কিস্তি-৩
রাস্তায় মানুষ আর মানুষ। একেবারে গিজগিজ। যে যার মতো ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটছে।
রোদের কি তেজ! গায়ে ভরা যৌবন নিয়ে দুরন্ত দ্যুতি ছড়াচ্ছে। এ সময়ে এত টগবগে থাকার কথা নয় সূর্যের। মাথার ওপর যেন তপ্ত কড়াই।
হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসে হৃদ। ঘড়ির দিকে তাকায়। সাড়ে ন’টা ছুঁইছুঁই। হাতে সময় খুব কম। ক্লাস দশটায়। পাঁচ মিনিট আগে পৌঁছতে পারলে ভাল হয়। ওই হিসেবে মাত্র ২৫ মিনিট বাকি। যেভাবেই হোক এ সময়ের মধ্যেই পৌঁছতে হবে। বাসস্ট্যান্ডে যেতে লাগবে ৫-৬ মিনিট। সঙ্গে সঙ্গে বাস পেলে সময় মতো কাসে হাজির হওয়া যাবে। কোন কারণে এক দু’টি বাস মিস করলে সর্বনাশ। আর যদি জ্যামে পড়া যায় তবেই হয়েছে- এক্কেবারে ডান্ডি ফটাস। ক্লাস ভেস্তে। রাস্তায়ই ঘেমে নেয়ে একাকার।
ভরসা পায় না হৃদ। মনে শঙ্কা দানা বাঁধে। আজ আবার কোন মহামান্য এ রাস্তা দিয়ে যাবে না তো? তবে তো দু’ঘণ্টার জন্য নড়াচড়া বন্ধ। বাসের হেলপাররা এটা নিয়ে খুব মজা করে। এমন পরিস্থিতিতে ড্রাইভারকে উদ্দেশ্য করে বলে- ওস্তাদ স্টার্ট বন্ধ করেন। বড় লোকের ছোড গাড়ি না যাওয়া পর্যন্ত যাওন যাইবো না। দুইডা ট্যাকা দেন একটা পালমাল নিয়া আহি। আয়েশ কইরা দুইডা সুখটান দেই।
একটা কষ্টের স্মৃতি মনে পড়ে হৃদের। অসুস্থ দাদীকে নিয়ে এম্বুলেন্সে করে হাসপাতালে যাচ্ছিল। কোন গাড়ি- এমন কি রিকশা পর্যন্ত সাইড দিচ্ছিল না এম্বুলেন্সকে। এম্বুলেন্সের গলা ফাটানো চিৎকার কারও কানে যাচ্ছিল না। এরই মধ্যে মহামান্য কেউ আসছেন তাই সব গাড়ি বন্ধ। কত অনুনয় বিনয় করে পুলিশের পায়ে পর্যন্ত ধরেছে হৃদের বাবা। বলেছেন- দয়া করে এম্বুলেন্সটাকে যেতে দিন। আমার মা মুমূর্ষু রোগী। দেরি হলে তিনি বাঁচবেন না। তাদের পাষাণ হৃদয় গলেনি। যেতে দেয়নি এম্বুলেন্স। বলেছে- অসুস্থ রোগীর জীবনের চেয়ে তার চাকরি বড়। পথেই মারা গেছেন দাদী। সেই কষ্ট আজও ভোলেনি হৃদ।
একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে হৃদের বুক থেকে। সিদ্ধান্ত নেয় রিকশায় করে ভার্সিটিতে যাবে।
একটি খালি রিকশা এগিয়ে আসতেই হৃদ বলে- এই যাইবা?
কই যাইবেন?
ঢাকা ভার্সিটি।
রিকশাওয়ালার দৃষ্টি হৃদের আপদমস্তকে। যেন রিকশায় ওঠার যোগ্য কিনা পরখ করে নিচ্ছে। তাড়া দেয় হৃদ- কি হলো যাইবা?
রিকশাওয়ালা আবার জানতে চায়- কই যাইবেন?
ঢাকা ভার্সিটি।
রিকশাওয়ালা সামনের দিকে তাকায়। তুচ্ছ তাচ্ছিল্যে বলে-
না যামু না।
কেন, যাইবা না কেন? চলো পাঁচ টাকা বেশি দিবো।
না, ওইদিকে যামু না। রাস্তায় বহুত জ্যাম।
দুই গজ দূরে দাঁড়িয়ে আছে অহনা। তাকে দেখতে পায় রিকশাওয়ালা। তার মুখে আলোকছটা। সামনে গিয়ে বলে- আফা কই যাইবেন?
ঢাকা ভার্সিটি?
হাসি মুখে রিকশাওয়ালা বলে- চলেন।
কত নিবে?
দিয়েন বুঝ কইরা।
না, না বলে যাওয়া ভাল।
কইলাম তো দিয়েন। আপনে আমারে ঠকাইবেন না, এই বিশ্বাস আছে। ওডেন।
কিন্তু ভাড়া না মিটিয়ে যাওয়া...
আফা হোনেন, এক যুগ ধইরা রিকশা চালাই। মানুষ দেখলেই কইবার পারি- কে ঠকাইবো আর কে ঠকাইবো না। ওডেন তো।
আমতা আমতা করে অহনা। দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভোগে। সিদ্ধান্ত নিতে একটু সময় নেয়। ঘড়ির দিকে তাকাতেই বুকের ভেতরটা যেন ছ্যাৎ করে ওঠে। তাড়াতাড়ি ওঠে বসে রিকশায়। বলে-
ভাই, হুডটা উঠাইয়া দেন।
রিকশাওয়ালা রিকশার হুড উঠিয়ে প্যাডেল ঘোরায়।
মাথায় রক্ত চড়ে হৃদের। ইচ্ছা করে রিকশাটাকে থামিয়ে ব্যাটাকে কষে একটা চড় বসিয়ে দেয় গালে। একটু এগোতেই একটি খালি রিকশা পেয়ে যায় সে। কোন কিছু না বলে চড়ে বসে। বলে- যাও, ভার্সিটি যাও।
ভাড়া মিটাইবেন না ভাইজান?
লাগবে না। যাও।
না, ভাড়া মিটাইয়া লন।
আচ্ছা ঠিক আছে বলো- কত নেবে?
বিশ ট্যাকা।
আচ্ছা দিবো। এখন যাও। শোন, ওই যে সামনে রিকশাটা দেখছো- ওটাকে ধরো। ধরতে পারলে পাঁচ টাকা বেশি দেবো। পারবে না?
কন কি পারুম না? কোন রিকশাডা? ওই যে লাল জামা পরনে আফার রিকশাডা?
হ্যাঁ, হ্যাঁ। ধরো, ওটাকে ধরো। ওটার সঙ্গে সঙ্গে যাবে। পারবে তো?
পারুম না ক্যান?
সামনের রিকশাটাকে ধরতে পারে না রিকশাওয়ালা। বারবার তাড়া দেয় হৃদ- কি হলো, ধরো, ধরো। আরও জোরে চালাও।
প্রাণপণ চেষ্টা করেও হৃদের রিকশা সামনেরটাকে ধরতে পারে না। হতাশ হয়ে হৃদ বলে- পারলে না।
ক্যাম্পাসে এসে রিকশা থামে। ব্যাগ থেকে বিশ টাকা বের করে রিকশাওয়ালাকে দেয় অহনা। রিকশাওয়ালা যেন আকাশ থেকে পড়ে।
এইডা কি দিলেন? তিরিশ ট্যাকা দেন।
কেন, তিরিশ টাকা দেবো কেন?
তিরিশ ট্যাকা ভাড়া তাই দিবেন।
বলেন কি! আমি সব সময় বিশ টাকায় আসি। কালও বিশ টাকায় এসেছি।
কাইল তো ২৫ ট্যাকা কেজি চাইল কিনছি। আইজ গিয়া দেহি ৪০। মিনিটে মিনিটে জিনিসপত্রের দাম বাড়তাছে আর আপনে ২৪ ঘণ্টার খবর লইয়া পইরা আছেন। দেন, আরও ১০ ট্যাকা দেন।
অসহায়ের মতো ১০ টাকা বের করে এগিয়ে দেয় অহনা। এ সময় হৃদ এগিয়ে এসে বাধা দেয়। অহনার হাত থেকে নোটটি তার হাতে নেয়।
হৃদের দিকে তাকায় অহনা। মনে পড়ে- ও যখন রিকশা ভাড়া করছিল তখন এই ছেলেটিও এই ভার্সিটি আসবে কিনা রিকশাওয়ালার কাছে জানতে চাইছিল। রিকশাওয়ালা তাকে বাদ দিয়ে অহনাকে নিয়ে আসে।
এক মুহূর্ত কি যেন ভাবে অহনা। তারপর কোন কথা না বলে টাকা ফেলেই হনহন করে ছুটে চলে কাসের উদ্দেশে।
চলব
ধারাবাহিক উপন্যাস নগ্নবেলা কিস্তি-২
ধারাবাহিক উপন্যাস নগ্নবেলা কিস্তি-১