somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

স্রোতের বিরুদ্ধে

০৯ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ বিকাল ৩:১৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


বাংলা সাহিত্যে মনস্বী প্রাবন্ধিক ও তত্ত্বচিন্তক শিবনারায়ণ রায় এক নাক্ষত্রিক ব্যক্তিত্ব। মানবতন্ত্রের মূল প্রত্যয় তিনি বিশ্বনাগরিক , বিবেকী ভাবুক , দায়িত্বশীল চিন্তক , শিক্ষাবিদ , মৌলিক মানবতাবাদী ( Radical Humanist) , দার্শনিক , ইতিহাসবিদ , সাহিত্য সমালোচক তথা বিশিষ্ট সম্পাদক শিবনারায়ণ রায় । তিনি সর্বদা , সর্বত্রই নাস্তিক্য , যুক্তিবাদ ও বুদ্ধির মুক্তি ও মানবতাবাদের পক্ষে সক্রিয় থেকেছেন । সে জন্যই বিশ্ববিখ্যাত দার্শনিক বাট্রান্ড রাসেল একদা শিবনারায়ণ রায়ের উপর মন্তব্য করে বলেছিলেন “ শিবনারায়ণ রায় দাঁড়িয়েছেন সেই মতের পক্ষে যেটাকে আমি পৃথিবীর জন্য গুরুত্বপূর্ণ মনে করি ... তাঁর লেখা আমাদের সময়ের অধিকাংশ লেখকের চেয়ে বেশি যুক্তিগ্রাহ্য হিসেবে প্রকাশিত। “

তাঁর লেখা ৫০টিরও বেশি গ্রন্থ , যেমন সাহিত্য চিন্তা ১৯৫৬ , নায়কের মৃত্যু ১৯৬০ , মৌমাছিতন্ত্র ১৯৬০ , কবির নির্বাসন ও অন্যান্য ভাবনা ১৯৭৩ , গণতন্ত্র , সংস্কৃতি ও অবক্ষয় ১৯৮১ , রবীন্দ্রনাথ শেক্সপিয়র ও নক্ষত্রসংকেত ১৯৮৩ , স্রোতের বিরুদ্ধে ১৯৮৪ , রেনেসাঁস ১৯৯২ , স্বদেশ , সকাল স্বজন ১৯৯৬ , যে আলোকে অনেক আঁধার ১৯৯৮ , প্রত্যয় , অন্বেষা ও অনুচিন্তন ২০০১ , খাড়াইয়ের দিকে ২০০২ , বিবেকী বিদ্রোহের পরম্পরা ২০০৩ , জিজ্ঞাসার দশ দিগন্ত ২০০৪ , লাঠি থেকে লাটাই ২০০৫ , এবং কাব্যগ্রন্থ খোয়াব দেখি সত্তরে , মাইকেল! মাইকেল , কথারা তোমার মন ইত্যাদি গ্রন্থের বৈচিত্রসমৃদ্ধ প্রবন্ধগুলিতে তথ্য এবং গুটিকয়েক কাব্যগ্রন্থের মধ্যে তাঁর মনীষার প্রগাড় প্রদীপ্তি , নতুন ভাবনা , চিন্তনের অকুণ্ঠ জিজ্ঞাসা সুপ্ত ভঙ্গিমায় দীপিত হয়েছে ।

সেই প্রদীপনে এবং বিশ্বমনীষার মানচিত্রে সেকালের পাশ্চাত্যের হোমার – দান্তে , শেক্সপিয়র- গেটে , ব্লেক-মিল্টন প্রমুখের সৃষ্টি জগত যেমন বাদ পরে নি তেমনিই বাঙালির নিজস্ব ঐতিহ্যের মধুসূদন , বঙ্কিম , রবীন্দ্রনাথ , শরৎচন্দ্র , নজরুল এবং তাঁর সমকালের জীবনানন্দ – সুধীন্দ্রনাথ দত্ত – বিষ্ণু দে প্রমুখ মনীষার সৃষ্টির ঐশ্বর্য ও দর্শন , তাঁর যুক্তি ও মননের নতুন ভাষা ও ভাবনায় বাঙালি পাঠককুলকে নতুন পাঠবীক্ষায় উন্নীত ও দীক্ষিত করতেও সচেষ্ট থেকেছে সর্বদা।

মনে , প্রাণে , ধ্যানে –ধারনায় শিবনারায়ণ রায় কিন্তু রেনেসাঁসের প্রতীক পুরুষ ।
তাঁর রেনেসাঁস সম্পর্কিত গ্রন্থাদিতে পাশ্চাত্যের বিশ্ববিখ্যাত দার্শনিক সক্রেটিস , প্লেটো , অ্যারিস্টটল , রাসেল এবং প্রাচ্যদেশীয় রামমোহন , ডিরোজিও , অক্ষয়কুমার দত্ত , মানবেন্দ্র রায় প্রমুখের জীবন জিজ্ঞাসাকে তিনি তাঁর রেনেসাঁস সংক্রান্ত লেখার বিষয় করে সমাজ পরিবর্তনের যুক্তিসম্মত পথ ও পাথেয় এষণায় ব্যাপৃত থেকেছেন ।

শিবনারায়ণ রায়ের দর্শন ও রাজনীতি চর্চার অন্যতম শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ হিসেবে “মৌমাছিতন্ত্র” কেই মনে করেন অনেকে । মৌমাছিতন্ত্র মূলত কমিউনিজমকে সমালোচনা করে লেখা । শিবনারায়ণ মনে করতেন ব্যাক্তিসত্তার বিলোপ এবং রাষ্ট্রের প্রতি কঠোর আনুগত্য একদিন পৃথিবীতে কমিউনিস্ট রাষ্ট্রগুলোর পতনের অন্যতম কারন হয়ে দাঁড়াবে । এই গ্রন্থ তিনি লিখেছিলেন ষাটের দশকে , যখন পৃথিবী ব্যাপী চলছে কমিউনিজমের জয় জয়কার । তাঁর অভিমত ছিল যে রাষ্ট্র থেকে প্রেম ও সৃষ্টি নির্বাসিত , সেখানে স্বাধীন চিন্তা নিষিদ্ধ । সেখানে বৈচিত্র্য অবলুপ্ত । সেখানে স্বাতন্ত্র্যের শাস্তি – দাসত্ব অথবা মৃত্যু ।

“গণতন্ত্র ও সংস্কৃতি এবং চার্চ” প্রবন্ধে শিবনারায়ণ রায় দেখিয়েছেন – গণতন্ত্রের ভিত্তিমূল কোনও দল বা দলের ক্ষমতা বা পাশ্চাত্যের চার্চ বা প্রাচ্যের কোন মন্দিরের আধিপত্য বা শাস্ত্রীয় বিধি-বিধান নয় । গণতন্ত্রের ভিত্তি হল ব্যাক্তিমানুষ , তার স্বাধীনতা বা স্বাধিকার বোধ । যে বোধ গড়ে ওঠে সাংস্কৃতিক পথ ধরে , সংস্কৃতির মুক্ত আবহাওয়ায় , নিত্যনতুন অভিজ্ঞতা ও চিন্তা –চেতনার ঘাত –প্রতিঘাত ও অভিঘাতের মধ্য দিয়ে । ব্যাক্তি তার অন্তর্নিহিত সৃজনের বিচিত্র সাংস্কৃতিক রূপান্তরের পথ ধরে নিজের যে জাগরণ ঘটায় , নিজের বিশ্বাস ও অন্তরের শক্তিকে প্রকাশ করে যে জাগরণে , যে প্রকাশে কোনও শক্তির আনুগত্য নেই , কোনও পদানতি নেই । সেখানেই রেনেসাঁসের বীজ – সেই পথই রেনেসাঁসের যাত্রা ।

“বিবেকী বিদ্রোহের পরম্পরা “ গ্রন্থে তিনি লিখেছেন বাংলা ও বাঙ্গালির সাহিত্য – সংস্কৃতির যে রেনেসাঁ তা ডিরোজিও , রামমোহন , বিদ্যাসাগর , বঙ্কিম –মাইকেল , অক্ষয়কুমার প্রমুখ মনীষীর কর্মকীর্তি ও জীবনাদর্শের পথ ধরেই উৎসারিত হয়েছে ।১৯২৬ সালে শুরু হওয়া ঢাকা কেন্দ্রিক বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন ও আবুল হোসেন সম্পাদিত শিখা পত্রিকা তাঁকে চমৎকৃত করেছিল এবং দ্বিধাহীনভাবে তিনি এই আন্দোলনকে রেনেসাঁর মর্যাদা দিয়েছেন ।

স্রোতের বিরুদ্ধে প্রবন্ধ গ্রন্থে শিবনারায়নবাবু তাঁর সহজাত বুদ্ধি , যুক্তি , প্রশ্ন ও আত্মজিজ্ঞাসার প্রখর চিন্তা -চেতনায় ধর্ম- বর্ণ – জাতি নিরপেক্ষ এক জগত গড়ার দিকে নিবিষ্ট হয়েছেন – যা দেশকালের সীমানা পেরিয়ে প্রতিটি দেশের যুক্তিবুদ্ধিসম্পন্ন শিক্ষিত সমাজ তথা বিশ্বমানব কল্যাণের কথাই বলে । এই গ্রন্থে “নাস্তিকের মৃত্যুচিন্তা “ প্রবন্ধে তিনি বলেছেন “ অতিমানব বলে বিশ্বজগতে কিছু নেই , শব্দটি মানুষের আকাঙ্ক্ষার প্রকাশ মাত্র , কিন্তু অস্মিতাসম্পন্ন ব্যাক্তির প্রভাব অনেক বেশি , অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তার কৃতি তার মৃত্যুর পরেও দীর্ঘস্থায়ী ইতিহাসে তার প্রমাণ মেলে । বুদ্ধ , সক্রেটিস , কনফুসিয়াস , যিশু , মোহাম্মদ , কান্ট , মার্কস , রবীন্দ্রনাথ , পিকাসো – এঁরা প্রত্যেকেই অনন্য অস্মিতাসম্পন্ন মানুষ । তবে এঁরা কেউ অজর , অমর , ত্রুটিবিচ্যুতিহীন আত্মা বা “বিশ্বমানব” বা বিচারের উর্ধ্বে “অতিমানব” নন । "

“দেশ” পত্রিকায় যখন শিবনারায়ণের প্রবন্ধ “রবীন্দ্রনাথ ও গ্যোটে “ প্রকাশিত হয় তখন তাঁকে নিয়ে প্রবল সমালোচনায় মুখর হয়ে তৎকালীন সাহিত্য- সংস্কৃতি জগত। বাঙালি হয়ে বাংলাইর লেখা ভালো না বলে কোন এক গ্যোটে কে তিনি রবীন্দ্রনাথের থেকে বড় প্রতিভাবান মনে করছেন । এ ব্যাপারে তাঁর অভিমত ছিল “গ্যোটে বেশ্যাবাড়ি গিয়েছেন , মদ খেয়েছেন , মেয়েদের হৃদয় ভেঙ্গেছেন । সে সব তিনি লুকিয়ে রাখেন নি । সাহিত্যে স্থান দিয়েছেন । রবীন্দ্রনাথ এটা পারেন নি । বাস্তব জীবন রবীন্দ্রনাথের লেখায় দরিদ্র থেকে দরিদ্রতর হয়েছে ।

এক দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে শিবনারায়ণ রায় জানিয়েছেন “ আমার মতে বাংলার রেনেসাঁসের সবচেয়ে বড় কীর্তি হল বাংলা গদ্যের বিকাস । বাংলার চিন্তা , বাংলার মনন , সারা ভারতবর্ষকে একশো বছর ছাড়িয়ে গিয়েছিল”। এই বিকশিত বাংলা গদ্যের একটি বিশিষ্ট রূপকল্প নিঃসন্দেহে প্রবন্ধ সাহিত্য । কিন্তু শিবনারায়ণ মনে করতেন “বাংলা প্রবন্ধের অস্পষ্টতা এবং দারিদ্র্য প্রায় একেবারেই ঘোচেনি । বাংলা প্রবন্ধ সাহিত্য নিতান্তই অপরিণত । বাংলা প্রবন্ধসাহিত্যের উন্নতিকল্পের সারস্বত সংকল্প নিয়ে শিবনারায়ণ ১৯৮০ সালে প্রকাশ করলেন মনন ও চিন্তন নিকষিত জিজ্ঞাসামুখর প্রবন্ধমুখ্য ত্রৈমাসিক “জিজ্ঞাসা”। বাইশ বছর নিরবচ্ছিন্ন সম্পাদনায় এ –কে শক্ত জমির ওপর সুদৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন সম্পাদক শিবনারায়ণ । বাংলা গদ্য সাহিত্যের বিকাশে এবং প্রবন্ধসাহিত্যের সৌষ্ঠবসাধনে “জিজ্ঞাসা” পত্রিকার অবদান উপেক্ষণীয় নয় ।

শিবনারায়ণ কোন তত্ত্বদর্শনের আবেষ্টনীতে নিশ্চল হয়ে থাকেননি । মননের চলিষ্ণুতা , অভিজ্জতার প্রাচুর্য , তীক্ষ্ণ বিশ্লেষণ শক্তি এবং সর্বপরি স্বাধীন চিন্তা তাঁকে সজীব সচল করে রেখেছে একজন সংবেদী মানুষ হিসেবে । মননদৃষ্টির এই ক্রম পরিবর্তনের নির্যাস তাঁর রচনাসম্ভারেও পাওয়া যাবে । এ বিষয়ে অনুসন্ধানী গবেষক- পাঠক তৎপর হতে পারেন ।
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ বিকাল ৪:৪২
৫টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

পিরিতের সংস্কৃতিওয়ালা তুমি মুলা’র দিনে আইলা না

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ১৬ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৩:৫৬


---- আমাদের দেশে ভাষা, সংস্কৃতি এবং সামাজিক সমুন্নয়ন তলানিতে। তেমন কোন সংস্কৃতিবান নেই, শিরদাঁড়া সোজা তেমন মানুষ নেই। সংস্কৃতির বড় দান হলো ভয়শূন্য ও বিশুদ্ধ আত্মা। যিনি মানবের স্খলনে, যেকোন... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইসরায়েল

লিখেছেন সাইফুলসাইফসাই, ১৬ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:৪৮

ইসরায়েল
সাইফুল ইসলাম সাঈফ

এ মাকে হত্যা করেছে ইসরায়েল
এ বাবাকে হত্যা করেছে ইসরায়েল
নিরীহ শিশুদের হত্যা করেছে ইসরায়েল
এই বৃ্দ্ধ-বৃদ্ধাদের হত্যা করেছে ইসরায়েল
এ ভাইক হত্যা করেছে ইসরায়েল
এ বোনকে হত্যা করেছে ইসরায়েল
তারা মানুষ, এরাও মানুষ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

গ্রামের রঙিন চাঁদ

লিখেছেন আলমগীর সরকার লিটন, ১৬ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১২


গ্রামের ছায়া মায়া আদর সোহাগ
এক কুয়া জল বির্সজন দিয়ে আবার
ফিরলাম ইট পাথর শহরে কিন্তু দূরত্বের
চাঁদটা সঙ্গেই রইল- যত স্মৃতি অমলিন;
সোনালি সূর্যের সাথে শুধু কথাকোপন
গ্রাম আর শহরের ধূলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার।

লিখেছেন নাহল তরকারি, ১৬ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:১৭



পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহারের ধ্বংসাবশেষঃ
পালবংশের দ্বিতীয় রাজা শ্রী ধর্মপালদেব অষ্টম শতকের শেষের দিকে বা নবম শতকে এই বিহার তৈরি করছিলেন।১৮৭৯ সালে স্যার কানিংহাম এই বিশাল কীর্তি আবিষ্কার করেন।... ...বাকিটুকু পড়ুন

পরবাসী ঈদ

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ১৬ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:২৩

আমার বাচ্চারা সকাল থেকেই আনন্দে আত্মহারা। আজ "ঈদ!" ঈদের আনন্দের চাইতে বড় আনন্দ হচ্ছে ওদেরকে স্কুলে যেতে হচ্ছে না। সপ্তাহের মাঝে ঈদ হলে এই একটা সুবিধা ওরা পায়, বাড়তি ছুটি!... ...বাকিটুকু পড়ুন

×