বিকেলের রোদটাও পড়ে গেল। ক'টা বাজে? মাত্র সোয়া পাঁচটা! খুব তাড়াতাড়ি সন্ধ্যা হচ্ছে। নদীর পাড়ে বসে আছি। হালকা হালকা কুয়াশা ভেসে বেড়াচ্ছে, নিচে নেমে আসছে...শীতের আমেজ আসতে শুরু করেছে। দূরে ঐ পাড়ের ভবনগুলোয় আলো জ্বলছে। নিয়নসাইনের আলো, বসতবাড়িগুলোর আলো, ল্যাম্পপোস্টের আলো। আস্তে আস্তে সবগুলো আলো জ্বলে উঠছে। মৃদু কুয়াশাঘেরা পরিবেশটাকে ঘোলাটে আলোগুলো আরো মোহময় করে তুলছে। বিষন্ন ভেজা ভেজা বাতাস। নদীর বুকে আলোর খেলা। নিস্তরঙ্গ ঢেউ....ঘাসগুলোও কেমন যেন ফ্যাকাশে হয়ে যাচ্ছে। আমি বসে আছি ঘাসের উপর। শেষ বিকেলের এই পরিবেশটা কেমন তন্দ্রালু করে তুলছে আমাকে। ভালো লাগছে, বেশ ভালো লাগছে। ছেড়া ছেড়া স্বপ্নগুলো ভেসে আসছে মনের আকাশে। ধূসর অনেক অনেক বিকেল চলে গেছে। চলে গেছে অনেক কষ্টমাখা প্রহর। এই মৃদু আলোয় কুয়াশা ভেজা পরিবেশ আর ভেজা বাতাসে কষ্টগুলোর অনুভূতিও কেমন যেন ফিকে হয়ে যায়। মাথার ভেতর ঘন্টাধ্বনির মত বেজে চলা কষ্টের ধ্বনি গুলোও নিস্প্রভ হয়ে আসে। কেমন যেন এক অনুভূতি, কেমন যেন এক ভাবালুতা পেয়ে বসে আমাকে। সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না সবগুলো অনুভূতিই কেমন এক অবিচ্ছেদ্য অনুভূতির জন্ম দেয়। আলাদা করতে পারি না আমি, কাউকেই কারো কাছ থেকে । কষ্টগুলো ছাড়া কি আর জীবন হয়? কষ্টের অনুভূতিগুলোর জন্যই আনন্দের, ভালোলাগার অনুভূতিগুলো বোঝা যায়। কষ্টের অনুভূতি যখন ভোতা হয়ে আসে তখন সে সাথে করে ভালোলাগার অনুভূতিগুলোকেও নিয়ে যায়। এটাতো আসলে একই মুদ্রার দু'টো পীঠ। এটা তো শুধু মুদ্রা নয়, জীবনের তাল লয়ের মুদ্রাও। হারিয়ে গেছে মুদ্রাটা আমার। জীবনের তাল-লয়ও তাই খুঁজে পাচ্ছি না আর। ছন্দহীন জীবন...
পকেট হাতড়ে বের করে আনি আমার একাকীত্বের সাথী। খুট করে জ্বলে ওঠে লাইটার। আরও একটি সিগারেট, জ্বলে শেষ হয়ে যাবে আমার ঠোটে। কিন্তু আমার এই তন্দ্রালুতা শেষ হয় না।
সূর্যটা ডুবে গেল। আকাশের বুকে রেখে গেল লালচে আভা। লাল আকাশের বুকে দূরে নীড়ে ফেরা পাখির কালো ছায়া। তাদের ডানা ঝটপটানির শব্দও যেন আমি শুনতে পাই এত দূর থেকে। নীলচে ধোঁয়ায় সামনের দৃষ্টিপট আরো ঘোলাটে হয়ে আসে। আমি চোখ বন্ধ করি। শুয়ে পড়ি ঘাসের উপর। এভাবেই পড়ে থাকি অনেকক্ষণ। সন্ধ্যা পেড়িয়ে যায়। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্নের মাঝে হারিয়ে যাই আমি। সে আমার দুঃস্বপ্ন না সুখস্বপ্ন, বুঝতে পারি না আমি।
গোধূলীর শেষ আলোয় সমুদ্রে ডুবে যাওয়া সূর্যের প্রতিফলন। কাধে কারো নির্ভাবনায় রাখা মাথা, মাতাল হাওয়ায় উড়ে আসা চুলের স্পর্শ। বিমোহিত করে আমায়। তার নিঃশ্বাসও আমি অনুভব করতে পারি। সে আমায় নিয়ে চলে স্বপ্নের ভুবনে। মেঠোপথ ধরে চলা, হাতে রাখা হাত। ফিরে যাওয়া আমাদের নীড়ে।
যখন চোখ মেলি তখন দেখি আকাশের কালো বুকে অনেক অনেক তারা। পূর্ণিমার চাঁদটা উঠছে। এখনও তার গায়ে হলদে আভা। সে সাজ নিচ্ছে। তার রূপালী আলোয় আলোকিত করবে পৃথিবীকে। আমার ভেতর থেকে কে যেন হঠাৎ কথা বলে ওঠে। "ফিরে যাও" সে বলে। "হা হা হা হা" আমি হেসে উঠি। "ফিরে যাওয়ার জন্য কি এসেছি? আর ফিরে যাবো? কোথায়? কার কাছে?" জবাব চাই আমার।
জবাব আসে না। নেমে আসে আমার সামনে অসাধারণ এক পূর্ণিমা রাত। কী তার আলো, কী তার রূপ। আমি আর কিছু চিন্তা করতে পারি না। বিমোহিত হয়ে যাই পূর্ণ পূর্ণিমার রূপে। কুয়াশার মাঝে চাঁদের আলো...উফ...আর সহ্য করতে পারি না আমি। চোখ বন্ধ করে ফেলি আবার। এই ধোয়াশা কুয়াশায় ঢাকা চাঁদনী রাতের সৌন্দর্য্য আমার জন্য নয়। তার ধোয়াশায় হারিয়ে যাওয়া মিটমিটে তারাগুলো যেন হাত বাড়িয়ে আমাকে ডাকে। আমার দৃষ্টিসীমায়, আমায় নিয়ে যেতে চায় আমার দৃষ্টিসীমার বাইরে।
আবার চোখ ফেরাই নগরের নিয়ন আলোয়। ব্যস্তদিনের শেষে ঘরে ফেরা মানুষের ব্যস্ত পদচারণ। কোলাহল মুখরতার কিছুটা স্পর্শও আমি পাই এই নীরব নদী পাড়ের ঘাসের উপর। আমার কোন ব্যস্ততা নেই। কোন কিছুই আমাকে আর কাছে টানতে পারে না। আমি আজ ধরা ছোঁয়ার অনেক বাইরে। আকর্ষণহীন জীবনের আকর্ষণে আমি বাঁধা পড়েছি। সে এক প্রবল আকর্ষণ। কোন কিছু চাওয়ার নেই, কোন কিছু পাওয়ার নেই আমার। পকেটে থাকা মুঠোফোনটা কেঁপে উঠে। মুঠোবার্তা: "সারাদিন ধরে তোমাকে কত খুঁজছি, কোথায় তুমি? ফোন ধরছ না কেন?" কোন প্রতিউত্তর করি না আমি। কোন উত্তর জানা নেই আমার। আমি এখন পথিক। চলতে হবে শুধু আমার আমি জানি। গন্তব্য আমার জানা নেই। পিছু ফিরে তাকানোর কিছু নেই আমার।
রাত বাড়ছে। দশটা কি এগারোটা হবে। নগর ব্যস্ততার অবসানে সেও নীরব হয়ে আসছে ধীরে ধীরে। ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে নগরবাসি। শুধু জেগে আছে ল্যাম্পপোস্টগুলো, নিয়নবাতিগুলো। জেগে থাকবে তারাগুলোও। আলো ছড়িয়ে যাবে পূর্ণযৌবনা চাঁদ। নিয়নবাতিগুলোকে বড় ক্লান্ত মনে হয় আমার কাছে। নগরের আলোগুলো বড় বেমানান লাগে। এই রাতে কি দরকার তাদের? সবগুলো আলো নিভিয়ে দেয়া উচিত। আজ শুধু চাঁদ আর পৃথিবী। নয় কোন নগুরে ব্যস্ততা, নয় কোন নিয়নবাতি, ল্যাম্পপোস্ট, গাড়ির হর্ন। শুধু অরণ্য, খোলা আকাশ আর পূর্ণযৌবনা চাঁদ।
নাহ্। এলোমেলো হয়ে আসছে চিন্তাগুলো। এমনটা হওয়ার কথা নয় আজ। আজ আমি মুক্ত হয়েছি। সব পার্থিব আকর্ষণ, সব দৈন্যতাকে বিদায় জানিয়েছি আমি। আমি আজ পূর্ণ। পূর্ণতার স্বাদ আমাকে বিমোহিত করেছে। আজকের বিকেল, সন্ধ্যা, রাতের প্রতিটি মুহূর্ত আমি অবলোকন করেছি। অবলোকন করেছি আমার পূর্ণতার প্রতিটি মুহূর্ত। অপূর্ণতাকে পেছনে ফেলে পূর্ণতার পথে যাত্রা.......
এরপর আর কিছু লেখা ছিল না ডায়রীটায়। নামধাম কিছুই না। পূর্ণতার স্বাদ পাওয়া সেই মানুষটার পরিচয় জানা হল না।
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই এপ্রিল, ২০১১ সন্ধ্যা ৬:৩৬

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




