বেশ দেরীতে হলেও Christiane Amanpour এর নেয়া আমাদের প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাতকারটি দেখলাম। সত্যি বলতে পুরো সাক্ষাতকারটিতে প্রধানমন্ত্রীকে বেশ চাপে ছিলেন বলেই মনে হয়েছে। Christiane Amanpour এর কে যতো না আক্রামন্তক মনে হয়েছে, তার চেয়ে বেশী বুঝা গেছে আমাদের প্রধানমন্ত্রী সঠিক তথ্য সম্পর্কে ওয়াকবিহাল ছিলেন না। এই একটি বার এই সাক্ষাতকারের দৃষ্টিকোন থেকে আমি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কে সম্পূর্ন দোষ দিতে পারছি না। আমাদের গার্মেন্টস শিল্প প্রায় ২৫ বছরের। এর মধ্যে এরশাদ এর শাষননামল আর সেনা সমর্থিত তত্বাবধায়ক সরকার ধরলে ৪ জন সরকার দেশের গার্মেন্টস শিল্প পেয়েছে, এবং আমলাতন্ত্র বজায় থাকার কারনে কোন সরকারই সরাসরি এতে হস্তক্ষেপ করতে পারেনি। গার্মেন্টস শিল্প থেকে আমাদের রপ্তানী বানিজ্যের ৭০ ভাগ আসে এই জুজু তুলে প্রতিবার বিজিএমইএ যাবতীয় হস্তক্ষেপ থেকে সরকারকে দূরে সরিয়ে রেখেছে, বিনিময়ে স্বল্প শ্রম মূল্যে কিছু মুনাফাখোর ব্যবসায়ীদের সম্পদের পাহাড় গড়তে সাহায্য করেছে। সুতরাং আজকে সিএনএন এর সাক্ষাতকারে যে অপমান আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে সইতে হলো তার দায় বর্তায় বিজিএমই এরই উপর। দিনের পর পর দিন শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিয়ে যে জুয়া খেলা চলছে, তাতে বর্তমান সরকারের পাশাপাশি পূর্ববর্তী সরকারেরও সমান অংশগ্রহন ছিলো।
সাভার ট্র্যাজেডিতে সরকারের সমালোচিত হবার কারন যদি ধরা হয় আওয়ামীলীগের আশ্রয়ধীন সোহেল রানার কার্যকলাপ, তাহলে আমি মনে করায় দিতে চাই স্পেকট্রামের ঘটনায় বিএনপি নেতার সম্পৃক্ততা। তখন যদি বিএনপি নেতৃত্বাধীন সরকার অপরাধীদের শাস্তির ব্যবস্থা করতো তাহলে হয়তো আমাদের আজ সাভারের ঘটনা দেখতেই হতো না! কিন্তু আমার জানা মতে সেই গার্মেন্টস মালিকের শাস্তি পর্যন্ত হয়নি। সোহেল রানার মত বিষবৃক্ষরা সব সরকারের সময় তৎপর থাকে। খবর অনুযায়ী রানা প্লাজার অনুমতি দেয়া হয় বিএনপি এর সময়ে। তখন কি এর সাথে জড়িত ব্যক্তিরা জানতেন না যে রানা প্লাজা একটি খালের উপর নির্মিত হচ্ছে? তাহলে পরোক্ষ ভাবে এর দায় বিএনপি উপরই বর্তায়!
কিন্তু সরকার যে একেবারেই ধোয়া তুলসীর পাতা তা বলা যাচ্ছে না। বিশেষ করে দূর্ঘটনা পরবর্তি সময়ে প্রধানমন্তরীর বলা - "সাভারের ভবন ধ্বসের ঘটনায় সরকার সতর্ক হয়ে আগে থেকেই বাসিন্দাদের সরিয়ে
এনেছিল। পরে কেউ গিয়ে থাকলে তারা গিয়েছিল মালামাল সরাতে"। বা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ঝাকুনি থিওরি কোন ভাবেই গ্রহনযোগ্য নয়। এমনকি সাম্প্রতিক সাক্ষাতকারেও প্রধানমন্ত্রী বলেছেন - "বিশ্বের যেসব প্রতিষ্ঠান
বাংলাদেশ থেকে পণ্য প্রস্তুত করে নেয়, তাদের আরও পর্যাপ্ত অর্থ দেওয়া উচিত। তাহলে মালিকেরা শ্রমিকদের ভালোভাবে বেতন দিতে পারবে এবং নিরাপদ পরিবেশে ব্যবসা চালাতে সক্ষম হবে। " আমাদের শ্রদ্ধেয় প্রধানমন্ত্রীর নিশ্চয় অজানা নয় যে বাংলাদেশ থেকে পন্য প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান যথেষ্টই অর্থ দেয়, কিন্তু তার সিংহভাগ যায় মধ্যস্বত্ব ভোগী বায়িং হাউজগুলোর পকেটে আর মালিকে পকেটে।
একটা ফাইভ পকেট জিন্স এর একটা অর্ডার করতে একটা ফ্যাক্টরি কি পরিমান প্রফিট করে তা যদি আমরা দেখি -
কাটিং এন্ড মেকিং চার্জ সর্ব নিম্ন ১ ডলার ৭৭ টাকা
নেট প্রফিট ১৫% অফ সি এম ১১.৫৫ টাকা
একটা ৬৫ মেশিন স্ট্যান্ডার্ড লাইন এর দৈনিক প্রোডাক্টিভিটি ১০০০ পিস
একটা স্ট্যান্ডার্ড লাইন এর দৈনিক লাভ ১০০০ পিস x ১১.৫৫টাকা =১১৫৫০ টাকা
ছোট একটা ৮ লাইনের ফ্যাক্টরির দৈনিক লাভ ১১৫৫০ টাকা x ৮ লাইন = ৯২,৪০০ টাকা
মাসিক লাভ ২,৪০২,৪০০টাকা বা, ২৪ লক্ষ টাকা
বছরে যা হবে, ৩ কোটি টাকার কাছাকাছি।
লাইন বাড়লে প্রফিট আরো বেশী হবে । এবং আমাদের দেশের হিসেবে ৮ লাইন আর ফ্যাক্টরিকে ছোট
ফ্যাক্টরি হিসেবে ধরে হয়।এই হিসাব টা অনেক কঞ্জার্ভেটিভ হিসেব করা। ঐ লাভ টা আরও অনেক দিক দিয়ে বারে এবং ক্ষেত্র বিশেষে ডবলও হতে পারে এবং কোন কোন ক্ষেত্রে কমতেও পারে, কিন্তু সেইটা এক্সেপ্সান ।
( কৃতজ্ঞতা ব্লগার জিয়া হাসান Click This Link )
বছরে ৩ কোটি টাকার কাছাকাছি বা আরও বেশি মুনাফা নিয়েও যদি গার্মেন্টস গুলো নিরাপদ পরিবেশ না দিতে পারে পারে তাহলে আমরা এই শিল্প থেকে কি আশা করতে পারি? দিন দিন এই পরিবেশ আরো অবনতি হচ্ছে। সাম্প্রতিক বছরে দূর্ঘটনা গুলো যদি আমরা দেখি, তাহলে দেখা যায় বছরে বছরে প্রানহানির সংখ্যা শুধুই বেড়েই চলেছে। স্পেকট্রামে ৬৭ জন, তাজরীনে ১১০ জন, আর সাভারে ১০০০+ জন। হ্যাঁ ১০০০ জন, সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী মৃতদেহের সংখ্যা ৫০০ শতাধিক, আর নিখোঁজ আরো ৫০০ শতাধিক। আমি এত আশাবাদী হতে পারছি না যা ৫০০ জনের প্রত্যেকেই খুঁজে পাওয়া যাবে, তাই আমার হিসাবে মৃতের সংখ্যা ১০০০ জনই। এর বিনিময়ে সরকার একটাকাও ট্যাক্স পাবে না। কারন -
"পোশাক শিল্প এক্সপোর্ট অরিয়েন্টেড হওয়ার কারনে, পাঁচ বছর পর্যন্ত ট্যাক্স সুবিধা পায়। (ঐ বছর এর হিসেব টায় একটু ভুল হতো পারে) মালিকেরা যেইটা করা, তা হইলো, ঐ ফ্যাক্টরি টারে,ট্যাক্স হলিডে
এক্স্পায়ারী পর্যন্ত প্রফিটেবল দেখায়। তারপর যখন ট্যাক্স হলিডে শেষ হয়,ওই সেম জায়গায় সেম ফেক্টরিকে তারা নাম পাল্টায় এবং আরেকটা নামে এনলিস্ট করে।এবং পুরান ফ্যাক্টরি কে লুজিং হিসেবে দেখায়। এবং
এক টাকাও দেশ কে কর্পোরেট ট্যাক্স দেয় না তারা।" ( সূত্রঃ জিয়া হাসান )
তাহলে দেখা যাচ্ছে বিজিএমই এর মত একটা অথর্ব সংগঠন আক্ষরিক অর্থেই শুধুই মালিকদের স্বার্থ দেখে যাচ্ছে, শ্রমিকরা যেনো খরচের খাতায়। বেশী দূরে যাবার প্রয়োজন নেই, পার্শ্ববর্তীদেশ ভারতেই সরকারের নির্দেশনা অনিযায়ী প্রত্যেকটি শিল্পকে দূর্যোগ মোকাবেলায় তহবিল রাখা বাধ্যতামূলক।যা তদারক করবে সংশ্লিষ্ট সংগঠন। সাভার ঘটনার পর বিজিএমই ও একই উদ্দ্যেগ নিচ্ছে, কিন্তু তা আগে নেয়া হয়কি কেন? বিজিএমইতে আমাদের দেশের কথা বাদ দিলাম, বাইরের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করা কর্তা ব্যাক্তিরা নিশ্চই আছেন, তারা কি লেবার ল বা হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজম্যান্ট নামের কোন বিষয় কি কোর্সে কোন দিন পাননি? তারপর এই গাফলতি কেনো? এর জবাবদিহিতা করতে হবে বিজিএমইকেই।
এরপরও কথা থেকে যায়, এত প্রানহানির ও ক্ষয়ক্ষতি, দেশের সম্মানহানির পরও কি সরকার এবং আমলাদের হুশ ফিরবে?? নিকট অতীতেই আমি দেখেছি, কোন দূর্ঘটনা ঘটলে বেশকিছু দিন হইচই হলেও, ক্রমান্বয়ে সব চুপচাপ। কারো হাতের ইশারায় সবই স্তব্দ হয়ে যায়। তাহলে শ্রমিকদের এই প্রান নিয়ে ছিনিমিনি খেলা আর কতদিন?? এরকই চলতে থাকলে, আমাদের এই নব্য দাস প্রথা বন্ধের আন্দোলন করা ছাড়া আর কোনও উপায় থাকবে না।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা মে, ২০১৩ বিকাল ৫:৫৪