সংসদে যান না চারদলীয় জোটের সংসদ সদস্যরা। একজন সংসদ সদস্য হিসেবে জনগণের কাছে যে দায়বদ্ধতা তার কোনটাই পালন করেন না। এতদসত্ত্বেও গত চার বছরে তাঁরা বেতন ভাতা নিয়েছেন সতের কোটি টাকার মতো। শুল্কমুক্ত বিলাসবহুল গাড়ি ও বিদেশ সফরে পিছিয়ে নেই তাঁরা।
সংসদ সচিবালয়ের তথ্য অনুযায়ী একজন সংসদ সদস্য সংসদ অধিবেশনে যোগদান করলে দৈনিক ভাতা পান এক হাজার টাকা। যদি কোন সদস্য যোগ দিতে ব্যর্থও হন তবেও তিনি দৈনিক ৩৭৫ টাকা পাবেন। চলতি নবম জাতীয় সংসদের মোট ১৫টি অধিবেশনে এ পর্যন্ত কার্যদিবস হচ্ছে ২৮৩। এর মধ্যে চারদলীয় জোট সংসদে যোগ দিয়েছে মোট ৫৪ দিন। দল হিসেবে এই ৫৪ দিন অধিবেশনে গিয়ে তাঁরা তুলেছে ২০ লাখ টাকারও বেশি। আর সংসদে না গিয়েই চার দলীয় জোটের সব সংসদ সদস্য মিলে তুলেছেন ৪০ লাখ টাকারও বেশি। সংসদ সচিবালয়ের তথ্য মোতাবেক একজন এমপি বেতন, যাতায়াত এবং অন্যান্য ভাতা বাবদ মাসে ৬০ হাজার টাকা করে পেয়ে থাকেন। গাড়ির জ্বালানী, রক্ষণাবেক্ষণ ও ড্রাইভারের বেতন বাবদ পান ৪০ হাজার টাকা। এসব ভাতার সবই তুলেন বিএনপির সংসদ সদস্যরা। [তথ্যসূত্রঃ বাংলা নিউজ ও দৈনিক আমাদের সময়ের অনলাইন সংস্করণ, ১৩/১২/২০১২]
এখানে বিবেচনার বিষয় হচ্ছে আপনাকে একটা কাজের দায়িত্ব দেয়া হলে বা আপনি নিজে থেকে চেয়ে নিলে সেই কাজটি না করে আপনি কি পারিশ্রমিক দাবি করতে পারেন? যদি সেই কাজটি না করে আপনি পারিশ্রমিক দাবি করেন বা কোন উপায়ে পারিশ্রমিক তুলে নেন তখন আপনার এই আচরণকে কি বলে অভিহিত করা উচিত? স্পষ্টতই আমার কাছে এটা চৌর্যবৃত্তি। আমাদের বিরোধী দলীয় সদস্যরা ফলতঃ এই চৌর্যবৃত্তিটিই আইনের দুর্বলতার কারণে খুব আয়েশে করে যাচ্ছেন। একজন সাধারণ মানুষকে জীবিকার তাগিদে হরতালের দিনেও প্রয়োজনে পায়ে হেঁটে হলেও তাঁর কর্মস্থলে আসতে হয়। কারণ কর্মে যোগ না দিলে মহান মালিক বা কর্তৃপক্ষ তাঁর সেদিনের বেতন-ভাতাদি শুধু কেটেই রাখবেন না কর্মস্থলে যোগ না দেয়ার যথোপযুক্ত কারণ দর্শাতে বলবেন। উপযুক্ত কারণ দর্শাতে ব্যর্থ হলে আরো কঠোর শাস্তি/জরিমানার সম্মুখীন হওয়ার সম্ভাবনা আছে। কিন্তু আমাদের মহান নেতাদের তাঁদের কর্মস্থলে যোগ না দেয়ার জন্য কোনরূপ জবাবদিহিতা নেই। বরঞ্চ তাঁরা ঘরে বসেই সব সুবিধা পেয়ে যান। এটি অনৈতিক, তবে আইনগত দিক বিবেচনায় অবৈধ নয়। যতোদিন আপনি আইনের মাধ্যমে এই অনৈতিক কাজটি বন্ধ না করতে পারবেন ততোদিন আমাদের মহান নেতারা সানন্দে এই কর্মটি চালিয়েই যাবেন। অতীত এবং বর্তমানের অভিজ্ঞতায় এটা প্রমাণিত যে, এ কাজে আমাদের সব রাজনৈতিক পক্ষই সিদ্ধহস্ত। অন্যান্য বিষয়ে তাঁদের মাঝে দা-কুমড়ো সম্পর্ক থাকলেও বিরোধী দলে থাকলে সংসদ অধিবেশনে যোগদান না করে সুবিধাদি নেয়ার বিষয়ে তাঁদের মাঝে কোন মতবিরোধ নেই।
অনেকেই এই অনৈতিক কর্মটির বিরুদ্ধে বলেছেন বা এখনও বলছেন। দেশীয় বুদ্ধিজীবী, বৈদেশিক দাতারা সবাই সময়ে সময়ে এর বিরুদ্ধে বলেছেন বা এখনও বলছেন। কিন্তু কোন অগ্রগতি হয়নি বা হচ্ছেনা। রাজনীতির একজন সাধারণ ছাত্র হিসেবে আমার জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা নিয়েও এ বিষয়ে মাঝে মাঝে ভাববার মতো সাহস দেখাই। ব্যক্তিগতভাবে আমার কাছে মনে হয় আইন বা নিয়মের কিছুটা পরিবর্তন আনতে পারলে কিছুটা হলেও সুফল পাওয়া যেতে পারে। আমার সীমিত জ্ঞানের আলোকে এ বিষয়ে কিছু সুপারিশ উত্থাপনের সাহস দেখাচ্ছিঃ
১। বর্তমান আইন অনুযায়ী কোন সংসদ সদস্য একটানা ৯০ কার্যদিবস সংসদে অনুপস্থিত থাকলে তার সদস্য পদ বাতিল হয়। এ কারণেই দেখা যায় অনেকেই একটানা ৯০ কার্যদিবস অনুপস্থিতির দিন কয়েক আগে সংসদে যোগদান করে তাঁর সদস্য পদটি রক্ষা করেন। এক্ষেত্রে একটানা নব্বই কার্যদিবস না করে যিনি সংসদ অধিবেশনের শুরুর দিন থেকে মোট নব্বই কার্যদিবস অনুপস্থিত থাকবেন তার সদস্য পদটি বাতিল করা যেতে পারে। প্রয়োজনে অনুপস্থিতির মেয়াদ ৯০ কার্যদিবসের পরিবর্তে ৬০ কার্যদিবস করলে আরো বেশি সুবিধা পাওয়া যেতে পারে;
২। বর্তমান নিয়মে একজন সংসদ সদস্য অধিবেশনে যোগদান না করলেও ৩৭৫ টাকা অধিবেশন ভাতা পান। এই অনৈতিক ভাতাটি অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে;
৩। সংসদ অধিবেশন চলাকালে যদি কোন সদস্য কোন মাসে যুক্তিসংগত কারণ ব্যতিত মোট কার্যদিবসের অর্ধেকের বেশি কার্যদিবসে উপস্থিত থাকতে ব্যর্থ হন তবে তার ঐ মাসের প্রাপ্য বেতন-ভাতাদি বাতিল করা যেতে পারে। অনুপস্থিতির যুক্তিসংগত কারণ ছিল কিনা সেটা সংশ্লিষ্ট সংসদ সদস্যের লিখিত বা মৌখিক জবাবের ভিত্তিতে মাননীয় স্পিকার নির্ধারণ করবেন;
৪। যুক্তিসংগত কারণ ব্যতিত কোন মন্ত্রী সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে উপস্থিত থাকতে ব্যর্থ হলে তার ঐ মাসের প্রাপ্য বেতন-ভাতাদি বাতিল করা যেতে পারে। আর যদি যুক্তিসংগত কারণ ছাড়া কোন মন্ত্রী সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে একটানা তিনদিন অনুপস্থিত থাকেন তবে তাঁর বিরুদ্ধে আরো কঠোর শাস্তির বিধান করা যেতে। অনুপস্থিতির যুক্তিসংগত কারণ ছিল কিনা সেটা সংশ্লিষ্ট মাননীয় মন্ত্রীর লিখিত বা মৌখিক জবাবের ভিত্তিতে মাননীয় স্পিকার নির্ধারণ করবেন;
৫। শুল্কমুক্ত গাড়ি আমদানির সুবিধাটি পুরোপুরি বাতিল করতে হবে;
৬। বিদেশ সফরের ক্ষেত্রে যে সমস্ত সদস্যরা নিয়মিত অধিবেশনে যোগ দিবেন তাদের অগ্রাধিকার দিতে হবে।
সমস্যার বিষয় হচ্ছে আইনটি সংসদের মাধমেই পাস করতে হবে। কাজেই খুব সহজেই এমন সিস্টেম চলে আসবে তেমন আশা করছিনা। এক্ষেত্রে আমরা যেটা করতে পারি তা হচ্ছে নির্বাচনের আগে প্রত্যেক দলের দলীয় মেনিফেস্টোতে এ বিষয়গুলো অন্তর্ভূক্ত করার জন্য চাপ দিতে পারি। আমাদের মিডিয়া এবং বুদ্ধিজীবী মহল সমাজ এ বিষয়গুলো প্রাপ্তির নিশ্চয়তার জন্য পুনঃ পুনঃ চাপ প্রয়োগ করতে পারেন।তবে সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে সাধারণ জনগণকে সচেতন হতে হবে। যে সমস্ত নেতারা জনগণের মনোনয়নে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পরেও সংসদ অধিবেশনে নিয়মিতভাবে ইচ্ছাকৃতভাবে অনুপস্থিত থাকেন জনগণকে অবশ্যই তাঁদের পরিত্যাগ করতে হবে।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




