প্রথমে কিছুই বুঝতে পারলাম না আমি কিছুক্ষণ পর অনুভব করলাম আমার গালের চামড়া জ্বলছে। আমি হা করে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে রইলাম। এতটা অবাক হয়েছি আমি, ছেলেটা আমার হাতটা ধরে রেখেছে তা যে ছাড়িয়ে নিতে হবে আমাকে সেটা মাথায় ঢুকলো না।
সামান্য সুইসাইডের কথায় কেউ এভাবে থাপ্পড় দেয়?
এই ছেলেটার সাথে আমার বন্ধুত্বের শুরুটুকু বলি, এক বিতর্ক প্রতিযোগিতায় পরিচয় হয়েছিল আমাদের, আগে দেখিনি একদম চিনিনা এই ছেলেকে তবুও কথার শুরু, নাম রূপম। রূপম কবিতা লিখে আর আমি লিখি গল্প, প্রথম দেখাতেই কথার ডালপালা মেলে দিলাম, গলার রগ ফুলিয়ে চিত্কার চেঁচামেঁচি। কথার বিস্তৃতি এত বেশি ছিল যে সমাপ্তিটুকু টানতে ফেসবুকের শরণাপন্ন হতেই হল কিন্তু ছোটগল্পের মত শেষ হইয়াও হইলোনা শেষ নীতিতে বিশ্বাসী আমরা কথামালা বুনে যেতে লাগলাম একের পর এক, অবিরাম বকবক বকবক বকবক।
সম্পর্কটুকু ফেসবুকের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলো না, ছড়িয়ে গেলো ছবির হাটের চায়ের দোকানে, পাব্লিক লাইব্রেরীর ক্যান্টিনে, টিএসসির ডাসে, চারুকলার বকুলতলা থেকে শুরু করে আজিজের তক্ষশিলা পর্যন্ত। ওর সাথে কাটানো সময়টুকু
ঝগড়া, গালিগালাজ আর মারামারিতেই কিভাবে যেনো পার হয়ে যেতো, ওর অসহ্যকর একটা অভ্যাস সারাক্ষণ মোবাইল টিপাটিপি। আমরা দুজনেই ছ্যাকা খাওয়া পাবলিক আমাদের প্রথম ভালবাসা আমাদের খুব অবহেলা ভরে ফেলে চলে গিয়েছিল, তাই আমাদের বন্ধুত্বে আনন্দ আর বিষাদের মাত্রা প্রায় এক ছিল....রূপম নির্লিপ্ত হয়ে গিয়েছিল ঐসব ব্যাপারে কিন্তু আমি পারিনি ফ্যাঁচফ্যাচ করে মাঝে মাঝে কাঁদতাম। দুজনের কাছেই লাইফটা পেইনফুল ছিল শুধু পার্থক্য একটাই রূপম বাঁচতে চাইতো আর আমি ঐ পাড়ে যাওয়ার পায়তারা করছিলাম।
তার ফলাফল হিসেবে আজ গালে চড়!
আমার এতটা অভিমান হলো যে আমি ভুলে গেলাম শরীরে রক্ত না থাকা আমার ঠাণ্ডা হাত গরম করে দেয়ার জন্য ছেলেটা সবসময় আমার হাত ধরে বসে থাকে। ভুলে গেলাম যে, যেদিন দেখা হয় শাহবাগ থেকে গুলশান পর্যন্ত আমাকে পৌছে দিয়ে ছেলেটা হলে ফিরে। সবকিছু ছাপিয়ে আমার অভিমান বেড়ে গেলো....আমি চলে আসলাম।
২টা দিন কথা হলোনা আমাদের একদম, প্রচণ্ড খারাপ লাগা নিয়ে ডায়রির এক কোনে লিখলাম,
'রূপম মে বি আমি তোকে মিস্ করছি'।
রাতে মেসেজ আসলো, কাল ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল, মুভি দেখবি?
মেসেজ পেয়ে সব অভিমান ভুলে লাফাতে লাফাতে কল দিলাম,
- হারামি
- বল
- সত্যি দেখবি মুভি?
- আরে তুই কি আমার বেয়াই যে মশকরা করবো, আয় তারপর মুভি দেখি।
- কি কি মুভি? শিডিউল বল। আমরা কি টানা ৭দিন মুভি দেখবো?
- তুই যদি চাস ৭দিনের ৪টা শো দেখবো।
- ইয়াহু ইয়াহু কালকে সকাল ১০টায় পাব্লিক লাইব্রেরী, ওকে? তুই রাত জাগবি না কিন্তু!
এই বলে ফোনটা রেখে দিলাম।
পরের দিন সকাল থেকে শুরু হলো ২ মুভিখোরের মুভি দেখা। দৌড়িয়ে এক অডিটোরিয়াম থেকে আরেক অডিটোরিয়ামে যাওয়া, টিকেট কাটার হুলস্থুল, গালভর্তি একগাদা পপকর্ণ আর মুভি দেখতে দেখতে আমার শীতল হাতটা আরেকজনের ধরে রাখা। ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের মুভি বলে কথা, প্রত্যেকটা মুভিই ছিল অসাধারণ পর্যায়ের ।
শীতের সকালে ঘুম থেকে তড়িঘড়ি করে উঠে ছুটে আসা সব মিলিয়ে প্রবল উত্তেজনা। ৭টার শো দেখা শেষে রাত ৯টা বাজতো, রূপম একটা বেনসন ধরিয়ে শাহবাগ থেকে গুলশান পর্যন্ত পৌছে দিয়ে আমাকে তারপর হলে ফিরতো। রিকশায় বসে বসে সারাদিনে দেখা মুভির রিভিউ নিয়ে আলোচনা করা, ঝগড়াঝাটি আর মারামারি তো ফ্রি। রিকশাওয়ালা মামারা আমাদের কীর্তি দেখে মজা পেতো খুব, আমরাও সময়কে উপভোগ করছিলাম।
ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে অনেক মজা পেলাম, ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল শেষ হলেই চিলড্রেন ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল। মুভির নেশা এতটাই পেয়ে বসেছিল যে চিলড্রেন ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের একটা মুভি ও আমরা মিস্ করবো না বলে ঠিক করলাম।
মুভি দেখে বের হলাম শেষদিন, পাব্লিক লাইব্রেরীর বাইরে যেতেই রূপম একটা সিগারেট ধ্বংস করার পরিকল্পনা করলো। আমি দাঁড়িয়ে ওর সিগারটে খাওয়া দেখতে লাগলাম, সিগারেট ধরানোর স্টাইলটা সুন্দর। আমি ধোঁয়ার রিং গোনার চেষ্টা
করলাম, কেনো জানি কিচ্ছু ভালো লাগছিলো না আমার। রিকশায় দুজনেই আশ্চর্যরকম চুপচাপ হয়ে বসে রইলাম। রূপম শক্ত করে আমার ঠাণ্ডা হাত ধরে রেখেছে। শীতে
আমি কাঁপছি ভীষন...অদ্ভুত নীরব সবকিছু! আমার চুলগুলো এলো হয়ে বাতাসে উড়ছে, আমি সামলাতে চেষ্টা করছি কিন্তু পারছিনা।
চোখ পড়লো রূপমের দিকে, চোখে অন্যরকম দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে। আমি ওকে আলতো করে ডাকলাম, এরপরে শুধু অনুভব করলাম ১সেকেণ্ডের জন্য উষ্ণ একটা ঠোঁট
আমার শীতল ঠোঁটকে স্পর্শ করলো। ঐ একসেকেণ্ড আমার পৃথিবীটা তোলপাড় করে দেয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল, সেই অন্যরকম অনুভূতি আমার পৃথিবী ভেঙে দেয়ার জন্য পর্যাপ্ত ছিলো...
এসে নিজের রুমে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিলাম, সবকিছু এলোমেলো লাগছিলো আমার, এই অচেনা অনুভূতি আমাকে ওলটপালট করে দিলো। ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমাতে গেলাম
আমি সেই রাতে।
ঘুমভাঙার পর সেলফোন চেক করলাম, দেখি রূপমের কোন টেক্সট নেই অথচ আজ থেকে চিলড্রেন ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল। আমি বুঝলাম ওকে সেই ১সেকেণ্ডের অপরাধবোধ গ্রাস করেছে...কিন্তু আমার কিছুই করার ছিলোনা। আমি আমার
ফোন, ফেসবুক, ইয়াহু মেইল সব বন্ধ করে দিলাম।
পরিস্থিতি ভয়ানক আকার ধারণ করলো, আমার মাঝে ভীষন অস্থিরতা। আমি খেতে পারছিনা ঘুমাতে পারছিনা, যাচ্ছেতাই অবস্থা হয়ে পড়লো আমার। ডায়রিতে লিখলাম,
'কেউ জানেনা কেনো আমার এমন হলো!
কেন আমার দিন কাটেনা, রাত কাটেনা
রাত কাটে তো ভোর দেখিনা
কেনো আমার হাতের মাঝে হাত থাকেনা
কেউ জানেনা....'
আমি বিস্ময়ে লক্ষ্য করলাম যতটা না আমি রূপমকে মিস্ করছি তারচে বেশি করছি ওর শক্ত করে আমার ঠাণ্ডা হাত ধরে রাখাকে। না পেরে ফোন অন করলাম, ফেবুতে গেলাম সবখানে একটাই মেসেজ, 'কোথায় তুই?'
আমি ওকে কল দিলাম,
-কোথায় ছিলি এতদিন তুই? কত খুঁজেছি তোকে আমি ।
- রূপম, কালকে দেখা করবি?
- কালকে গ্রামে যাবো, টিকেট কাটা হয়ে গেছে।
- ঠিক আছে তাহলে থাক।
- না টিকেট ক্যান্সেল করছি, তুই আয় কালকে আমি পরশু
যাবো।
- কালকে মুভি দেখবো আমরা। বাই
ফোন রেখে শিডিউল দেখলাম কি কি মুভি আচ্ছে চিল্ড্রেন ফিল্ম
ফেস্টিভ্যালে, কোরিয়ান ২টা মুভি, ভালো হওয়ার কথা ।
আমি পরদিন একা একা মুভি দেখলাম, Treeless Mountain চোখে পানি এসে বিতিকিচ্ছিরি অবস্থা মুভি দেখে। পরের শোতে একটা টিনেজ প্রেমের গল্পের মুভি, My Sassy Girl। এসব মুভিতে যদিও রূপমের ভয়াবহ এলার্জি আছে তবুও আমি
দুটো টিকেট হাতে বসে রইলাম। একটু পর দেখি রূপম দৌড়ে আসছে। কোন কথাবার্তা হলোনা অডিটোরিয়ামে ঢুকলাম দুজন। মুভিটা নিঃসন্দেহে ভালো ছিলো তবুও পুরোনো প্রেমকে মনে করিয়ে দিচ্ছিল বারবার আমাকে।
যাইহোক মুভি দেখা শেষ করে দুজনে কথা বলতে বলতে হাটতে লাগলাম, বাসস্ট্যাণ্ডে কোন বাস নেই, অনেক মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। রূপমকে দেখলাম চেহারায় নির্লিপ্ত একটা ভাব ঝুলিয়ে রেখেছে।
কথা বলতে শুরু করলাম...
- রূপম তুই এত চুপচাপ কেন আজকে?
-না কিছু না তো
- মোবাইল টিপতেছিস না কেন অস্বস্তি লাগতেছে আমার। তোরে মোবাইল টিপতে দেখে অভ্যস্ত হয়ে গেছি এখন কেমন জানি লাগতেছে। কিছু বলবি?
- এম্নিতেই টিপতেছি না। কিছু বলবোনা।
-আমি কিছু বলবো
- কী?
- আমার হাতটা ধর,খুব ঠাণ্ডা হয়ে আছে।
ও আমার হাত শক্ত করে ধরে রাখলো,যেনো ছাড়বেনা আর কখনো। বাস আসলো আমার, আমি হাত ছাড়িয়ে পিছনে না তাকিয়ে উঠে চলে আসলাম বাসে। বাসায় ফিরে টেক্সট দিলাম,
'রূপম তুই আমাকে মিস্ করবি'
আমার গাল বেয়ে উষ্ণ স্রোতের ধারা গড়িয়ে পড়তে লাগলো, আমি বুঝলাম ভালোবেসে ফেলেছি রূপমকে ।
ব্যাপারটা সম্পূর্ণ অসম্ভব ছিলো, আমরা আমাদের প্রথমজনের কাছে এতটা কষ্ট পেয়েছি, আমাদের হৃদয় এতটাই ভেঙেছে যে ঐ ভাঙা হৃদয় নতুন কাউকে দিয়ে ভালোবাসার আহবান করার ক্ষমতা আমাদের কারোই ছিলো না।
আমার প্রথম হৃদয় ভাঙার পর আমি ৩টা বছর একদম সন্ন্যাসিনীর জীবনযাপন করেছি কে জানতো এভাবে ভালোবেসে ফেলবো রূপমকে, যে কিনা কোনদিন সাড়া দিবেনা আমাকে। রূপম বুঝে ফেলেছিলো সব, আমাকে কষ্ট পেতে দেখে ও নিজেও খুব কষ্ট পাচ্ছিলো কিন্তু ওর কিছুই করার ছিলো না, ওর ভালবাসার পেয়ালা সম্পূর্ণ নিঃশেষ হয়ে গেছে বহু আগেই....
ইয়াহুতে নক করলো,
- আমি কি তোকে খুব বেশি পেইন দিচ্ছি?
- না কিসের পেইন, আমি ভাল আছি।
- তোর ক্যান মনে হয় আমি এত কেয়ারিং, তোকে আগলে রাখি? সব জেনেশুনে তুই আমাকে ভালবাসতে গেলি কেন?
- রূপম আজাইরা প্রশ্ন করিসনা তো কেঁদেকেটে একাকার অবস্থা করে ফেলবো কিন্তু।
- আয় তোর হাত ধরে কষ্ট মুছে দেই।
- আমি আসলেই কষ্ট পাচ্ছি খুব।
- ব্লক করে দে। আমাকে না দেখলে সব ঠিক হয় যাবে। তোকে এভাবে কষ্ট পেতে দেখে ভীষন খারাপ লাগছে।
- তুই দে, আমি পারবোনা।
- ওকে আমিই দেই।
লাস্ট চ্যাট টেক্সট পেয়ে আমি কাঁদতে লাগলাম। আমার ভাবনায় কোন ভুল ছিলো না, ভুল ছিলো প্রত্যাশায়, সেই ভুল বেলা শেষের অবেলায় আজ আমাকে কাঁদাচ্ছে।
আমি অঝোরে কাঁদতে কাঁদতে লিখলাম,
I'm a big girl
In a big world
It's not a big thing if You leave me.
But I do feel that I do will miss you much,
Miss u much....
পরিশিষ্ট: রূপম আমাকে ব্লক করে দিয়েছিলো, আমরা কেউ কারো সাথে যোগাযোগ করিনি আর। আমি বুঝে গিয়েছিলাম জীবনটা পাব্লিক লাইব্রেরীর ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের মত রঙিন না যদিও আমি খুব বোকার মত ঐটাকে একটা ফ্রেমে বাঁধতে চেয়েছিলাম। কিন্তু জীবনে মুভির মত এত মানুষ থাকেনা আমি একাই আমার জীবনের সব নিখুঁত একটা জীবন পাওয়ার আশা ছেড়ে দিয়েছিলাম। আমি হয়ে গিয়েছিলাম বকুলতলার নিচে পড়ে থাকা শুকনো পাতার মত। আমি সবকাজ শেষে ক্লান্ত শরীরে একটিবার হলেও ভাবি, ভেবে কাঁদি। আমার শরীরে এখনো হিমোগ্লোবিন কম, হাত ঠাণ্ডা হয়ে থাকে কিন্তু সেই হাত ধরার কেউ থাকেনা।
আমি নিজেকে গুটিয়ে ফেলেছিলাম...মীনাকুমারীর শায়েরীর মত আমার জীবনটা যন্ত্রণায় পরিপূর্ণ হয়ে গিয়েছিল।
আমি এক নিরন্তর অপেক্ষায় বসেছিলাম, রূপমকে পাওয়ার কঠিন তপস্যায়....সেই তপস্যা কারো উপেক্ষায় শেষ হয়ে গেলো ।
বাইরে আজ বৃষ্টি হচ্ছে বেশ বৃষ্টি। আমি বৃষ্টিতে ভিজিনা বহুদিন
হলো,চোখেই আমার বরষা......
'ওগো বৃষ্টি আমার চোখের পাতা ছুঁয়োনা
আমার এত সাধের কান্নার দাগ ধুঁয়োনা
সে যেনো এসে দেখে পথ চেয়ে তার কেমন করে কেঁদেছি......'
প্রথম প্রকাশঃ সচলায়তন
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই জুলাই, ২০১২ দুপুর ১:০১