somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আজমতের কিংবদন্তি

০৩ রা ডিসেম্বর, ২০১৪ দুপুর ১:২৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


প্রাক-কথনঃ
ওজ বেন আওনাক এর ব্যপারটা অনেকেরই জানার কথা। সে ব্যাটা লম্বাই ছিল ৩৩৩৩ হাত! সমুদ্রে গিয়ে দাঁড়ালে তার হত হাঁটুপানি। আর তার খাদ্য? সাগরের সবচেয়ে বড় প্রাণীতো ওই প্রকান্ড সব তিমিগুলোই। সেসব তিমিকে সুর্যেরগায়ে সেঁটে ধরতো ওজ। কাবাব হয়ে যাওয়া তিমির মাংস খেতে নিশ্চয় মন্দ লাগতোনা তার! দাঁড়ান দাঁড়ান, এখনি অবাক হলে চলবে কেন? আরো আছে। সেই সুপ্রাচিন আমলে নুহের প্লাবনের সময়েও এই ওজ ব্যাটার কারবার শুনলে তাজ্জবই হবেন। যেই তুফানে সারা দুনিয়া ডুবে গেল, ওতে নাকি তার কেবল বুক পর্যন্ত পানি উঠেছিল!

নাহ, আপনাদের হতাশ হবার মতো এখনো কিছু আমি বলিনি। দৈত্য ওজ শুধুই কিংবদন্তি। তার কারণ আপনারা বুঝতেই পারছেন। ইহুদি ধর্মগ্রন্থ তালমুদে তার ব্যপারটা পাওয়া যায়। অথচ আমাদের আজকের গল্পটা কিংবদন্তি হবার মতো নয়। কেন নয়, বিজ্ঞ পাঠক সেটা আপনারাই ধরে ফেলতে পারবেন।

কাঁথার মত হোক ব্যাপারটা। আমি সুইয়ের ফোঁড়ের পর ফোড়ঁ তুলে যাবো। সেই ফোঁড় হল কয়েকটা দৃশ্য। আমাদের আজকের গল্প তৈরী হবে এসব দৃশ্য দিয়েই। ভয় নেই, গগণ প্রসারী কোন নকশী কাঁথা গড়ে তোলা ধাতে নেই আমার।

প্রথম দৃশ্যপট
কথা বলার সময় তার ফোকলা দাঁতের ফাঁক দিয়ে থুতু বেরিয়ে আসে। সামনে দাঁড়ানো মানুষটির এতে বিরক্ত হবার কথা। কিন্তু হবার সুযোগ পেলে তো? খুবই ছোটখাটো আকৃতির একটা মানুষ সে। বড়জোর চার ফুট ইঞ্চি দশেক উচ্চতা হবে তার। সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে ব্যপারটা। কথা বলার সময় তার মুখ থেকে বেরুনো থুতু সামনের জনের বুকই ভিজাতে পারে সাকল্যে।

আজমতের ইদানিং মনে হয় বয়স বাড়ার সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে তার উচ্চতাও কমছে। ব্যপারটা যথেষ্ট লজিকাল। দিনে দিনে সে কুঁজো হয়ে যাচ্ছে। বয়স কত হবে তার সে জানেনা। কিন্তু পাঠক আমরা সহজেই অনুমান করে নিতে পারি সেটা। তার বয়স ৬৫ থেকে ৭০ এর মাঝামাঝি হবে।

শীতের সকাল বলে এই বেলা দশটাতেও রৌদ্রহীন পরিবেশ। ব্যপারির দোকানের সামনে এসে দাঁড়ালো আজমত। বটু সবেমাত্র দোকানের ঝাঁপ খুলেছে। ঢোকেনি এখনো ভিতরে। দৃশ্যটা দেখে খানিকটা হতাশ লাগে তার। জোয়ান মর্দ মানুষ আলসে কেন হবে? ব্যপারির বয়স তো বেশি না। চল্লিশও কি হবে? অল্প দিনেই তার মুদি দোকানের ব্যবসাটা ফুলে ফেঁপে জমজমাট হয়ে দাঁড়িয়ে গেছে। কিন্তু আজকাল লোকটা বাড়াবাড়ি রকমের আলসেমি করে। এইতো শীতকাল পড়ার পর থেকে দোকানে আসতে আসতে রোজ বেলা বারোটা বাজিয়ে দেয়।

আজমত দৃঢ় ধারণা পোষন করে এই যে, কাজের লোক দিয়ে ব্যবসা সামলানো যায়না। সেজন্যেই দিব্য দৃষ্টিতে যেন সে দেখতে পায়, হরির লুট লেগেছে ব্যপারীর দোকানে! তবে ব্যপারী লোকটাকে সৎ হিসেবেই জানা যায়। দোকানে তার আলাদা খরিদ্দার আছে। এরা পাকা। এই দোকান ছাড়া ভুলেও অন্যদিকে মুখ তুলবেনা কখনো। ঠকবেনা এই ভরসা তাদের কাছে কেন, জগতের সব ভোক্তার কাছেই তো অনেক বড় ব্যপার। সারা মাসের বাজার করে এমন ক্রেতা থেকে সামান্য একটা মিনিপ্যাক শ্যাম্পুর ক্রেতা সব শ্রেণীর আনাগোনাই আছে দোকানটায়।

বাজারটির আরেক আলোচিত চরিত্র রফিক তার ঝালমুড়ির পসরা নিয়ে দাঁড়ালো। তার রঙ্গিন গাড়িটি বিচিত্র। তিন চাকার একটা ভ্যান তিন দিক থেকেই ঘেরা। ভিতরে প্লাস্টিকের বস্তাভরা মুড়ি, মশলা, অন্যান্য সরঞ্জাম। বাইরের দিকে ঝালর ঝোলে দিনমান। লাল, সবুজ, নীল বিভিন্ন রঙ্গা সেসব। সারাদিন মৃদু লয়ে কাওয়ালি বাজে তার গাড়িতে। লোকজন সেই কাওয়ালি শুনতে শুনতে হুড় দিয়ে তার ঝালমুড়ি সাবাড় করে। আজমত বসে থেকেই চ্যঁচালো। ওই রফিক দুই টাহার মুড়ি মাহা…..

রফিক হাঁসে। কাহা দুই টেকার ঝালমুড়ির দিন আসে নিহি..পাঁচে বানায়া পুষে না!

পাশের দোকান থেকে কেউ ফোড়ন কাটে- আরে বানা না হালায়, আজমতেই তোর মুড়ির আসলি সমঝদার…

আজমত খেঁকিয়ে ওঠে। মেলা কথা কস রফিক তুই..ফাউল কইনকার…

আজমতের হম্বিতম্বি গোটাবাজারের জন্যেই কৌতুকের জোগানদার। ছোট খাটো দেহ নিয়ে সে প্রায় গা ঝাঁকিয়ে চিৎকার করে কথা বলে। গলার স্বরে উচ্চতা ঢাকার প্রয়াস। শীত পড়ার পর থেকে তার গায়ে জোব্বা সাইজের একটা জীর্ণ জ্যাকেট দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। যেটি তাকে আরো দৃষ্টিনন্দন করে তুলেছে! যেন একটা রোগাভোগা পেঙ্গুইন। যদিও ওই রোগাভোগা দেহটা এখনো বয়সের তুলনায় শক্তপোক্ত। জ্যাকেটটির ইতিহাস সবার কাছেই একটা অজ্ঞাত বিষয়!কবে সেটি আজমতের হস্তগত হয়েছিল জানা যায়না।কেবলমাত্র প্রতিটা শীতে, তারশীর্ণদেহের উপর ওটার দেখা পাওয়া যায়।হাঁসতে হাঁসতে রফিক ঝালমুড়ি মাখাতে শুরু করে। আজমত চিরকাল তার বৌনি খরিদ্দার। মিরপুরের এই বাজারে যেদিন থেকে তার ব্যবসার শুরু, সেদিন থেকে আজ পর্যন্ত তার তার প্রথম কাস্টমার আজমত। সময়ের সাথে সব কিছুরই মুল্য বেড়ে গেছে। আজমতেরটা বাড়েনি। বরাবর সে দুইটাকার ঝালমুড়িই মাখাতে বলে। কিন্তু পরিমাণে কম হবে সে উপায় নেই…

ঝালমুড়ি চিবাতে চিবাতে আজমত জলজলে চোখে চেয়ে দেখে, বাজার জমে উঠেছে। সাতশো পদের বাজারে সাতশো পদের হল্লা!

দ্বিতিয় দৃশ্য
ব্যপারি দোকানে পৌছুতে পৌছুতে সাড়ে এগারোটা বেজে গেল। তার খানিকবাদেই মাসের বাজার করে এমন একজন দোকানে আসলো। তার চাহিদা বিশাল। আধাঘন্টা পর দেখা গেল সদাইপাতি একাট্টা করে দু-তিনটে বস্তায় দাঁড়িয়েছে। আজমতের ডাক পড়লো তখন। একটা আটার বস্তা রিকশায় উঠিয়ে দিয়ে এসে কিছুক্ষণ আগে সে মজুর দোকানের বেঞ্চে বসেছে। ব্যপারির ডাকে সে প্রায় উড়ে পৌঁছুলো।

তাকে দেখে ব্যপারির চেহারায় ভাব বিশেষের পরিবর্তন হয়না। কাহা, সদাইর বস্তাডা রিকশায় উঠায়া দিয়া আসো..

এই খদ্দেরকে আজমত চেনে। প্রতিমাসেই আসে ছেলেটা। কোন এক অজানা কারণে ছেলেটাকে বড় ভাল লাগে তার। অবশ্য তার পিছনে অর্থনৈতিক কারণ থাকলেও থাকতে পারে। সেটির বিশ্লেষণ তো আর আজমতের পক্ষে করা সম্ভব না। তবে যতক্ষণ তার আশপাশে থাকতে পারে আজমতের বড় ভাল লাগে। বেশি সময় তো পাওয়া যায়না। প্রতিবার বস্তাটা মাথায় করে নিয়ে বাজারের শেষপ্রান্তে যাওয়া। ছেলেটাই রিকশা ঠিক করে। আজমত মাথা থেকে রিকশার পা-দানিতে বস্তাটা নামিয়ে দেয়। ব্যপারি তাকে রোজ এম্নিই ষাট-সত্তর টাকা করে দেয়। দশ-পাঁচ করে খদ্দেররাও তাকে যে বকশিষটা দেয়, দিনের শেষে শ’দেড়েক টাকা তার লুঙ্গির খোঁটে জমা হয়।

আর এই ছেলেটা তাকে প্রতিবারই কিছু না কিছু দেয়। এই তো দুমাস আগে রোজার ঈদের সময় দুশো টাকা হাতে গুঁজে দিয়েছিল। সেই টাকা হাতে নিয়ে কেঁদে ফেলেছিল আজমত। বাজারের সবাইকে সে বিনোদিত করে, ঘাম ঝরিয়ে নিজের পরিবারের তিনবেলার খাদ্যের জোগান সে দিয়ে চলে। কিন্তু তার কষ্টের যায়গাগুলো বোঝার কেউ তো নেই। বিশ-বাইশ বছর বয়সের এই ছেলেটাকি বোঝে? আজমতের কোন কিছুই জানা নেই। বহুকালই তো হবে,তার সমস্ত অনুভূতি বড় ভোঁতা হয়ে গেছে।

ঘাড়ে বস্তা তুলতে ছেলেটা তাকে সাহায্য করলো। চাচামিয়া সাবধানে যায়েন, আমি পিছনে আছি..

দুলে দুলে আজমত সামনে এগুতে শুরু করে। পাঠক মুহুর্তের জন্য আসুনআমরা উঁকি মারি ছেলেটির মনের ভিতর। সেখানে দুঃখবোধের নার্ভ টিপটিপ করে জ্বলছে। ছেলেটির নাম মনির। এবং এই মুহুর্তে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে, আজমতের প্রস্থানের দিকে তাকিয়ে সে একটি দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো!

রিকশায় উঠতে যাবে, এমন সময় কোথা থেকে এক কুকুর এসে মনিরের পায়ে কামড় বসিয়ে নড়ে নড়ে সরে গেল নিজের গন্তব্যে। ঘটনাটি এতই আকস্মিক যে, চারপাশের লোকজনও অবাক হয়ে গেছে। খানিকপর সবাই হই হই করে উঠলো। আরে আরে ভাই, কামড়ায়া দিল…কেউ একজন বলল, ডাক্তারের কাসে নেন রে ভাই, জলদি ডাক্তারের কাসে নেন…

ডিস্পেন্সারিতে বসে থাকতে থাকতেই মনিরের গা কাঁপিয়ে জর এসে গেল। কুকুরে কামড়ানো এমন কোন ব্যপার না। কিন্তু তার মস্তৃষ্কেব্যপারটার ভয়াবহ যে স্মৃতিটা আছে, সেটাই জ্বরের প্রকোপের কারণ। সে স্মৃতি আমাদের ঘাঁটতে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। কেন নেই আমরা সামনে সেটার আবশ্যিক একটা ব্যখ্যা পাবো।

জিন্সের প্যান্টের কারণে কামড় ভালমতো বসেনি। কিন্তু টাকনুর উপর ফাঁকা যায়গাটায় একটা দাঁত বসে গেছে। ডিস্পেন্সারির বয়স্ক লোকটি গম্ভির মুখে সালফিউরিক এসিডের দ্রবণ দিয়ে যায়গাটা মুছে দিল ভাল মত। লাল হয়ে আছে ছোট্ট ক্ষতটার চারপাশে। এক টুকরা তুলোয় এণ্টিসেপটিক লাগিয়ে যায়গাটা ব্যান্ডেজ করে দিলো লোকটা।

কি ভেবে আজমত মনিরের সাথে উঠে পড়লো রিকশায়। যে জ্বর এসেছে, রিকশাতে থির বসে থাকতে পারবেনা ছেলেটা, তার একটা দ্বায়িত্ব তো আছে!

তৃতীয় দৃশ্য
বর্ষাকাল ছিল। ঘোর বর্ষাকাল। আজমত মিয়া আর রইস যাচ্ছিল বাজারে। রইসের তখন উঠতি বয়স। পনেরো কিংবা ষোল। বড় রাস্তায় ওঠার পর কোথা থেকে এক পাগলা কুকুর এসে রইসের পায়ে কামড় বসিয়ে দিল। দাঁত ফুটিয়েই কুকুরটা ক্ষান্ত হল না। লুঙ্গি ভেদ করে পায়ের নরম মাংসে যে দাঁত বসিয়ে ছিল সে, তা দিয়ে মাংস ছিঁড়ে নেবার চেষ্টা চালাতে লাগলো! আজমত ধাঁই করে ওটার পেটে একটা লাত্থি বসিয়ে দিয়েছিল সেদিন। সরে খানিক দূর যাবার পরই একটা কার্ভার্ড ভ্যানের চাকার নিচে পড়েছিল চারপেয়ে জীবটি!

কুকুর প্রজাতির মাথা খারাপ হয় শীতকালে। বর্ষাকালে তো না। অথচ সেদিনের কুকুরটা পাগলই ছিল। তবে হুজুরের কাছ থেকে বাটিপড়া কিংবা কবিরাজি ওষুধের গুণে আজমত বড় নিশ্চিন্তই হয়েছিল।

ঘটনাটার আট-নমাস পর একদিন পানির ভিতি শুরু হল রইসের। পানি দেখলেই গাঁগাঁ করে চিৎকার করে ছেলে। অথচ সারাদিনই পানি পানি বলে কাতর ধ্বনি মুখ থেকে বেরুতো তার। চোখ দুটো রক্তবর্ণ হয়ে থাকতো। লালা ঝরতো মুখ থেকে। ছাপড়া ঘরের একটায় বেঁধে রাখতে হত তাকে শেষ দিন গুলোতে!আজমতের জোয়ান হয়ে উঠতে থাকা ছেলেটা শেষতক রুপান্তরিত হতে শুরু করেছিল কুকুরে। তবে বেশি সময় সে হতভাগা পায়নি। ২২ দিনের মাথায় মারা গিয়েছিল..

সব কিছু এখনো ছবির মতো চোখে ভাসে আজমতের। ভুলবে কিভাবে সে? ভোলার কথা তো নয়। আজমতের বউ শরিফা তখন ভরা মাসের পোয়াতি। পুত্রশোকে সে বিছনধরা হয়ে গিয়েছিল আরো!বড় মেয়ে দিবু কি অবিশ্বাস্য ভাবেই না সংসার সামলাতে লাগলো সেসব দিনগুলোয়! রইস মারা যাবার সপ্তাহ খানিক বাদে শরীফা বাচ্চা প্রসব করলো। একটা ফুটফুটে কন্যা শিশু।

মনিরকে বাসায় পৌছে দিয়ে আজমত ফিরছিল। আজ কেন শুধু পুরানো দিনগুলোর কথা মনে পড়ছে? মনির ছেলেটার জন্যেও বড় খারাপ লাগছে। এই ছেলেটি নিশ্চয় সামান্য কুকুরের কামড়ে মারা যাবেনা। তার বাপতো আর আজমতের মতো গর্ধব আর হাড়-হাভাতে নয়!

আজকের ঘটনাটা বারবার তাকে অতীতে টেনে নিয়ে যেতে চায়। বেলা পড়ে যাওয়া শহরের পথ দিয়ে আজমত হাঁটতে থাকে। আশপাশে হঠাৎ কিছু একটা ব্যপার নিয়ে হৈচৈ ওঠে। উপরের বিল্ডিং থেকে রাস্তায় কেউ ময়লা পানি ফেলেছে। সেই পানি পড়েছে এক মাওলানার গায়ে.. বাতাসের তোড়ে তার ফিনফিনে দাড়ির গোছা অদ্ভুত ভাবে কিলবিল করতে থাকে।অল্প বয়সি মাওলানা দাঁত কিড়কিড় করে কি যেন বলে ওঠে।সেসবের কিছুইকানে ঢোকেনা আজমতের!

চতুর্থ দৃশ্য
জাগতিক নিয়ম অনুসারেই তার পরিবারটা অনেক বড় হবার কথা। শিক্ষার আলো কিংবা বালাইহীন, বিত্তহীন একজন মানুষ সে আজন্ম। তবে এদিক দিয়ে আকাশমালিক খানিকটা করুণা তাকে করেছেন বলতেই হবে। আজমতের পরিবারের সদস্য সংখ্যা এখন সাকল্যে ৪জন। শরীফা, দিবু আর হামু।

ছোট মেয়েটি, যার জন্ম তুলনামুলক হারে খুব দুঃসময়ে তার এমন অদ্ভুত নামের কোন ইতিহাস নেই। কোন কারণ ছাড়াই তার নাম হামু হয়ে গেল দেখতে দেখতে। এই করুণ জগতে সে আর তার বড় বোন দিবু কেউই রুপ নিয়ে আসেনি। দিবুর বয়সের কোন হিসাব আজমতের কাছে নেই। দিবু নিজে কি জানে? রইস যখন মারা গেল তার বয়স তখন কত হবে? নয়-দশ বড়জোর! রইস মারা গেছে আজ তাও ২২-২৫ বছর হয়ে গেছে বলেই আজমতের মালুম হয়।

ভর সন্ধ্যায় সে ঘরে ফিরলো। শরীফা কই গেলিরে…

পঞ্চাশোর্ধ শরীফা শুয়ে ছিল বিছানায়। তড়িঘড়ি করে উঠে বসলো সে। কিন্তু আজমতের দৃষ্টি এড়াতে পারলোনা ব্যপারটা।

ভর সন্ধ্যায় ফিরে শুইয়ে আসিশ মাগি? নামাজ-কালাম নাই। আল্লার নাম নাই..

বুড়োর গজগজানি শোনাটা এই বয়সেও শরীফার কাছে পুণ্য মনে হয়। সে কিছু বলেনা।

কত এইরে কবো তোরে মাগরিবির অক্তে শুইয়ে থাকপিনে! এরপর দেকলি লাত্থি সাড়া কতা কবোনা কইয়ে দেলাম..আজমতের গজগজানি ধিরে ধিরে নিস্তেজ হয়ে আসে। হঠাৎ আসা উত্তেজনার মত ব্যপারটা। হঠাৎই মনের মাঝে সেই দুপুর কিবা বিকেলের বিমর্ষ ভাবটা ফিরে আসে। শরিফা নরম গলায় বলে- ভাত বাইড়বো? হাতমুক ধুইয়ে আসেন আপনে, আমি ভাত বাড়ি…

নারে রইসির মা। মনডা বড় খারাপ হইয়ে আসে। ভাত পরে খাবানি। নিজের কাছে নিজের কন্ঠস্বরটা অদ্ভুত নরম শুনায় আজমতের। এভিনিউ ফাইভের বস্তির ছাপড়া থেকে বেরিয়ে সে মোড়ের চায়ের দোকানের দিকে হাঁটা দেয়। শরীরটাও বড় খারাপ লাগছে আজ….

পাঠক এই দৃশ্যটি থেকে আমরা প্রবল জ্বরে কাতর মনিরের শিয়রের কাছে দাঁড়াই চলুন। আশ্চর্য্যজনক ভাবে তার মস্তৃষ্কের সেলগুলিতেও আজমত দৃশ্যান্তরিত হচ্ছে প্রতিমুহুর্তে। পেটের দ্বায়ে এই জয়িফ বয়সে এসেও লোকটা মানুষের বস্তা বয়ে বেড়ায়। জগতটা এত কেন কঠিন? মনির বরাবর ভেবে এসেছে, ভাবে। কিছুকি সে এই সহায় সম্বলহীন বৃদ্ধের জন্য করতে পারেনা?

অথচ দিনের পর দিনই তো কেটে গেছে। কিছুই করা হয়নি, আসলে করা হয়ওনা কখনো। তবু মনের ভিতর একটা খচখচানি সে টের পায় মাঝে মধ্যেই। বেশিদিন হয়নি অবশ্য আজমতের সাথে তার পরিচয়। এইতো গত ঈদের সময়কার কথা। টিউশনীর টাকা থেকে দুশোটাকা সে দিয়েছিল আজমত কে। এটাকে নিশ্চয় কিছু করা বলেনা।

আজো সেই বৃদ্ধ লোকটি যেচে পড়ে তাকে এগিয়ে দিয়ে গেছে বাসায়। রিকশায় তুলে তাকে একলা ছাড়তে চায়নি। জ্বরের ঘোরে টলছিল সে। শীর্ণদেহি আজমত একহাতে তাকে ধরে রেখেছিল। অবশ্য মনির যদি ঢলে পড়তো, আজমতের সাধ্য থাকতোনা তাকে ধরে রাখে! তবু পারবে, তাকে রাস্তায় উলটে পড়তে দেবেনা এই বিশ্বাসেই কি ধরেছিল?

ইঞ্জেকশন নেবার পর ডঃ বলেছেন কুকুরের কামড় চিন্তার কোন ব্যপারই না। জ্বর এসেছে ভিতি থেকে। দুদিনে সেরে যাবে…

জ্বরের ঘোর আজমতের কন্ঠস্বরের আচ্ছন্নতা তৈরী করে তার জগতে। বুঝলেন বাপ, বড় মাইয়েডা দেকতি দেকতি বিয়ের বয়স পার কইরে ফেলালো..যৌতুকির জন্যি মাইয়েডারে পার কত্তি পাল্লাম না..সোডডাও ডাঙ্গর হইয়ে গেল….

জাহানারা দেখলেন তার ছেলেটা জ্বরের ঘোরে কিসব বলছে। স্পষ্ট বোঝা যায়না কিছু, মুখ থেকে কেমন বিজবিজ শব্দ আসছে। মনিরের আচ্ছন্নতা তখন তুঙ্গে উঠেছে…সোডডা গার্মেন্সে কজ কইরে মোডে ষোলশ টাহা পায় মাসে, ওতিকি সংসার চলতি পারে কন? আহারে আমার সুয়ালডা বাইচে থাকলি হতো! তালি পরে এই বয়সে আইসে মাইনষির মাল-পত্তর ঠেলতি হতোনা!….

পঞ্চম দৃশ্য
ব্যপারি মামা, আছেন ভালো?

সদাই মাপায় ব্যস্ত ব্যপারি তাকে দেখে হইহই করে উঠলো। আরে মনির মামা! কতদিন পর..শরীল কেমুন এহন?..গলা চড়িয়ে সে বটু কে ডাকে। ওই বটু চা লয়া আয়…

আসেপাশেই কোথাও ছিল বটু। দোকান থেকে ফ্লাক্স নিয়ে হাঁটা দিল সে। চা আনতে হবে রব্বানী হোটেল থেকে। স্পেশাল কাস্টমারদের জন্য স্পেশাল চা।

মনির হাসল। চা আজ খাওয়া যায়। চারদিনের জ্বর ছিল তার। সেও সপ্তাহখানেক আগের ব্যপার। আজ আগের চেয়ে অনেক সুস্থ বোধ করছে। ব্যপারির কাছে আজ সে সদাই কিনতে আসেনি। এসেছে জরুরি একটা কাজে..কুরবানি ঈদের তো বেশি বাকি নেই। টিউশনীর টাকা থেকে আজমতের জন্য কিছুটা আলাদা করা গেছে….

পান চিবাতে চিবাতে ব্যপারি বলে- আজমতের তো মামা ঠিক ঠিকানা নাই। এই যে তিনদিন ধইরা সে বাজারে আসেনা। ঈদের সময় তো। হ্যায় ধরেন সাহায্যের জন্য নানান যায়গায় ঘুরাঘুরি লাগায়, তয় এইবার কই গেছে কিছুই মালুম হয়না…আপনি হ্যার বাসায় যাইতে চান? ব্যপার না। আমি কইতাসি ক্যামনে যাইবেন…..

তারপর
দৃশ্যটা মনিরের মনে কেন যেন কোন প্রতিক্রিয়াই তৈরী করতে পারেনা। একটা ভাঙ্গাচোরা টিনের কামরায় ময়লা একটা বিছানা পাতা। তাতে শুয়ে আছে গলা পর্যন্ত কাঁথাটানা এক মেয়ে। রোগভোগে ওই মুখ কতটা ক্লিষ্ট সেটা সহজেই অনুমান করা যায়..মনির বুঝতে পারে, এটা হল আজমতের বড় মেয়ে দিবু। কলপাড়ে পড়ে গিয়ে বছর দুয়েক আগে যার কোমর ভেঙ্গে গিয়েছিল..সে হামু কিংবা আজমতের স্ত্রীর জন্য এদিক ওদিক তাকালো। গেল কোথায় আর সবাই?

শরিফা কোথা থেকে উদয় হয়ে উতসুক হয়ে জানতে চাইলো- কারে খুজেন বাজান?

মনির ইতস্তত করে বলল- আজমত মিয়ার খোঁজে এসেছিলাম।

শরীফার কন্ঠস্বর খুব নিচু লয়ে বেজে ওঠে। – আমি ওনার পরিবার। আমারে বলেন।

যেটি একটি অকিংবদন্তি
রেল স্টেশনের লোকজন প্ল্যাটফর্মের ভিতর ঢোকার আগে একবার করে বস্তুটার দিকে তাকায়। পথের পাশে চিত হয়ে পড়ে আছে লুঙ্গি আর কুঁচকানো খয়েরি ফতুয়ার উপর বেঢপ রংজলা জ্যাকেট পরা এক বৃদ্ধ। তাকে ঘিরে ছোটখাটো একটা ভিড় জমে। বৃদ্ধের মাথার কাছে আধখাওয়া একটা পাউরুটি পড়ে আছে। দুটো নীলরঙ্গা মাছি সেই পাউরুটির উপর ভনভন করছে।

দাঁড়িয়ে থাকা লোকজনের ভিতর কেউ একজন বলে মরসে রে..কেমনে মরলো কে জানে। পাশ থেকে সাস্থ্যবান একজনকে নড়েচড়ে উঠতে দেখা যায়। সে পান-বিড়ি বেচে, গলায় সেসবের একটা ঝুড়ি ঝুলছে তার। -আরে গত রাইতে দ্যাখলাম রে ভাই। লম্বর সাড়া কুলিগিরি হরতে গেসিল, বাইট্টা এক কুলি এমুন মাইর দেলে…হেই রাইতের কতা..মাইরের চোডে মরসে মনে লয় বুইড়া…

এমন সময় ট্রেনের হুইসেল শোনা গেল। সবাই প্লাটফর্মে ঢোকার জন্য হুড়োহুড়ি লাগায়। পড়ে থাকা লাশটি সবার আগ্রহ হারাতে থাকে। তবে মাছি দুটো তখনো ভনভন করছিল রুটির টুকরোটিকে আরাধ্য করে। সকালের প্রথম রোদ এসে গায়ে পড়ায় হঠাত চোখ দুটো পিটপিট করে ওঠে আজমতের !


———————-

এনামুল রেজার গল্প


সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০১৪ সন্ধ্যা ৭:৫২
৯টি মন্তব্য ৯টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

৫০১–এর মুক্তিতে অনেকেই আলহামদুলিল্লাহ বলছে…

লিখেছেন বিচার মানি তালগাছ আমার, ০৩ রা মে, ২০২৪ বিকাল ৩:০০



১. মামুনুল হক কোন সময় ৫০১-এ ধরা পড়েছিলেন? যে সময় অনেক মাদ্রাসা ছাত্র রাজনৈতিক হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছিল। দেশ তখন উত্তাল। ঐ সময় তার মত পরিচিত একজন লোকের কীভাবে মাথায় আসলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঝিনুক ফোটা সাগর বেলায় কারো হাত না ধরে (ছবি ব্লগ)

লিখেছেন জুন, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ৮:০৯

ঐ নীল নীলান্তে দূর দুরান্তে কিছু জানতে না জানতে শান্ত শান্ত মন অশান্ত হয়ে যায়। ১৯২৯ সালে রবার্ট মোস নামে এক ব্যাক্তি লং আইল্যান্ড এর বিস্তীর্ণ সমুদ্র... ...বাকিটুকু পড়ুন

'চুরি তো চুরি, আবার সিনাজুরি'

লিখেছেন এমজেডএফ, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৮


নীলসাধুকে চকলেট বিতরণের দায়িত্ব দিয়ে প্রবাসী ব্লগার সোহানীর যে তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছিল তা বিলম্বে হলেও আমরা জেনেছি। যাদেরকে চকলেট দেওয়ার কথা ছিল তাদের একজনকেও তিনি চকলেট দেননি। এমতাবস্থায় প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বরাবর ব্লগ কর্তৃপক্ষ

লিখেছেন নীলসাধু, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১১:২২

আমি ব্লগে নিয়মিত নই।
মাঝে মাঝে আসি। নিজের লেখা পোষ্ট করি আবার চলে যাই।
মাঝেমাঝে সহ ব্লগারদের পোষ্টে মন্তব্য করি
তাদের লেখা পড়ি।
এই ব্লগের কয়েকজন ব্লগার নিজ নিক ও ফেইক... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ অপেক্ষা

লিখেছেন রানার ব্লগ, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১১:২৩



গরমের সময় ক্লাশ গুলো বেশ লম্বা মনে হয়, তার উপর সানোয়ার স্যারের ক্লাশ এমনিতেই লম্বা হয় । তার একটা মুদ্রা দোষ আছে প্যারা প্রতি একটা শব্দ তিনি করেন, ব্যাস... ...বাকিটুকু পড়ুন

×