আমি একটু কাঁদতে চাই। অনেকদিন হয়ে গেল আমি কাঁদতে পারি না। ছোটবেলায়ও খুব একটা কাদতে পারতাম না। বুকের ভেতর অনেকগুলো কষ্ট, অনেকগুলো না বলা কথার ভীড় জমেছে। মনের আকাশে আজ অনেক অনেক কালো মেঘের ভীড়। একটা গভীর বর্ষণ খুব দরকার আমার। আমার কথাগুলো শোনার তো আজ আর কেউ নেই। আমি আজ একা। বড় একা। তাই আমাকে কাঁদতে হবে। আমি জানি আমার কষ্টগুলো একান্তই আমার। জীবনের এই পর্যায়টা খুব একটা সুখকর নয়।
মেডিকেলে পড়ালেখার কারনে বাসার বাইরে ছিলাম দীর্ঘদিন। ছয় বছর...। শুনতে হয়তবা খুব একটা বেশী শোনায় না, কিন্তু বাস্তবতায় অনেক দীর্ঘ একটা সময়। এই সময়ে পরিবর্তন হয়েছে কতকিছু! বুঝতে পারিনি আসলে আমি আমার চেনাজানা জগৎটা থেকে অনেক দূরে সরে গেছি। আসলে বুঝে ওঠার সময়টাও পাইনি। শত শত পরীক্ষা, আইটেম, ওয়ার্ড, লেকচার ক্লাসের ভীড়ে কখন যে আস্তে আস্তে দূরে সরে গিয়েছি বুঝতে পারিনি। নতুন পরিবেশ, পড়ালেখা আর পারিপার্শিক গতিময়তার স্রোতে কখন যে ভিরে গেছি বুঝিনি। চারদিকে শুধু দেখেছি সাফল্যের পেছনে ছোটার মিছিল। সেই মিছিলে মিশে গিয়ে শুধু একটা জিনিসই বুঝেছি, তোমাকে ছুটতে হবে। তোমাকে যেভাবেই হোক পাশ করতে হবে। জীবনটা সীমাবদ্ধ হয়ে গেল শুধু দুটি শব্দের মাঝে- পাশ আর ফেল। জানি আমার কথাগুলো হয়তবা কারো কারো কাছে হাস্যকর লাগছে। কিন্তু আমি দৃঢ়ভাবে বলতে পারি আমার সহপাঠীদের জীবনেও তারা এই বাস্তবতাই অতিক্রম করে এসেছে। যখন পড়ালেখার মধ্যে ছিলাম এই ব্যপারগুলো ঠিক এভাবে কখনও মনে হয়নি। ফাইনাল প্রফ। মেডিকেল জীবনের সব’চে ভয়াবহ একটি পরীক্ষা। অনেকটা নদীর পাড়ে এনে দাঁড় করিয়ে দেয়া। ওইপাড়ে পাশ আর পেছনে তোমার গত পাঁচটি বছরের সাধনা। সাঁতরে এবার পাঁড় হও তুমি। নদীতে অনেক ডুবোচর, আছে এক্সটার্নাল ইন্টার্নাল নামের কুমির। একটু এদিক ওদিক হবে তো চলে যাবে এদের কারো পেটে, আর নাইলে ডুবোচর তো আছেই। পরীক্ষা নিয়ে অনেক কিছুই বলছি। নন মেডিকেল কেউ পড়লে হয়তবা ভাবতে পারেন, “ভাবখানা এমন যেন শুধু মেডিকেলের পোলাপানই পরীক্ষা দেয়।” আসলে এ যে কী জিনিস তা কেবল বড় ভাইয়া আপুরা যারা দিয়ে গেছেন তারাই জানেন। অনেক কথা বললাম পরিক্ষা নিয়ে। কারন এই পরীক্ষাটাই এনেছে জীবনের সবশেষ কষ্টকর পরিবর্তন।
বাসায় বসে অপেক্ষা রেজাল্টের। কিছু করার নেই তোমার। গতকয়েক মাসের হাড়ভাঙ্গা খাটুনি আর নির্ঘুম রাতের পরও এখন তোমার চোখে ঘুম আসেনা এই রেজাল্টের টেনশনে। কি হবে কে জানে? গত পাঁচ ছয় বছরে তোমার যে চেনাজানা হোস্টেলের পরিবেশ তা থেকেও তুমি এখন দূরে। আর আগেই বলেছি নিজের বাসায় যখন ফিরেছ তুমি, তখন তুমি দেখবে তোমাকে ছাড়াও জীবন এখানে চলছে তার নিজস্ব গতিতে। বাবা, মা, ভাই-বোন সবাই তোমাকে ছাড়া চলার একটা আলাদা গতিপথ তৈরী করে নিয়েছে। সবার মাঝেই তৈরী হয়েছে আলাদা জগৎ। তোমার আর তাদের মাঝে অদ্ভুদ এক কাঁচের দেয়াল। সেই দেয়ালের ভেতর বন্দি তুমি। সবাই তোমাকে দেখছে, তুমিও সবাইকে। কিন্তু ঠিক কেমন যেন একটা দুরত্ব। এই দুরত্বটাই বড় কাঁদায়।
গত ছয় বছরে তোমার জীবনে ঘটে গেছে অনেক পরিবর্তন। তুমি আকাশের দিকে তাকাতে ভুলে গেছ। তোমার কাছে হয়তবা অনেক কিছুর সংগাই পাল্টে গেছে। বৃষ্টির মানে হয়তবা হয়ে গেছে শুধু শুধুই কাপড় ভেজা। কোথায় যেন শুনেছিলাম—“ only a few feels the rain..others just get wet.” তুমি তোমার নিজেকে হারিয়ে হয়তো হয়ে গেছ অন্যকেউ( others)। তোমার এখন কিছু করতেও ভাল লাগে না আবার কিছু না করে বসে থাকতেও ভাল লাগে না। ফেসবুক আর স্কাইপে দিয়ে যোগাযোগ রাখার চেষ্টা করছ বন্ধুদের সাথে। কিন্তু এখানেও তুমি দেখবে সবাই সবার মত ব্যস্ত। স্কুলের বন্ধুদেরকেও সময় দিতে পারনি অনেকদিন। অনেকেই হয়তবা পাশ করে চাকুরী করছে। অথবা তাদের নিজেদের জীবনে তারা তাদের মত করে ব্যস্ত। সবাই শুধু ছুটছে। এই ছোটাছুটির কোন শেষ নেই। তুমিও ছুটবে আর কিছুদিন পর। এবং এটাই তোমার জীবনের শেষ অবসর। কিন্তু তোমার এই অবসরটা তুমি উপভোগ করতে পারছ না। তার যথাযথ প্রাপ্যটা তুমি দিতে পারছ না।
কিভাবে চলে যাচ্ছে সময় তোমার হাত গলে তুমি বুঝতেও পারছ না। সামনের ক’টা বছর কাটবে তোমার ইন্টার্ন, ক্লিনিক, এফ সি পি এস অথবা বি সি এস এর প্রিপারেশনে। এই সোনার আর ডায়মন্ডের হরিণগুলোও একদিন হয়তবা তোমার হাতে ধরা দেবে। সেদিন তুমি আর এরকম বসে বসে চিন্তা করার সময় পাবে না, জীবন থেকে তোমার কতটা সময় হারিয়ে গেল। জীবনের ব্যস্ততা, নতুন কোন এক মানুষের সাথে হয়তবা নতুন জীবনের শুরু। কিন্তু তুমি কি তোমার নিজেকে যেভাবে চিন্তা করতে সেভাবেই তোমার জীবন চলছে। আসলে ব্যপারটা হল জীবন প্রতিনিয়ত তার রঙ বদলায়, তার সঙ্গা বদলায়। তাই তোমারও বদলাতে হবে তোমাকে। যদি তুমি তা না পারো, তাহলে তোমার নিজের তৈরী দেয়ালে বন্দী হবে তুমি নিজেই। পারবে না কিছু ছেড়ে বেরিয়ে আসতে। সবার ঘড়ির কাটাই ঘুরবে শুধু তোমারটা ছাড়া।
কি যে লিখে যাচ্ছি জানি না। কথাগুলো এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। আসলে আমি নিজের কাছে একটা খোলা চিঠি লিখছি। নিজেই নিজেকে বলার চেষ্টা করছি যা অন্য কাউকেই বলতে পারছি না। শুরুতে যা বলছিলাম, আমার কাঁদতে হবে। কারন আমি আমার নিজের অদ্ভুদ কাচের দেয়ালে নিঃসঙ্গ একা বন্দী জীবন কাটাচ্ছি। আমি হারিয়েছি অনেক কিছুই। হারিয়েছি আমার প্রাণপ্রাচুর্য, আমার প্রাণখোলা হাসি। আমি হারিয়েছি আমার কথা বলার মত মানুষ। আমি বন্দী আজ, আমার নিজের অন্তপ্রাণের নিষ্ঠুর কারাগারে। তাই আমি কাদতে চাই। সবগুলো কালোমেঘ আমি ঝরিয়ে দিতে চাই আমার আকাশ থেকে। আমার কবিতার খাতাটা হাতড়ে বের করি। আমি আবার কাদতে চাই—
বৃষ্টি চেয়েছিলে তুমি মেঘের কাছে মেয়ে
তাই আজ গর্জে গর্জে মেঘ কান্না ঝরিয়ে যায়
অবিরাম, ঝুপঝুপ করে নামে জানালার কাঁচে।
এপাশে আমার অগোছালো ঘরের অন্ধকারে
ইজেলে সেঁটে থাকা পার্চমেন্টে ঝড় তুলতে চায় পেন্সিল।
তোমার মুখের পোর্ট্রেট অথবা ফেলে যাওয়া তোমার পথ
আঁকবে বলে অন্ধকারে স্মৃতি হাতড়ায় এ মন।
খুঁজে পায় না সে কিছু শুধু শব্দহীন
আর্তচিৎকারে আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে তুলতে চায়।
অস্থির অস্থিরতায় ভরে থাকা মন কাঁদতেও পারে না আজ
সব জল শুকিয়ে আজ সে বিরান প্রান্তর।
হঠাৎ লাফিয়ে উঠে স্কালপেলটা হাতে নেই
মনে হয় এক পোচে দরদর করে নামিয়ে আনি
কালচে কষ্টমাখা রক্তগুলো।
পেন্সিলে নয়, বৃষ্টির জলে খুন মিশিয়ে
জলরঙে আঁকবো তোমার প্রতিকৃতি।
কিন্তু পারি না, পারবো না আমি আমার নষ্টপ্রাণের
অস্তিত্বের রঙে রাঙাতে তোমার মুখ।
সব ছুড়ে ফেলি, ভেঙে ফেলি জানালার কাঁচ
আজ আমার ঝড় চাই, আকাশভাঙা ঝড়।
যে ঝড় ভেড়ে দেবে এ দুচোখের বাঁধ
ভেজাবে এ মন বর্ষার জলে।
পারি না, আমি আজ কিছুই পারি না
ভেঙে ফেলি পেন্সিল, জানালার বাইরে ছুড়ে দেই
পার্চমেন্ট, ইজেল, স্কালপেল, গীটার......সব।
আস্তে আস্তে গভীর রাতে থেমে যায় বরষা
কালো স্বচ্ছ আকাশের বুকে জেগে ওঠে তারা।
অনেক দিন পর আবার, অনেক দিন পর
দু'চোখ বেয়ে নেমে আসে 'বৃষ্টিধারা।'
........একাকীত্ব।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




