১.
বাইরে কিছু একটা ঘটছিলো এবং ভেতরেও।
২.
বড়ো রাস্তার মোড়ে ছেলেছোকড়ারা হঠাৎই উন্মত্ত হয়ে উঠলো কোনো ধরণের পূর্ব আলামত ছাড়াই। ফুলের ভ্রাম্যমান দোকানটা তখন তছনছ হয়ে গেছে। মেরুন রঙের গোলাপের তোড়াটা পাশ্ববর্তী নালায় পড়ে কেমন ধূসর, মেন্দামারা হয়ে গেছে। এ সময় সূর্যাস্তের ঠিক আগমূহুর্তে, রাস্তার ঠিক উত্তর পাশের নীল ছোপছোপ বাড়ির দো’তলায় মাহফুজ কাঠপেন্সিল চোখা করতে করতে ভাবে- আজ সে আত্মহত্যা করবে।
৩.
‘আমাকে দিয়ে কি হবে?’ এই শ্রেণীর প্রশ্ন মাথাচাড়া দিয়ে উঠলেও ‘কি করা উচিত’ তা ভেবে পাচ্ছিলো না মাহফুজ। ঠিক সে সময় গন্ডগোলের তীব্র কিন্তু ভোঁতা চ্যাঁচামেচিটা কানে এলো ওর। তাড়াহুড়ো করে ড্রয়ার থেকে কমলা রঙের পুরানো পেন্সিলটা বের করে আনলো সে। কিন্তু পেন্সিলকাটার তো নেই!
৪.
রবিবার সকাল সবসময়ই পীড়াদায়ক এবং নাজেহালমূলক।
সাতটা বাজতেই পিঠে বিশাল থাবার চাপড় রবিবারকে রবিবার বলে চিনিয়ে দেয়ার প্রধান আলামত।
‘লম্বা ঘুমের পর আর ঘুম কিসের?’ মাহফুজ তাই বেশিক্ষণ আর অর্ধমৃত থাকতে পারে না। তাকে জীবিত হতে হয় এবং যেতে হয় বাজারে।
এর কোনো মানে হয় কি হয় না, সেটা ভাবনার কোনো বিষয় না বরং এটা বাধ্যতামূলক তীর্থযাত্রার মতই। পায়ে হলুদ পঞ্চ আর গোটানো প্যান্টে প্রতি রোববার মাহফুজ বাজারে যায়, এই রবিবারও যেমন গিয়েছে। অন্যান্য দিনের সাথে আজকের পার্থ্যক্য শুধু এতটুকুই যে আজ সে চটের ব্যাগটা আনতে ভুলে যায়নি।
বাজারে এসেই প্রথমে মাছের বাজারে ঢুকে পড়ে সে। ঘুরঘুর করে। আঁশটে গন্ধটা ওর ভীষণ ভালো লাগে। আজও অন্যান্যদের সাথে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সে শোল মাছের শেষ আস্ফালনগুলো দেখছিলো। আর ঠিক তখনই দিব্যবাণীর মতো শুনতে পায়-‘মাছেরা মারা গেছে এবং কেউ কেউ মরছে; মূলত: মানুষ মৃত মাছ খেতে পছন্দ করে।’ যতটা চমকে ওঠার কথা মাহফুজ ঠিক ততটা চমকে ওঠে না, বরং জড়তা এসে ভর করে ওকে। হঠাৎ করেই তার মনে হয় ‘আমি কোনো মর্গে এসে হাজির হয়েছি; জীবিত এবং মৃতদের মর্গ।’ দৌঁড়ে, ছুটে বেরিয়ে আসতে চাইলেও সে বেশ স্বাভাবিক পদক্ষেপেই মাছের বাজার থেকে বের হয়ে আসে এবং পাশ্ববর্তী ড্রেনে বমি করার সময় বুঝতে পারে এসবই পাগলামির পূর্ব আলামত।
বমিপর্বের পর কিছুটা ধাতস্থ হতে না হতেই পাশের সব্জিদোকানটায় চোখ আটকে যায় তার। লালশাক, পুঁইশাক, ধনিয়া পাতা ইত্যাদি সাধারণ সব্জিরা মরচে ধরা ডালায় পড়ে ছিলো। হঠাৎ সব্জিরা কেন তার দৃষ্টিপথে বাঁধা হয়ে দাড়াল মাহফুজ ততক্ষণাৎ ভেবে পায় না। যখন বুঝতে পারল তখন দ্বিতীয়বার বমির উদ্রেক হলেও উদর শূণ্য ছিলো, ফলে ড্রেনে কাঁচামাল বৃদ্ধি পায়নি।
‘মূলত: লালশাক, পুঁইশাক কিংবা তরতাজা সবুজাভ ধনিয়া- সবাইকেই জীবন ও শেকড় থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। সেইসাথে মুদিদোকানে সাজানো রশুন, আদা, পেঁয়াজ, আলু ওরা কেউই জীবিত নয়। ঐ যে ও কোণায় চালের আড়ত, রহিমের দোকানে ঝোলানো আস্ত সিনা- সব এবং সমস্তই মৃত এবং মৃত!’
পুরো বাজারটাই আসলে মৃতদের পীঠস্খান। মাহফুজ ভাবলো এবং কেঁপে উঠলো। আর ঐ যে কিবরিয়া সাহেব, রতনের বাবা কিংবা এমন অপরিচিত হাজারো মানব সন্তান আসলে মৃতদের কিনে নিতে চায়। যারা মরেনি তাদের মেরে ফেলতে চায়। সবার চোখের মণিতে মাহফুজ অতিমনোযোগী লালসা ঝিকমিকাতে দেখে।
‘পালাও, পালাও’- দিকবিদিকশূণ্য হয়ে দৌঁড়াচ্ছিলো সে। কেউ কেউ ওর দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকালেও খুব বেশী পাত্তা দেয়নি। কেবল যুবায়ের ওর নাম ধরে ডাকায় একবার পেছনে ফিরবে ফিরবে করেও শেষ পর্যন্ত আর ফিরে চায়নি মাহফূজ।
বড়ো রাস্তাটার পাশেই সরু রাস্তা। সোজা চলে গেছে পাউরটির কারখানাটার দিকে। ঝট করে গলিটায় ঢুকে পড়লো মাহফুজ এবং কিছুদূর যাবার পর এমন দৃশ্যের মুখোমুখি হলো যা তার আগের সব ভাবনাকে স্বপ্নে পরিণত করলো।
দুটো মাঝবয়সী লোক আর একটা অল্পবয়সী মেয়ে- যার নাম পারুল কিংবা সখিনা হলে যুতসই হয়(সুজানা অথবা নীলাঞ্জনা হওয়ার কোনো কারণ নেই)- তারা রাস্তার সবচেয়ে সংকীর্ণ এবং অন্ধকার জায়গাটায় গড়াগড়ি খাচ্ছে। মেয়েটা গোঙ্গাচ্ছিলো। লোকদুটোর মুখ না দেখা গেলেও তাদের উন্মুক্ত পশ্চাৎদেশ মাহফুজকে বিচলিত করে তোলে।
সে কি করবে ভেবে পায় না। কিংবা তার কি করা উচিত সে সম্পর্কে যথেষ্ট জ্ঞানসম্পন্ন হয়তো সে নয়। কেবল তার মুখ চিরে যে অনাকাঙ্থিত শব্দ হয়েছিলো তার রেশ ধরেই লোকদুটো হুঁশ ফিরে পায় এবং মাহফুজের অস্তিত্ত্ব তাদেরকে পলায়নে সহায়তা করে। সে দেখতে পায় প্যান্ট ঠিক করতে করতে তারা বিশাল সমাজটার দিকে ছুটে চলেছে।
মেয়েটা দম নিতে পারছিলো না। মুখে গোঁজা ছিলো লালরঙের একদলা কাপড়। তার রক্তাক্ত উরু অতিক্রম করে তলপেটের ঠিক ডানপাশে দ্বিতীয় লালরঙ তার প্রকাশ সূচনা করেছিলো। মেয়েটা উঠে বসার চেষ্টা করে। গড়িয়ে পড়ে। চেষ্টা করে। কিছু বলতে চায়। গড়িয়ে পড়ে। বিফল হয়ে শেষবারের জন্য যখন সে পড়ে যাচ্ছিলো তখন মাহফুজ সখিনা কিংবা পারুল নামের মেয়েটার চোথে মৃত্যুপথযাত্রী শোল মাছের শেষদৃষ্টি দেখতে পায়।
মাহফুজ দৌঁড়াচ্ছিলো। ছুটছিলো । এবং উল্টোদিকে। জ্ঞান হারানোর আগ পর্যন্ত সে ক্ষান্ত দেয়নি। আর জ্ঞান সে হারায় সুবিধা মতো জায়গাতেই। তার নিরাপদ ঘরটায়। সূর্যাস্তের ঠিক আগে আগে জ্ঞান ফিরলে অথবা ঘুম ভাঙ্গলে মাহফুজ কিছুক্ষণ স্থির হয়ে বসে থাকে। বাস্তব অবাস্তব এগুলার সীমা পরিসীমা কোনোকিছুই গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়না তখন। কেবল স্বশব্দে একবার শুধু বলে- ‘আমাকে দিয়ে কি হবে?’ এই শ্রেণীর প্রশ্ন মাথাচাড়া দিয়ে উঠলেও ‘কি করা উচিত’ তা ভেবে পাচ্ছিলো না মাহফুজ। ঠিক সে সময় গন্ডগোলের তীব্র কিন্তু ভোঁতা চ্যাঁচামেচিটা কানে এলো ওর। তাড়াহুড়ো করে ড্রয়ার থেকে কমলা রঙের পুরানো পেন্সিলটা বের করে আনলো সে। ‘কিন্তু পেন্সিল কাটার তো নেই!’
হুড়োহুড়ি ততক্ষণে আরো বেড়ে গেছে। কোথায় কি যেন ভেঙ্গে পড়ার শব্দ শোনা যায়। ছুরিটা চোথে পড়তে স্বস্তি ফিরে আসে মাহফুজের। কাঠপেন্সিল চোথা করতে থাকে। এবং চোখা করতে করতে ভাবে- আজ সে আত্মহত্যা করবে। ছুরিটা কব্জির উপর চালিয়ে দেয় সে এবং তখন জানতে পারে তাকে ঠিক কি করতে হবে। মাহফুজ টলতে টলতে বাড়ি থেকে বের হয়ে আসে এবং ভাবে- বড়োরাস্তা পর্যন্ত কি সে পৌঁছাতে পারবে?
আর উত্তেজিত জনতারও জানবার কথা নয় মাহফুজ ঘর ছেড়ে বেরিয়েছে।
কলোনী: ৩ ১৫.০৪.০৯