আমাদের একমাত্র সন্তান সাদিতকে ঘুম পাড়াতে গিয়ে সিথিও ঘুমিয়ে পড়েছে। ঘুমন্ত নারীটির মুখের দিকে তাকাতেই নিজেকে সুখী মানুষ মনে হয়।
সিথি আমার নিঃসঙ্গ জীবন বদলে সাজানো সংসারের সন্ধান দেয়া এক পরশ পাথরের নাম। আজ তাকে ছাড়া একটি দিন কাটানোর কথা ভাবতে পারি না।
বৃহস্পতিবারের রাত। আগামীকাল সকালে অফিসে যাওয়ার ব্যস্ততা নেই। টেবিল ল্যাম্প অন করে কাগজ-কলম নিয়ে টেবিল-চেয়ারে বসি। আমার জীবনে সিথিকে নিয়ে আদ্যপান্ত লিখতে বসি আমাদের ভালোবাসার গল্প।
ইন্টারমিডিয়েট পড়–য়া অজিতকে বাসায় গিয়ে ইংরেজি পড়াতে শুরু করি। ভালো বেতনের টিউশনিটি অর্থকষ্ট অনেকাংশে লাঘব করে।
অজিতের মাকে খালাআম্মা বলে ডাকি। ওই মানুষটির আদর-স্নেহ আর ছাত্রের প্রচ- শ্রদ্ধাবোধে প্রায় ভুলে গিয়েছি, এই শহরে আমি বড় একা।
জগতে আপন বলে কেউ নই। পূজাসহ তাদের সব অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকি। এমনকি ঈদের দিনেও খালাআম্মা আমাকে পোলাও-কোর্মার স্বাদ দিতে ভোলেননি।
অজিতের বাবা ইহলোক ছেড়েছেন প্রায় দশ বছর।
এই পরিবারের আরেকজন সদস্যের সঙ্গে এখনো কথা হয়নি। ছাত্রের সঙ্গে গল্পে গল্পে সেই মানুষটি সম্পর্কে জেনে নিয়েছি।
অজিতের চেয়ে সিথি পাচ বছরের বড়। তিন বছর আগে তার বিয়ে হয়েছে। চট্টগ্রামে শ্বশুরবাড়ি।
অজিতের জামাইবাবুর পরিবার বেশ অবস্থা সম্পন্ন। বিয়ের বছরই সিথির বর ইটালি চলে যায়।
স্বামীর বাড়ির লোকজন মেয়েটিকে বিয়ের পর বাবার বাড়ি আসতে দেয়নি।
মেয়েকে আনার উদ্যোগ মা নিলেও সিথির সায় মেলে না। মাকে বোঝায়, আমার তো কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। শুধু শুধু এ বাড়ির লোকজনের সঙ্গে ঝামেলা বাধিয়ে লাভ কি?
অজিত ও খালাআম্মার মুখে এসব কথা শুনে বুঝতে পারি, মেয়েটি ওই বাড়িতে ভালো নেই। এক তরুণীর নিঃসঙ্গ জীবনের কথা ভাবতে থাকি, মনের মধ্যে একটি মায়াবি মুখশ্রীর ছবি একে ফেলি।
অনার্স ফাইনাল পরীক্ষা দিয়েই চাকরির জন্য জোর প্রচেষ্টা চালাতে থাকি।
অজিতসহ মোট তিনটি টিউশনির টাকায় মাস পার করতে হয়। ব্যাচেলর বাসার রুম ভাড়া ও তিন বেলার আড়াই মিলের খরচ পরিশোধ করা লাগে। অবশিষ্ট টাকা চাকরির অ্যাপ্লিকেশনের ব্যাংক ড্রাফট ও যাতায়াত খরচ বাবদ ব্যয় হয়।
অজিতের ইন্টামিডিয়েট পরীক্ষা খুব কাছে হওয়ায় ওই বাসায় নিয়মিত যাওয়া হচ্ছিল না।
এক দুপুরে প্রিয় ছাত্রটি আমার বাসায় এসে হাপাতে থাকে। মাত্রা অতিরিক্ত উচ্ছ্বাসের জন্য ভালো ভাবে কথা পর্যন্ত বলতে পারছিল না।
স্যার, চলেন স্টেশনে, দিদি আসছে।
নির্ধারিত সময়ের অনেক পর প্রতীক্ষার ট্রেনটি স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে এলো।
যাত্রীরা তাড়াহুড়া করে বগি থেকে নামছিল।
বোনটি দৌড়ে এসে অপেক্ষারত ভাইকে জড়িয়ে ধরলো।
দুজনের চোখে আনন্দ অশ্রু।
দৃশ্যটি দেখে আমার চোখে জল চলে এলো।
অজিত তার দিদিকে আমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল।
সিথি হাসলো।
দাদা, আপনার গল্প অনেক শুনেছি।
ওর কথা আমার কানে ঢুকলো না। তাকে দেখে অবাক ছিলাম। মানুষ এতো সুন্দর হয়! হতে পারে? আমার কল্পনাও হার মেনেছে। তবে তার চেহারায় জীবনের সঙ্গে তীব্র যুদ্ধের ছাপ স্পষ্ট।
অজিতের ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা শেষ হলো। তবুও কারণে-অকারণে ওই বাসায় যেতে ইচ্ছা করে। বাড়ির পুরনো দুজনের চেয়ে নতুন মানুষটির জন্য বিশেষ টান অনুভূত হয়। মনকে বাধা দিই ও বোঝাই, এমন স্বপ্ন দেখা উচিত নয়। খালাআম্মা-অজিতের বিশ্বাস ভাঙা যাবে না।
কিন্তু অবাধ্য মন সিথিকে দেখার জন্য অস্থির হয়ে ওঠে। কোনো বাধাই মানে না।
ওই বাসায় গিয়ে সবার সঙ্গে জমিয়ে আড্ডা দিই। কিন্তু তার সঙ্গে কথা বলতে সংকোচ লাগে।
আলাপের এক পর্যায়ে সিথি বললো, দাদা, এ বছর বিএ পরীক্ষা দিতে চাচ্ছি। ইংরেজিটা একটু পড়াতে হবে।
এই অনুরোধের বিপরীতে না বলার শক্তি আমার ছিল না।
কয়েকদিন ধরে এ বাসায় আসার জন্য ছুতো খুজছিলাম। সুযোগটা হাতের নাগালে পেয়ে রাজি হয়ে গেলাম।
আমার উচ্ছ্বাস দেখে সে লাজুক ভাবে হাসলো।
আমি ধন্য হয়ে গেলাম।
দুজনার অব্যক্ত কথাগুলো আমাদের আচরণের মাধ্যমে ব্যক্ত হয়ে যায়।
অজিতদের বাসায় আবারও নিয়মিত যাতায়াত শুরু হয়।
সিথিকে কতোটুকু ইংরেজি শেখাতে পেরেছি কিংবা সে কতোটা শিখতে পেরেছে তাতে যথেষ্ট সন্দেহ ছিল। এই সময়ে দুজন দুজনকে প্রবল ভাবে জানতে ও বুঝতে চেষ্টা করি।
চাপা স্বভাবের মেয়েটি আলাপে আলাপে অনেক ব্যক্তিগত কথা বলে।
তার জীবনের গল্প শুনে আফসোস হয়। সৃষ্টিকর্তা রূপে-গুণে এতো ঐশ্বর্যবতী করা সত্ত্বেও স্বামী-সংসারের সুখ কপালে রাখেনি।
অন্যদিকে আমার একাকী জীবনের লড়াইয়ের কথা শুনে তার দুই চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে ওঠে।
আমার জন্য কারো চোখে জল। পরিস্থিতিটি আমাকে শিহরিত করে।
একদিন আমার হাতের পিঠে হাত রেখে সিথি বললো, তুমি একা নও। তোমার জীবনের সঙ্গে আমার জীবন গাথতে চাই।
একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানে অফিসার পদের পরীক্ষায় লিখিত উত্তীর্ণ হই। ডাকযোগে পাওয়া ভাইভা কার্ডটি নিয়ে মহানন্দে সিথির সঙ্গে দেখা করতে যাই। সিথি বাসায় একা। অজিতকে নিয়ে খালাআম্মা এক আত্মীয়ের বাসায় গেছেন।
শাড়ি পরা সিথির দুই হাতে শাখা ছিল না। কপাল-মাথায় সিদুরের ছোয়া অনুপস্থিত। চোখ না ফেরানোর মতো রূপ ছিল। ভেতরে তীব্র কাপন অনুভব করি।
সিথির কিছু সৌন্দর্য বর্ণনা করা সম্ভব হয় না। তেমনি এ রূপের কোনো উপমা খুজে পেতে ব্যর্থ হই।
তাকে এতো আনন্দিত দেখতে খুব ভালো লাগলো। ওর গলায় বাধ ভাঙা উচ্ছ্বাস ছিল। সে বললো, আজ আমি স্বাধীন। কোনো বাধা নেই।
তার মুক্তির ঘোষণায় আমার বুক থেকে বিরাট পাথর নেমে গেল। আমি একটি বাধা অতিক্রম করলাম। আমার খুশির সংবাদটি আর চেপে রাখতে পরিনি।
সুসংবাদটি শুনে তার আনন্দের মাত্রা দ্বিগুণ হয়ে যায়।
নিজেকে সামলে প্রশ্ন করলাম, কোথাও বের হচ্ছ?
লাজুক হেসে মাথা নেড়ে বললো, না, তোমার অপেক্ষায় ছিলাম। একটু থেমে আবার বললো, মন বলছিল তুমি আসবে। আজ তোমার জন্য সেজেছি। সে আমাকে ঘেষে সোফার হাতলের ওপর বসলো।
নারী শরীরের মাতাল করা ঘ্রাণে মন-শরীর দুই-ই উন্মাদ হয়ে ওঠে। মুহূর্তে চিত্র বদলে যেতে শুরু করে। দুর্দান্ত সাহসী পুরুষ হয়ে উঠলাম।
সেও সহসা এগিয়ে এলো।
বাসা থেকে বের হওয়ার সময় লজ্জা জড়ানো গলায় সিথি বললো, ভাইভা কার্ডটির ফটোকপি দিও। ওই মন্ত্রণালয়ে বড় পদে আমার মেসোমশাই কর্মরত। দেখি কিছু করা যায় কি না।
সব কিছু ঘোরের মতো লাগে, কোনো সুস্বপ্নও এতো কিছু দিতে পারে না।
কার্ডের ফটোকপিটি পরে তাকে পৌছে দিই।
ওই ঘটনার পর অনেক দিন সিথির সামনে দাড়ানোর সাহস পাই না। ভীষণ ছোট মনে দিনগুলো কাটে। তবে আমার দিন-রাতের চব্বিশ ঘণ্টা কাটে ওই প্রতিমাকে ভেবে ভেবে। তাকে ঘিরে স্বপ্ন দেখে।
এক সকালে সিথিকে আমার বাসায় দেখে বিস্ময়ে দুই চোখ কপালে ওঠে।
আনন্দ আর লজ্জা, দুই-ই তাকে দখল করে ছিল।
আলাপের এক পর্যায়ে আমতা আমতা করতে শুরু করে, আমি মা ... হতে চলেছি ...।
কথাটি শুনে আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো। আমি কি বলবো তা ভেবে পেলাম না। এখন কি করবো, আমার কি করা উচিত?
সেদিনের আদিম সুখের মত্ততা আজ এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি করলো। আমাদের ভালোবাসার পথে সব অন্তরায় এতো অল্প সময়ে সমাধান করা কঠিন ব্যাপার হবে। সিথির সামনে নিজেকে ত্বরিত গুছিয়ে আনার চেষ্ট করি।
আমাকে চিন্তিত দেখে আশ্বস্ত করলো, ভয় পেও না। এই সন্তানকে মুসলমানের সন্তান পরিচয়ে বড় করবো। পরিবারের পছন্দ করা পাত্রকে ভালোবেসে প্রতিদানে ভালোবাসা পেতে ব্যর্থ হয়েছি। সেই আমি আবার ভালোবাসার দুঃসাহস দেখিয়েছি। অতৃপ্ত জীবনে তুমি তৃপ্তির পরশ দিয়েছ।
সিথির দুই চোখ অশ্রুতে সজল।
ধর্ম বিষয়ে তার চিন্তা-ভাবনা আমার বুক থেকে আরেক দফায় পাথর নামায়। আমিও তাকে ভীষণ ভালোবাসি। এ কথাটি ওই চাদ-সূর্যের মতো শতভাগ সত্য। তারপরও নিজের ভেতরে খুব ভয় কাজ করে, নিশ্চয় খালাআম্মা ও অজিত আমাকে বিশ্বাসঘাতক ভাববেন। গত কয়েক বছর ওই দুজনের ভালোবাসা চলার পথের পাথেয় ছিল।
চিন্তার সাগরে কূলÑকিনারা মেলে। বাধা-বিপত্তি, দ্বিধা-দ্বন্দ্ব উতরে ভালোবাসাকে বড় করে দেখি। বুকে প্রবল সাহস জড়ো করে বলি, চলো, আমরা বিয়ে করে ফেলি।
তাকে খাওয়ানো-পরানো নিয়ে কোনো রকম দুশ্চিন্তা তখন মাথায় আনিনি।
আমার প্রস্তাব শুনে সিথি মাথা নেড়ে সম্মতি দিল।
সঙ্গে সঙ্গে ফোন দিয়ে বন্ধু নজিব ও জামিকে আমার বাসায় আসতে বললাম। দ্রুত তৈরি হয়ে নিলাম। হাতের জমানো টাকাগুলো নিয়ে পরিচিত এক আইনজীবী বড় ভাইয়ের বাসার দিকে ছুটলাম।
আমাদের বিয়ে সম্পন্ন হওয়ার ক্ষেত্রে আইনি বাধা দূর করতে বেশ কয়েকদিন ব্যস্ত থাকতে হলো। বিয়ের কার্যাদি সম্পন্ন হওয়ার পর খালাআম্মার সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। তাকে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করলাম।
বিচক্ষণ মা সব কিছু বুঝতে পারেন। দুজনকে বুকে টেনে নিলেন। বললেন, আমার আশীর্বাদ তোমাদের সঙ্গে থাকবে।
ওনার দুই চোখে জমা করা অশ্রু দেখে আমার দুই চোখ পানিতে ভরে ওঠে।
তারপর মুখে হাসি টেনে প্রসঙ্গ বদলান, আরেকটি খুশির সংবাদ আছে।
দুজনে এক সঙ্গে জানাতে চাই।
কি?
শুনে মায়ের কণ্ঠে আনন্দ আর ধরে না। ঘণ্টাখানেক আগে সিথির মেসো ফোন দিয়েছিলেন। বাবা, তোমার চাকরিটা হয়ে গিয়েছে। এখন তারা জয়েনিং লেটার পাঠাবে।
সেই থেকে শুরু ...।
দুজন সংসার বিহীন মানুষ একটি সংসারের সন্ধান পেলাম। আর সৃষ্টিকর্তা স্বর্গ সুখে তা পূর্ণ করে দিল।
চারদিক থেকে ফজরের আজান শোনা গেল।
সিথির উপস্থিতি টের পেয়ে লেখায় বিরতি টানলাম।
সে চায়ের কাপ হাতে নিয়ে টেবিলের কাছে এসে আমার দিকে কাপটি এগিয়ে দিয়ে বললো, এসব লেখার জন্য রাত জাগার কি দরকার? শুধু শুধু পাগলামি করো। শাহীনের বাবা, ওজু করে নামাজ পড়ে নাও। বলে সে চলে যেতে উদ্যত হলো।
তার শাড়ির আচলে টান দিলাম। তারপর টেনে এনে বুকের মধ্যে চেপে ধরলাম।
এই ছোয়া, এই অনুভূতি সেই প্রথম দিনের মতো আজও দুজনকে কাপিয়ে যায়।