এ যুগে বেশিরভাগ মানুষই দুটি জীবন একসাথে পরিচালনা করে।একটি বাস্তব জীবন অন্যটি ভার্চুয়াল জীবন বা অনলাইনে যাপিত জীবন।বাস্তব জীবনের সাথে এখন এ ভার্চুয়াল জীবনটি একসাথে মিশে গেছে। কিন্তু বাস্তব জীবনের নানা সমস্যার সধানের নানা ধরনের উপায় থাকলেও অনলাইনে অজ্ঞতার কারনে অনেকি সমস্যায় পড়েন এবং তার জন্য কোন উপায় খুঁজে পান না।ফলে ঝামেলা না কমে বরং বাড়ে। নিচের ঘটনা দু’টি পড়লেই বুঝতে পারবেন কি ধরনের মারাত্মক সমস্যা হতে পারে।
কেস স্টাডি-১:
জেনী (ছদ্ম নাম) আর রনি (ছদ্ম নাম) ছোটবেলা থেকেই খুব ভাল বন্ধু।একই সাথে খুব মেধাবী,সব বোর্ড পরীক্ষায় বৃত্তি পায়।ঢাকার নামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করে।ধীরে ধীরে খুব স্বাভাবিকভাবেই দু জন দুজনের প্রেমে নিমজ্জিত হয়।জেনীর পরিবার একটু রক্ষনশীল হওয়াতে মোবাইলে খুব একটা যোগাযোগ করতে পারে না।সমস্যার সমাধান হয় ফেসবুকের মাধ্যমে।যখন-তখন চ্যাট,মেসেজ এর মাধ্যমে ভালবাসা আদান প্রদান হয়। আর টিনএজ মনের কন্ডেন্সড আবেগের আবেগময় মেসেজ দিয়ে দু’জনের ইনবক্স পূর্ণ হতে খুব বেশি সময় লাগে না।এভাবেই চলতে থাকে,সুন্দরভাবে কাটে দিনগুলো।একদিন সমাগত হয় এইচ.এস.সি. পরীক্ষা।সবাই মোটামুটি নিশ্চিত ওরা গোল্ডেন এ+ পাবে।সেভাবেই এগুতে থাকে সবকিছু।ম্যাথ পরীক্ষার আগে প্রায় ৯-১০ দিন বন্ধ পায় ওরা।এই সময়েই ওদেরই এক ক্লাসমেট প্রতিহিংসাপরায়ন হয়ে হ্যাক করে বসে জেনীর ফেসবুক একাউন্ট।স্বভাবতই তার একাউন্টে তার আত্মীয়।বন্ধু-বান্ধবের উপস্থিতি ছিল।হ্যাকার এসবের তোয়াক্কা না করেই তার ইনবক্সের সব মেসেজ একে একে প্রকাশ করতে থাকে।এ সময় তার বন্ধুরাও বেশ মজা নেয়।জেনী অবশ্য এদিক থেকে ভাগ্যবতী,সে তার কাছের বন্ধুদের লুকানো বিকৃত পরিচয় পায়।কিন্তু ধীরে ধীরে হ্যাকার একাউন্টে পর্নো ছবি প্রকাশ করতে থাকে।পরিস্থিতি খুব খারাপের দিকে যায়।জেনী আর রনি দুজনেরই পরীক্ষা বন্ধ হবার যোগাড়। ঘটনাটি আমার কাছে আসে এক সময়,আমিও অনেক ব্যস্ততার মাঝে ঐ একাউন্টটি হ্যাক করে আবার জেনীর কাছে ফিরিয়ে দেই।(তখনই মূলত হ্যাকিং সম্পর্কে বিস্তৃত জানতে পারি) অনেক কষ্টে পরীক্ষার একদিন আগে তাদের এ সমস্যার সমাধান হয়।তাদের প্রস্তুতি নেয়ার সময় ছিল না তারপরেও তারা পরীক্ষায় গোল্ডেন এ+ ই পায়। অথচ তাদের পরীক্ষাই বন্ধের উপক্রম হয়েছিল একসময় একটু অসাবধানতার কারনে।
কেস স্টাডি-২:
রুবা(ছদ্ম নাম) একটি মাল্টিন্যাশানাল কোম্পানীর এক্সিকিউটিভ অফিসার। সারা দিন অফিসে কাজ করে। রাতে বাসায় ফিরে নিজের ল্যাপটপে ফেসবুকে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেয়। তার প্রোফাইলে গেলেই তার মেইল এড্রেসটি দেখা যায় বন্ধু হওয়ার প্রয়োজন নাই।একদিন রুবা একটি মেইল পায়।খুব সুন্দর কথা লিখা,সাথে কিছু গান এটাচ করা ছিল,গানগুলো শোনার জন্য প্রেরক বেশ অনুরোধ করেছিল।রুবাও আগ্রহী হয়ে গানগুলো ডাউনলোড করে শুনে,কিন্তু তার অজান্তেই একটি কীলগার আর একটি ভাইরাস যে তার কম্পিউটারে যে ইন্সটল হয়ে গেছে তা সে নিজেও টের পায় না। তার সব মেইল আই।ডি,ফেসবুক একাউন্ট হ্যাক হয়।অফিসের গুরুত্বপূর্ন ফাইল এক মুহুর্তেই ধ্বংস হয়ে যায়।বাকি গল্প সবাই অনুমান করতে পারছেন নিশ্চয়ই।
উপরের দুটি গল্পই রূঢ় বাস্তব। এমন হাজারো ঘটনা প্রতিনিয়তই আমাদের জীবনে ঘটছে বা ঘটার সম্ভাবনা রয়েছে।অথচ একটু সাবধান হলেই এসব অনাকাঙ্খিত ঝামেলা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।
হ্যাকিং এর শুরুটা ১৯৬০ সালে।প্রথমে ভাল দৃষ্টিভঙ্গিতে শুরু হলেও এখন এটি একটি অপরাধ। প্রথম দিকে কম্পিউটার প্রোগ্রামিং এবং কম্পিউটার নিরাপত্তা বিষয়ে অতি দক্ষদের বলা হতো হ্যাকার,কিন্তু এর পরেই এর ব্যবহার শুরু হয় অপরাধ্মূলক কাজে।হোয়াইট হ্যাট, ব্ল্যাক হ্যাট ও গ্রে হ্যাট এ তিন ধরনের হ্যাকার বর্তমানে কাজ করে।তবে কিছু সাধারন হ্যকার রয়েছে যারা প্রোগ্রামিং জানে না,শুধু ফিশিং বা সিকিউরিটি প্রশ্নের উত্তর দিয়ে একাউন্ট হ্যাক করে থাকে।আমাদের দেশে এই শ্রেনীর হ্যাকারই বেশি।
এবার আসুন জেনে নিই,কিভাবে নিরাপদ থাকবেন।
১.একটি জিনিস মনে রাখবেন অনলাইনে আপনার তীক্ষ্ণ নজর আর সাবধানতাই আপনার সব ঝামেলার অবসান ঘটাতে পারে।
২.অনলাইনে প্রায়ই বিভিন্ন কারনে বিভিন্ন সাইটে একাউন্ট খুলতে হয়।এসব একাউন্ট খুলতে একই ইউজারনেম এবং পাসওয়ার্ড ব্যবহার করুন।আর ইউজারনেমটি একটু অপরিচিত উদ্ভট হওয়াটাই শ্রেয়।কেননা আপনার নাম লিখে গুগলে সার্চ করলে হয়ত আপনার প্রোফাইলটি চলে আসবে।সে ক্ষেত্রে একই ঘটনা ঘটতে পারে।আর একাউন্ট খোলার জন্য একটি মেইল একাউন্ট ব্যবহার করুন(এ ক্ষেত্রে আমি জিমেইল ব্যবহার করার পরামর্শ দেব,কেননা ইয়াহু তে অনেক মেইল স্প্যাম আকারে আসে) আর ব্যক্তিগত যোগাযোগের জন্য অন্য একটি একাউন্ট ব্যবহার করুন।
৩.পাসওয়ার্ড দেয়ার ক্ষেত্রে খুব সাবধান থাকতে হবে।কেস-সেন্সেটিভ জায়গায় ক্যাপিটাল লেটারের দিকে খেয়াল রাখতে হবে।ছোট অক্ষরে না বড় অক্ষরে দিলেন সেটা মনে রাখতে হবে। পাসওয়ার্ডের সংখ্যা ৬ এর উপরে থাকাটা জরুরি।আর একটা জরুরি বিষয় হল শুধু সংখ্যা দিয়ে কখনো পাসওয়ার্ড দিবেন না,সংখ্যা এবং অক্ষর দিয়ে পাসওয়ার্ড দিলে এবং তার সংখ্যা ৬ এর উপরে হলে খুব উঁচু মানের হ্যাকারেরও একাউন্ট হ্যাক করতে কালো ঘাম ছুটে যাবে।
৪.সব একাউন্টে একটিই পাসওয়ার্ড এবং ইউজারনেম ব্যবহার করার চেস্টা করুন তাতে কখনো কোন একাউন্ট রিকভার করতে সুবিধা হবে। তবে কোথাও কখনো এ তথ্যগুলো লিখে রাখবেন না, মোবাইলে তো নয়ই।
৫.এখন প্রায় সব সাইটেই সেবা পাওয়ার জন্য একাউন্ট খোলা লাগে আর একাউন্ট খোলার সময় সিকিউরিটি প্রশ্নের একটা অপশন থাকে।সেখানে খুব ব্যক্তিগত প্রশ্ন নির্বাচন করুন যার উত্তর আপনি ছাড়া আর কারো পক্ষে জানা সম্ভব না।অনেকেই মেইল একাউন্ট খোলার সময় প্রিয় বই এর নাম কি? প্রিয় স্থান কি ইত্যাদি দিয়ে থাকেন আর ফেসবুকের প্রোফাইলে এসব তথ্য দিয়ে থাকেন। ফলে হ্যাক করাটা তখন মামুলি বিষয় হয়ে দাঁড়ান।তবে একটি বিষয় মনে রাখবেন এসব সিকিউরিটি প্রশ্ন খুবই গুরুত্বপূর্ণ।কোন কারনে একাউন্টে কোন ঝামেলা হলে এ প্রশ্নের উত্তরই একমাত্র অবলম্বন হয়ে দাঁড়ায়।তাই এ প্রশ্নের উত্তর কখনো ভুলে যাওয়া চলবে না।প্রয়োজনে কোন ব্যক্তিগত স্থানে শুধু উত্তরটি লিখে রাখতে পারেন।
৬.মাঝে মাঝে খুব পরিচিত সাইটের শেষে .bd দিয়ে একই পেজ ওপেন হয়। এগুলো মূলত ফিশিং সাইট।বেশিরভাগ সময়ে ফ্রী ডোমেইন ব্যবহার করে যেমন .co.cc , .tk ইত্যাদি ব্যবহার করে এসব সাইট করা হয়। মূলত এসব সাইট মূল সাইটের সাথে লিঙ্ক আপ করা থাকে।ফলে আপনি লগ-ইন হবেন ঠিকই কিন্তু আপনার ইউজারনেম এবং পাসওয়ার্ড সার্ভারে সেভ হয়ে যায়।তাই এসব সাইট যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলুন।
৭.মেইল থেকে কখনো কোন জিপ ফাইল নামিয়ে ডাবল ক্লিক করবেন না। আপডেটেড এন্টি ভাইরাস দিয়ে চেক করে নিন কোন কী লগার ব্লেন্ড করা আছে কিনা। মেইল থেকে সব ফাইলই নামানোর পরই এভাবে চেক করতে হবে।অনাকাঙ্খিত ফাইল এবং অপ্রয়োজনীয় ফাইল না নামানোই উত্তম।অবশ্য সব মেইল সার্ভিসেরই একটা নিজস্ব চেকিং ব্যবস্থা থাকে,কিন্তু হ্যাকাররাও নিয়মিত এগুলোর দুর্বলতা খুঁজে বে করে নতুন কী লগার তৈরি করে।তাই পিসি বা ল্যাপটপে সবসময় আপডেটেড এন্টিভাইরাস ব্যবহার করতে হবে।
৮.বিভিন্ন সফটয়্যার ব্যবহার করে বিভিন্ন একাউন্টে লগ ইন করা যায়,স্ট্যাটাসও দেয়া যায়।তবে এসব সফটয়্যার খুব একটা নিরাপদ নয়।এড়িয়ে চলা ভাল।বিশেষ করে ফেসবুকের জন্য এধরনের সফটয়্যার বেশি দেখা যায় এবং রিডিরেক্টরিয়েট সার্ভার সিস্টেম ব্যবহার করে বিধায় প্রায়ই ব্যবহারকারীদের ঝামেলায় পড়তে হয়।
৯.অনেকেই নিজের গুরুত্বপূর্ন ফাইল বিভিন্ন সাইটে আপলোড করে রাখেন নিরাপত্তার জন্য। ভাল বুদ্ধি কিন্তু ক্রিয়েটিভ কোন কাজ অনলাইনে ব্যাক-আপ না রাখাই উত্তম।ফেসবুকে তো কোনভাবেই না।ফেসবুকে একবার কিছু আপ লোড করলে তা আর কোনভাবেই সার্ভার থেকে ডিলিট করা যায় না।একাউন্ট অফ করে অদৃশ্য করা যায় মাত্র।তাই এসব ক্ষেত্রে সাবধান থাকাই ভাল। আর এধরনের কাজের জন্য ফ্রী সাইটগুলো ব্যবহার না করাই ভাল কারন এগুলো যে কোন মুহুর্তে বাতিল হয়ে যেতে পারে।
১০.অনলাইনে কেনা বেচার ক্ষেত্রে খুব সাবধান থাকতে হবে।ক্রেডিট কার্ডের তথ্য নেয়ার জন্য বহু ধান্দাবাজ সাইট আছে।নির্দিষ্ট,সুপরিচিত এবং বিশ্বস্ত সাইট ছাড়া অনলাইন মার্কেটিং না করাই ভাল।
১১. সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন বিষয় হচ্ছে একটি শক্তিশালী ফায়ারওয়াল ব্যবহার করা।প্রায় সব অপারেটিং সিস্টেমে বাই ডিফল্ট দেয়া থাকে।উইন্ডোস নিয়মিত আপডেট করলে আর ঝামেলা হবে না।
সবশেষে একটি কথা, একটু সাবধান হলেই এসব ঝামেলা এড়ানো যায়।লোভের বশবর্তী হয়ে কিছু না করলে এবং একটু দেখে শুনে পথ চললে আপনার ভার্চুয়াল জগতও আনন্দময় হতে পারে।
সবার জন্য আন্তরিক শুভকামনা।নিরাপদ হোক আপনার অনলাইন জীবন।
[email protected]
হ্যাকিং নিয়ে বিস্তারিত জানতেএখানে ক্লিক করুন