বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে হলো। সমুদ্রের বুকে দূর থেকে একটা রাজহাঁস ভেসে যাচ্ছিল। রাজহাঁসের মত দেখতে হলেও ওটা একটা জাহাজ। ধব ধবে সাদা রঙ। উপর তলায় বসে আছে দেশের রাজা রাণী সবাই। তির তির বাতাসে উড়ছে রাজপতাকা। রাজপুত্র জাহাজের সিঁড়ি ভেঙে নেমে এলো একতলায়। একা একা বসে থাকলো কাচের জানলার পাশে। কী অদ্ভুত সুন্দর পূর্ণিমা, আলো পড়ছে থৈ থৈ ঢেউয়ের উপর। দিগন্তে ঢেউ ফেনিল জড়োয়ার মিশে যায়। ঘুম ঘুম এসে যাচ্ছে। হঠাৎ সে দেখতে পেলো একটা বড় কালো পাথরে এক অপূর্ব সুন্দর মেয়ে বসে আছে। হাতে তার শঙ্খের বাঁশী। জাহাজটা আরও কাছে এলো। মেয়েটির বয়স খুব বেশি নয়। দীর্ঘ ঘন চুলে তার শরীরের অর্ধেকটা ঢেকে আছে। হয়তো এই মাত্র স্নান করে চুল শুকোতে দিয়েছে। রাজপুত্রের মনে হলও স্বপ্ন। সে ডাকল। মেয়েটি তার দিকে অপলক চেয়ে থাকলো। হঠাৎ মেঘে ঢেকে গেল চাঁদ। আর নিমেষেই মেয়েটাকে সে আর দেখতে পেল না।
সাত সমুদ্রের তলায় মৎসকন্যা থাকতো। সে এসে বলল, মা, আমার মন ভাল নেই। মা বলল,
কি হয়েছে তোমার? আমি এক অপূর্ব সুন্দর মানুষকে দেখেছি। আমি বসেছিলাম পাথরের উপর। ভেজা চুল শুকোচ্ছি আর বাঁশি বাজাচ্ছি। এমন সময় একটা সাদা হংসের মত জাহাজে দেখতে পেলাম তাকে।কিছুক্ষণ পর মেঘে ঢেকে গেল আকাশ। মাগো, আমি ডুবন্ত জাহাজ থেকে সেই মানুষটিকে তুলে সাগরতীরে রেখে এসেছি।আমার তখন সময় শেষ হয়ে গেল। তাই চলে আসতে হলও। আমি আবার যেতে চাই। সে কেমন আছে জানি না। আমি তাকে ভালবেসে ফেলেছি।
মা মৎসকন্যার মুখে হাত দিয়ে বলল ও কথা বলতে নেই। মানুষরা আলাদা আমরা আলাদা। ষোল বছর যে দিন হয় সেদিন সমুদ্রের উপরে একটি দিন তোমাকে থাকতে অনুমতি দিয়েছিল। ওঝার নিষেধ কোন মোহে পতিত হওয়া। আমিও তোমার মত ডাঙায় উঁকি দিয়েছি। তোমার বড় বোনও। যা হোক এখন সমুদ্রের তীরে যাওয়া তোমার নিষেধ।
মৎসকন্যা ছিল অসম্ভব জেদি। সে শৈবালের নরম শাখায় মাথা রেখে কাঁদতেই থাকলো। মা তার বোনকে পাঠাল বোঝাতে। বড় বোন বলল, মানুষের মায়ায় পড়তে নেই। মানব জাতি খুব কঠিন। ওরা আমাদের মত স্বার্থ ছাড়া ভালবাসতে পারে না। বরং শুনেছি ওরা যে ভালবাসে তাকে কষ্ট দিয়ে সুখ পায়। কিন্তু আমি ওকে নিজ হাতে রেখে দিয়ে এসেছি সাগরের তীরে। এখন ফের দেখতে চাই। ওকে সেবা করে সুস্থ করতে চাই। আমি তাকে বিয়ে করতে চাই। মৎসকন্যা এত কাঁদলো তাকে মানাতে প্রতিবেশীরা এলো। বন্ধুরা এলো, । কিন্তু কিছুতেই কাজ হলও না। অগত্যা মা তাকে নিয়ে গেল ওঝার কাছে। ওঝা বলল, তুমি অবুঝ হয়ে যেও না। আমি খোঁজ পেয়েছি যে তোমার রাজপুত্রটি সুস্থ আছে। যে রাজপুত্রকে তুমি চেন না জান না সে তোমাকে যে বিয়ে করবে তা কেমন করে জানলে? তুমি সেখানে যেতে পারো একটি শর্তে। তুমি এক মাস সময়ের জন্য মানুষের মত পা পাবে কিন্তু তার বদলে তোমার জিভ কেটে ঝিনুকের খোলসে লুকিয়ে রাখা হবে। তুমি পুরোপুরি বোবা হয়ে যাবে। এই সময়ের মধ্যে যদি রাজপুত্র তোমাকে ভালবেসে বিয়ে করতে সম্মত হয় তাহলে তুমি আবার কথা বলতে পারবে। যদি তা না পারো আমাদের এখানে ফিরে আসার পথটুকুও থাকবে না। এক মাস পর তুমি সমুদ্রের ফেনা সাথে মিশে যাবে। এ কথা শুনে মা কিছুতেই মৎসকন্যাকে রাজি হতে দিলো না। কিন্তু মৎসকন্যার চোখে সেই রাজপুত্রের কথা ভেবে আকুল হয়ে বলল, মা আমি তাতেই রাজি।
সে দিন ছিল শেষ দিন। মৎসকন্যাকে বাবা মানিক্যখচিত জামা উপহার দিল । বলল মারে, মানুষ সম্পদ বোঝে, যদি বিপদে পড়ো তাহলে এসব বিক্রি করে দিও। কাজে দেবে। মা তার বিয়েতে পাওয়া দামী মুক্তোর মালা পরিয়ে দিলো তার কণ্ঠে। ওঝার কাছে আসার পর লোকটি ছুরি দিয়ে তার ভিজে কেটে মন্ত্রবলে মৎসকন্যাকে মানুষ করে দিল।
দুপুর তিনটা। মৎসকন্যা চোখ মেলল। সে দেখল তাকে কেউ সমুদ্রের তীরে রেখে গেছে। সে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে সমুদ্রতীরের জেলিফিশ হেসে বলল, তুমি অনেক সুন্দর মৎসকন্যা, তুমি কেন পারবে না? হাটতে হাটতে সবুজ ঝাউ গাছের দিকে হেটে গেল। ওঝা বলে দিয়েছিল রাজপুত্র ঝাউবীথিতে একা একা সমুদ্রপারে বেড়াতে আসে।
দুপুর গড়িয়ে যায়। কেউ আসল না। সে মনে মনে চাইলো যেন দেরি না হয়। কিছুক্ষণ পর সে একটা পায়ের শব্দ পেল। দেখল রাজপুত্র। কিন্তু রাজপুত্র তাকে দেখে চিনতে পারলো না। রাজপুত্র বুঝতে পারলো মেয়েটি পথ ভুলে এদিকে চলে এসেছে। সে তাকে নাম জিজ্ঞেস করলো, কোথায় থাকো জিজ্ঞেস করলো, কিন্তু মৎসকন্যা নির্বাক থাকলো। একটা সময় রাজপুত্র বুঝতে পারলো মেয়েটি বোবা। এই সমুদ্রের পারে সে কোথায় থাকবে? তাই সে মেয়েটিকে ইশারায় বলল, সে তাকে রাজ অতিথিশালায় রাতকাটানোর ব্যবস্থা করে দেবে। মৎসকন্যা জানতো সেখানে থাকলে একদিন তাকে চিনতে পারবে রাজপুত্র।
এভাবে দিন যায়। মৎসকন্যা অধীর হয়েছিল। সে রাজপুত্রের সাথে সমুদ্রতীরে বেড়াতে গেল। রাজপুত্র ভাবলো এই মেয়েটিকে ফিরিয়ে দেয়া দরকারঅনেক জায়গায় ঢোল পিটিয়ে ঘোষণা দিলেও মৎসকন্যাকে নিয়ে যেতে কেউ এলো না। এভাবে কুড়ি দিন ধরে রাজপুত্রকে অনুসরণ করে মৎসকন্যার দেখা হয়। রাজপুত্র প্রতিদিনই উদাস হয়ে বসে থাকে। সমুদ্রের ঢেউ গোনে। শুকতারা সাথে একমনে কথা বলে। এত কাছে থাকে। এতবার দেখা হয়। ঝকঝকে রোদ্দুরে জল থেকে লাফিয়ে ওঠে স্যামন। রাজপুত্র এতই উদাসীন মৎসকন্যার দিকে যে সে মৎসকন্যার ভারী রাগ হয়। নারকেলের বীথির পাশে বালিতে মৎসকন্যা চুপ করে বসে থাকে। একদিন যখন রাজপুত্র চলে গেছে, মৎসকন্যা একাই বসে আছে সে শুনল জেলি ফিশ তাকে দেখে বলছে, আহা সুন্দরী মৎসকন্যা। রাজপুত্রের যেন চোখ নেই। তাকে দেখেও দেখে না। মেয়েটি তখন এই ভেবে নিজেকে সান্ত্বনা দেয়। ফেনায় মিশে গেলে যাবে কিন্তু যতদিন বেঁচে থাকবে সে প্রিয় মানুষটিকে দেখতে পাবে। এভাবে পঁচিশ দিন কেটে গেছে। সে শুনতে পেল ভিতর কথা চলছে রাজপুত্রের বিয়ে হবে লবঙ্গ দ্বীপের রাজকন্যার সাথে। সে শুনেছে সেই মেয়েটি পৃথিবীর সবচেয়ে রূপবতী মেয়ে আর তার পরিবারের খুব ইচ্ছে দুই রাজ্যের মিলন হোক। অন্যদিনের মতই রাজপুত্র তাকে অবজ্ঞা করে বাড়ি ফিরে গেল।
অভিমানে চোখ জলে ভিজে গেল মৎসকন্যার। রাত বাড়ছিল। তারারা জ্বলে উঠছিল। ক্ষীণ চাঁদের নিচে একটা মুখ ভেসে উঠলো এমন সময়। সে অবাক হয়ে দেখল তার বোন মুখ উঁচিয়ে বলল, আমি আগেই বলেছি মানব জাতি অকৃতজ্ঞ। তখন তো শোনো নি। এদিকে মা ওঝার কাছে একটা ছুরি এনেছে। ওঝা বলেছে এই ছুরি দিয়ে রাজপুত্রের হৃদপিণ্ড খুলে নিয়ে যদি সমুদ্রে ঝাঁপ দিতে পারো তাহলে অভিশাপ কেটে গিয়ে ঠিক আগের মত মৎসকন্যা হয়ে জীবন ফিরে পাবে। এটাই শেষ সুযোগ।
রাজপুত্রের বুকে ছুরি বিঁধিয়ে নিজে বেঁচে থাকবে মৎসকন্যা! না তা হয় না। সে বরং মরে সমুদ্রের ফেনা হবে। এদিকে সময় চলে যায়। তিন দিন কেটে গেছে। মৎসকন্যার একসময় মনে হলও, মানুষ সত্যিই অকৃতজ্ঞ। সারাটা বিকেল সে রাজপুত্রের পাশে ছিল। একবার ফিরে দেখল না। তবে কি সে লবঙ্গ দ্বীপের রাজকন্যার জন্য ব্যাকুল হয়ে আছে? এমন মানুষটির বুকে ছুরি বিঁধিয়ে উচিত শিক্ষা দেয়া দরকার। কী লাভ ভালবাসার মানুষকে সুযোগ দিয়ে। জীবনের সব বিসর্জন দিয়েও সে কি পেয়েছে?
মধ্যরাতে যখন সবাই ঘুমিয়ে গেছে সে পা টিপে ছুরি হাতে রাজপুত্রের ঘরের দিকে রওয়ানা দিলো। রাজপুত্রের বিছানার পাশে যে জানালা তার খুব কাছেই বিছানা। মৎসকন্যা জানালায় এসে দাঁড়ালো। চন্দ্রালোকে সে দেখল ছেলেটি ঘুমাচ্ছে কি শান্তি নিয়ে। এত সুন্দর করে ঘুমাতে সে কখনো কাউকে দেখে নি। সে হাত বাড়িয়ে তার বুকে ছুরি বিদ্ধ করতে গিয়ে ফেরত এলো। এমন সময় হাত থেকে ছুরি খসে পড়লো। রাজপুত্রের ঘুম ভেঙে সে চোখ মেলল। সে দেখল আকাশে পূর্ণিমা জ্বলছে আর জানালায় ঝড়ের রাতে দেখা অপূর্ব সুন্দর এক মেয়েটি। সেই জ্যোৎস্নার রাত। শুধু শঙ্খের বাঁশি নেই তার ঠোঁটে। কোথায় ছিল মেয়েটি? সে ছুটে জানালায় কাছে এসে বলল তুমি আর যেও না। আমি তোমাকে অনেক খুঁজছি। সারা দিন সারা রাত সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে থাকি। তুমি যেও না, আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই। মৎসকন্যার তখন জিভ ফিরে আসলো। সে বলল, আমি তোমার এত কাছে ছিলাম তুমি কেন তাকিয়ে দেখনি?
ছেলেটি বলল, আমি ঝড়ের শেষে তোমাকে এক পলক দেখেছি সমুদ্রের দিকে। আমি বুঝিনি কি জন্য তুমি আমাকে বাঁচিয়ে সমুদ্রে ঝাঁপ দিয়েছিলে। সেই থেকে আমি শুধুই সমুদ্রের পাথরে চেয়ে থাকি। মৎসকন্যা খুশিতে কাঁদতে থাকলো। তার ইচ্ছে হলো তার বোনকে বলে, দেখ, মানুষ যাকে ভালবাসে তাকে কখনো ভোলে না। সে আমাকেই দেখবে বলেই সমুদ্রের তীরে এসে অপেক্ষা করেছে।
সেই মৎসকন্যার সাথে রাজপুত্রের বিয়ে হয়েছিল ইরিডেনাস নদীর মোহনায়। বিশাল ভোজসভা হয়েছিল। মৎসকন্যার মা বাবা বোন সহ সবাই পানিতে থেকেই আশীর্বাদ দিয়ে গিয়েছিল তাদের।
---
ড্রাফট ২.০
ভুলে যাওয়া গান কে খুঁজে না পেলে নিজের কথায় গেয়ে ফেলা যায়। আমার শৈশবে পড়া রূপকথাকে কিছুতেই মনে করতে পারি না। তাই নিজের মত করে আবারও লিখি।