপড়া ও বেড়ে ওঠা। প্রথমে ধর্মীয় অনুশাসন মানলেও ক্রমে ধর্ম, দেশ –মুক্তির পথের এই অপ্রাসঙ্গিক বাধাঁগুলোকে অতিক্রম করে তিনি আজ একজন সফল নারী। অভিবাদন ম্যাক্‌স্‌! কিন্তু নিজে নারী না হয়েও, গার্মেন্টসকর্মী না হয়েও শুধুমাত্র বাংলাদেশী হয়েই গালে চপেটাঘাতের একটা চিনচিনে ব্যথা অনুভব করছি।

অ্যামেরিকান এপারেলস্‌ তার ব্যবসায়িক বিজ্ঞাপনে সফল। তারা অন্য কোম্পানীগুলোর মতো বাংলাদেশের গার্মেন্টস থেকে আউটসোর্সিং করে তাদের পন্য বানায় না, যে বাংলাদেশে শ্রমিক তাদের শ্রমের ন্যায্য মুল্য থেকে বঞ্চিত, যেখানে শ্রমিকের জীবনের নিরাপত্তা নেই, কর্মক্ষেত্রে স্বাস্থ্যকর পরিবেশ নেই। তারা তাদের পন্য তৈরী করে ডাউনটাউন লসএঞ্জেলসের কারখানায় যেখানে তারা তাদের আমেরিকান শ্রমিকদের বাংলাদেশী শ্রমিকদের চেয়ে পঞ্চাশগুন বেশী পারিশ্রমিক দিয়ে থাকে, এবং যাদের স্বাস্থ্যসেবাসহ অন্যান্য সুবিধাদিও রয়েছে। এবং, এরপরেও, তাদের এই পন্যটির মুল্য মাত্র নব্বই ডলার।

সবাই ঠিক থাকলে তারপরেও চপেটাঘাতটা অনুভব করছি কেন? অ্যামেরিকান এপারেলস্‌ আমাদের নগ্ন করে আমার নিজের স্তনের উপরে আমাদের নিজের জাতির নামের সীল মেরে আমাদের অক্ষমতা আর দৈন্যতাকে দেখিয়ে দিয়েছে বলে? দোষ কি তাদের? আমরা নিজেরা আর কতদিন লজ্জিত এবং বিক্রিত হব আমাদের অক্ষমতা আর দৈন্যতার জন্য। অ্যামেরিকান এপারেলস্‌-এর খুব বেশী দোষ আমি দেই না। তারা তাদের ব্যবসার জন্য যা প্রয়োজন তাই করেছে। আমরা কেন আমাদের শ্রমিকদের ন্যায্য বেতন দেই না, কেন তাদের কাজের উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করিনা, কেন আমরা তাদের আগুনে পুড়িয়ে-ধংস্বস্তুপে চাপা দিয়ে মারি? এটা কি আসলেই আমাদের অক্ষমতা? মুখে তো আমরা দিনরাত এই শ্রমিকদের প্রতি ভালোবাসার ফেনা ওগলাতে থাকি। সামর্থ্য যে নেই, তাও তো নয়। তাহলে কি? না, এটা আমাদের অক্ষমতা নয়, আমাদের অনিচ্ছা। অ্যামেরিকান এপারেলস্‌ শুধু সেটা অন্যদের জানিয়ে এর ফায়দা তুলেছে।

আধুনিক হতে, মুক্ত মনের হয়ে নিজকে খুঁজে পেতে হলে আসলেই মনে হয় নিজের ধর্ম, দেশ, প্রচলিত মুল্যবোধ একসময় বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। এগুলো ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে নগ্ন বুক উঁচু করে দাঁড়াতে পারলেই আমি প্রগতিশীল, স্বাধীন, আমি মুক্ত। হ্যাঁ, কতটা মুক্ত হয়ে কতদুরে আসতে পেরেছি সেটার মাপ বোঝাতে অবশ্য আমার উৎস্যের পরিচয়টা দরকার। সেটা না হয় একলাইনে লিখে স্তনের উপরে সাঁটিয়ে নিব। যথেষ্ট বাহবার কাজ। আমাদের “প্রাক্তন” কন্যা ম্যাক্‌স্‌তো তাই করেছেন, ভুলতো কিছু নয়। আর অ্যামেরিকান এপারেলস্‌ শুধু এটা প্রকাশ করেছে- সাথে না হয় এটুকু বলেছে, দেখ বাংলাদেশে উৎপন্ন এই প্রগতিশীল মেয়েটা বাংলাদেশে উৎপন্ন পোশাক না পরে যেটুকুই পরে আমাদের তৈরী পোশাকই পরে।

এটা কি ধরনের দৈন্যতা! দেশকে না হয় নিজের বলে পরিচয় দেই না, তাই বলে সেই দেশকে, সেই দেশের মেয়েদের, সেই দেশের দিন-আনা দিন-খাওয়া শ্রমিকদের অপমান করার ধৃষ্টতা কিভাবে আসে! শিক্ষার অভাব নয়, মানসিক বৃদ্ধির অভাবও নয় –এটা শুধুই মানসিক দৈন্যতা। শুধু এই বিজ্ঞাপন কেন, দেশের ভিতরেও এর উদাহরনের অভাব নেই। ইদানিং আমাদের নিজস্ব জীবন-যাত্রায় নিজেদের সংস্কৃতি আর ঐতিহ্য ভেঙ্গে বের হবার খুব আপ্রান একটা প্রচেষ্টা চলছে। একুশে ফেব্রুয়ারীরও সাজ-ফ্যাশন বের করি আমরা, বিদেশী ভিনদেশী জীবনযাত্রার আদলে বিজ্ঞাপন বানাই, মুক্ত মেলামেশার অভাবের জন্য কথা বলি, নাটকে হাস্যকর অবাস্তবতার সাথে গ্রামকে তুলে ধরি, নিজেদের পোষাক বদলাই। আমাদের এতটাই অবক্ষয়, এত সমৃদ্ধ একটা সংস্কৃতি নিয়েও আমরা এতই দীন! জীবনের শুরুতে এসব দেখে বিশেষ করে কিশোর-তরুন কিছু ছেলেমেয়ের মধ্যে যেন মুল্যবোধের সংজ্ঞাটাই ভিন্ন হয়ে গিয়েছে। সেখানে আমাদের সংস্কৃতি বা ঐতিহ্য নেই। আছে অন্যদেশের সংস্কৃতি ধারন করার আপ্রান প্রচেষ্টা। আমাদেরও কোন চেষ্টা নেই তাদের শেখানোর। দীন একদল অক্ষম বাংলাদেশী আমরা আরো কিছু “Made in Bangladesh“ ভবিষ্যত-ম্যাক্‌স্‌ তৈরী করছি। আর অ্যামেরিকান এপারেলস্‌-এর মতো কোম্পানীগুলোতো বসেই আছে তাদের লুফে নিয়ে আমাদের অক্ষমতা, দৈনতাকে ব্যবহার করে ব্যবসা করার জন্য। আমরা কি ফিরবো? নাকি ফেরার পথ দিনে দিনে নিজেরাই বন্ধ করে দিচ্ছি? দেরী হয়ে যাচ্ছে না তো?

বিজ্ঞাপনটা দেখে নিজের মধ্যে কেন যেন কোন উত্তেজনা জাগে না। নগ্নবক্ষা বাংলাদেশের স্তন থেকে চোখ নামিয়ে নিজের ম্রিয়মান পৌরুষত্ব দেখি, নগ্নবক্ষ দেখি –আর দুহাতে ঢেকে লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করি, আবার না যেন কারো পন্যের বিজ্ঞাপন হয়ে যাই।
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই মার্চ, ২০১৪ রাত ১১:৩৮
৩টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শ্রমিক সংঘ অটুট থাকুক

লিখেছেন হীসান হক, ০১ লা মে, ২০২৪ সকাল ৯:৪৮

আপনারা যখন কাব্য চর্চায় ব্যস্ত
অধিক নিরস একটি বিষয় শান্তি ও যুদ্ধ নিয়ে
আমি তখন নিরেট অলস ব্যক্তি মেধাহীনতা নিয়ে
মে দিবসের কবিতা লিখি।

“শ্রমিকের জয় হোক, শ্রমিক ঐক্য অটুট থাকুক
দুনিয়ার মজদুর, এক হও,... ...বাকিটুকু পড়ুন

কিভাবে বুঝবেন ভুল নারীর পিছনে জীবন নষ্ট করছেন? - ফ্রি এটেনশন ও বেটা অরবিটাল এর আসল রহস্য

লিখেছেন সাজ্জাদ হোসেন বাংলাদেশ, ০১ লা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৪

ফ্রি এটেনশন না দেয়া এবং বেটা অরবিটার


(ভার্সিটির দ্বিতীয়-চতুর্থ বর্ষের ছেলেরা যেসব প্রবলেম নিয়ে টেক্সট দেয়, তার মধ্যে এই সমস্যা খুব বেশী থাকে। গত বছর থেকে এখন পর্যন্ত কমসে কম... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রতিদিন একটি করে গল্প তৈরি হয়-৩৭

লিখেছেন মোঃ মাইদুল সরকার, ০১ লা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৫১




ছবি-মেয়ে ও পাশের জন আমার ভাই এর ছোট ছেলে। আমার মেয়ে যেখাবে যাবে যা করবে ভাইপোরও তাই করতে হবে।


এখন সবখানে শুধু গাছ নিয়ে আলোচনা। ট্রেনিং আসছি... ...বাকিটুকু পড়ুন

একাত্তরের এই দিনে

লিখেছেন প্রামানিক, ০১ লা মে, ২০২৪ বিকাল ৫:৩৬


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

আজ মে মাসের এক তারিখ অর্থাৎ মে দিবস। ১৯৭১ সালের মে মাসের এই দিনটির কথা মনে পড়লে এখনো গা শিউরে উঠে। এই দিনে আমার গ্রামের... ...বাকিটুকু পড়ুন

হুজুররা প্রেমিক হলে বাংলাদেশ বদলে যাবে

লিখেছেন মিশু মিলন, ০১ লা মে, ২০২৪ রাত ৯:২০



তখন প্রথম বর্ষের ছাত্র। আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে আমাদের আরেক বন্ধুর জন্মদিনের উপহার কিনতে গেছি মৌচাক মার্কেটের পিছনে, আনারকলি মার্কেটের সামনের ক্রাফটের দোকানগুলোতে। একটা নারীর ভাস্কর্য দেখে আমার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×